গোপালগঞ্জের দীপ্ত সাহা (২৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান — রাষ্ট্রের বয়ানে, আর সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে, সেটি যেন নিছক একটি দূর্ঘটনা; যেন একটি ভুল গুলি, একটি ভুল সময়, ভুল জায়গায় থাকা এক নিরীহ শরীর। অথচ প্রশ্ন থেকে যায়—যদি তার নাম ও রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা অবস্থান ভিন্ন হতো, তাহলে কি এই ঘটনা কিছু শুধুই দূর্ঘটনা নাকি হত্যা হিসেবে গণ্য হতো ?
শুধু দীপ্ত সাহা নয়, তিনি সহ আর ৫ জন এখন পর্যন্ত গোপালগঞ্জের সহিংসতায় নিহত হোন, গুলিবিদ্ধ আরো অনেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নিহত পাঁচজন এর হয়নি কোন ময়নাতদন্ত কিংবা কোন ধরনের আইনি বিচারিক প্রক্রিয়া, কারণ তারা সন্দেহতীতভাবে কেউ কেউ পতিত স্বৈরাচারী দল আওয়ামী লীগ এর সমর্থক হতে পারেন । তাদের নিয়ে কোন প্রথম সারির গণমাধ্যম প্রশ্ন তুলেনি এমনকি রাষ্ট্র খুব সূক্ষ্মভাবে তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কে হাতিয়ার করে তাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকে এড়িয়ে গেছে ।
ঘটনাটির সাথে নিৎসের একটি জনপ্রিয় দার্শনিক বক্তব্য এর সাথে মিলে যায়,
যদি আপনি একটি তেলাপোকাকে হত্যা করেন তাহলে আপনাকে সবাই নায়ক বলবে আর যদি একটা সুন্দর প্রজাপতি হত্যা করেন তাহলে আপনি একজন খলনায়ক। যদি এটি গোপালগঞ্জের ঘটনার সাথে তুলনা করি তাহলে এইখানে রিকশাচালক রমজান আলি রূপকভাবে এইখানে তেলাপোকা যাকে নিয়ে রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই ।
এইখানে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন ব্যাপক ভাবে ঊঠে আসে
১। এই ঘটনায় আসলে রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু উপযোগ বয়ে নিয়ে আসবে?
২। রাজনৈতিক পরিচয়ে হত্যা কতটুকু অন্যায্য,এর ফলাফল কি হতে পারে?
৩।আদৌ কি রাষ্ট্র সকলের সমান মানবাধিকার কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছে?
১.
১৬ জুলাই এর ঘটনাটি আসলে দানা বাঁধে ১৫ এই আগস্ট এনসিপির নেতা সার্জিস তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেন “মার্চ টু গোপালগঞ্জ” – অথচ বিগত সময়ে তা ছিল জুলাই গণপদযাত্রা । গোপালগঞ্জকে কেন্দ্র করে তাদের স্লোগান এবং অনুষ্ঠানের নাম পরিবর্তন পরিকল্পনার অংশ যা বুঝার বাকি থাকে না । অন্যদিকে হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজে শেয়ার করেন “মুজিববাদ মুর্দাবাদ” । এইসব পোস্ট গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে নানা মুখী গুজব ছড়িয়ে পড়ে যেমন, বঙ্গবন্ধুর সমাধি ভাঙ্গা হবে , কিংবা ধানমন্ডি ৩২ এর মত গোপালগঞ্জর বাড়ি গুড়িয়ে দেওয়া হবে ।
১৬ জুলাই এর ঘটনার জন্য অবশ্যই এনসিপি এর দায় রয়েছে কেননা তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা ঘটনাটিতে আর বেশি তা দিয়েছে । তবে কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যায় জুলাই এর প্রায় এক বছর এসে কিভাবে আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার সুযোগ পায়? সেক্ষেত্রে আইন এবং প্রশাসনের কি ভূমিকা ছিল ? ১৬ জুলাই দেখা যায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন জেলা হতে এসে অবস্থান করে এবং জুলাই পরবর্তীতে বিভিন্ন আওয়ামী ক্যাডার গোপালগঞ্জে লুকিয়ে থাকার খবর পাওয়া যায় । অথচ প্রশাসন এর উচিত ছিল সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করা, যা প্রশাসন করতে পুরোপুরি ব্যার্থ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানা ভিডিওতে দেখা যায় যখন হামলা সংগঠিত হচ্ছিলো তখন পুলিশ নিরব দৃষ্টিতে হামলা দেখে যাচ্ছিল অর্থ্যাৎ হামলাটি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের কোন সক্রিয় ভূমিকা ছিল না । দ্বিতীয়ত, যখন বিভিন্ন জেলা থেকে পতিত ফ্যাসিস্ট দলের মানুষজন গোপালগঞ্জে আসতে শুরু করেছিল ঠিক সেসময়ে রাষ্ট্রীয় ইন্টিলিজেন্স ব্যাপক নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায় ।সারমর্ম হল যদি প্রসাশন থেকে সঠিকভাবে ব্যাবস্থা নেওয়া হতো তাহলে এতগুলো মৃত্যু ঠেকানো যেত যেটা পুরোপুরি রাষ্ট্রের দায়। সুতরাং যে বিষয়টি এড়ানো যেত সেখানে রাষ্ট্রের উপযোগ এর কোন প্রশ্নই আসে না বরং আপনি যতই কিছু বলেন না কেন উক্ত ঘটনায় পুলিশ অস্ত্রহীনদের গুলি না করলে জাতীয় নেতার প্রাণ বিপন্ন হতে পারতো, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কার কতটুকু জীবনের মূল্য বেশি কিংবা কম রাষ্ট্র হিসেবে আপনি কি কখনো পরিমাণ করতে পারেন কিনা কিংবা এমন কোন পরিমাপক কি রয়েছে কিনা ? প্রশ্ন সহজ উত্তর হচ্ছে অবশ্যই না ।
২.
নিৎসে তার মেটাফরিক বাক্য দিয়ে সমাজের দ্বিচারিতা দেখাতে চেয়েছেন যে , সমাজের নিম্ন শ্রেণী জনগোষ্ঠী এর সাথে যেকোন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে সমাজ সেটাকে মেনে নেয় এবং সমাজ বাহবা দেয় ।
যেমন একই অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনকারী ২৪ আন্দোলনকারীকে সমাজ বিপ্লবী বলে চিহ্নিত করে আবার কয়েক দশক ধরে পাহাড়ের মানুষরা তাদের অধিকার আদায় করতে কথা উঠলে তাদেরকে বিদ্রোহী , জঙ্গি গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ।
বর্তমান সরকার বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের যে কাউকে বিচারবহির্ভুত হত্যা করা কিংবা তার উপর নির্যাতন রাষ্ট্রের চোখে অন্যায্য কিছু হিসেবে দাঁড়ায় না বরং বর্তমানে বাহাদুরি হিসবে দেখা হয়। যদি আওয়ামী লীগ এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন করার জন্য শর্ট টার্মে বেশ ইম্পেক্টফুল দাবী করা হলেও আদতে, এটি দীর্স্থায়ী ভাবে রাষ্ট্রকে একটি অগণতান্ত্রিকতা এবং বিচারহীনতার সংকৃতিকে আবারো ফিরিয়ে নিয়ে আসে নতুন আঙ্গিকে । যা একটি সাম্যতা ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য ব্যাপক ভয়াবহ বার্তা দেয়।
গোপালগঞ্জের রিকশাচালক রমজান আলি কিংবা দীপ্ত সাহা এর বিচারবহির্ভুত রাজনৈতিক হত্যা শুধু বাংলাদেশ এর রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম বৈকি নয়, এর পূর্বে- শিবির সন্দেহে বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যা, কিংবা জঙ্গি/রাজাকার ট্যাগিয়ের মাধ্যমে শাপলাচত্বরের ম্যাসাকার , কিংবা ১৭ বছরের আওয়ামী রেজিমে শতশত গুম-খুন । প্রত্যেকটি একটি কমন গ্রাউন্ড ছিল ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ লালন কিংবা সরকার বিরোধী অবস্থান । যেখানে ৯০ শতাংশ এর বেশি গুম খুনের কোন এক্সমাপলারি বিচার হয়নি । তৎকালীন স্বৈরাচার এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক হত্যাকে জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়েছে কারণ আওয়ামী বিরোধী মানেই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কিংবা রাজাকার । ” একটা একটা শিবির ধর ধইরা ধইরা জবাই কর” কাউকে হত্যা করা অবশ্যই অপরাধ তবে শিবির কর্মী হলে ভিন্ন কথা । এই যে নিরেপেক্ষ ,সঠিক বিচার না করে কাউকে পানিশমেন্ট এর মুখামুখি করা এইসব শুধু মাত্র আরেকটি ফ্যাসিজম তৈরীর বার্তা বহন করে।
দ্বিতীয়ত, যে মূহুর্তে রাষ্ট্র বিভাজনের রাজনীতি শুরু করে তা শুধু রাষ্ট্র পর্যন্ত থাকে না তা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও গ্রাস করে সেটা গনমাধ্যমও হতে পারে । বিগত সময় গুলোতে গনমাধ্যমকে ফ্যাসিস্টের পক্ষে “ম্যানুফ্যাকচারিং কন্সেন্ট” তৈরি করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছে । গনমাধ্যম গুলো এই সুযোগ পায় কাকে কিভাবে এই ট্যাগিং এর রাজনীতির মধ্যে এনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা যায় । গত ১৭ বছর শুধু মাত্র শিবির কিংবা জামাত করে বলে মিডিয়া তাদের হত্যা কিংবা এক্সট্রা – জুডিশিয়াল এক্টিভিটিস করার ক্ষেত্রে ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট তৈরি করে এসেছিল এবং এই ভয়াবহ হাতিয়ার কিন্তু রাষ্ট্র নিজের হাতে তুলে দিয়েছে । যারা হওয়ার কথা ছিল জনগণের ধ্বনি তারা ক্ষমতাশীন এর ব্ল্যাকবোর্ড হয়েছিল । ক্ষমতাশীন ব্ল্যাকবোর্ডে যা লিখত তাই গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হতো । জুলাই এর পর্বর্তীতে এখনো এই চক্র থেকে বের হতে না পারা এই রাষ্ট্রের সব থেকে বড় ব্যর্থটা ।
তৃতীয়ত, প্রতিশোধের রাজনীতি বন্ধ করার একটি মাত্র উপায় তা হচ্ছে প্রত্যেকটি পক্ষকে নিরেপেক্ষ বিচার এর আওতায় আনা কিন্তু যখন রাষ্ট্র শুধু মাত্র দলীয় পরিচয় এর ভিত্তিতে নানান হত্যাযজ্ঞ চালায় কিংবা হতে দেখলে সেখানে চুপ থাকে সেই মুহুর্তে নিপীড়িত দলের মধ্যে জিইয়ে থাকে । নিপীড়িত গোষ্ঠী শুধু সময় ও সুযোগ খোঁজেন ক্ষমতায় গিয়ে সকল হিসেবে নিকেশ করার ।
৩.
বিগত বাংলাদেশ রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে দেখা যায় পুলিশ রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করার পরিবর্তে কোন নিদৃস্ট দলীয় এজেন্ডা নিয়ে কাজ করে । তবে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী প্রত্যেকমানুষের জীবন,স্বাধীনতা,ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে পাশাপাশি ICCPR (1966) অনুযায়ী প্রত্যেকটি নাগরিককে তার জীবনের অধিকার, নির্যাতনের উপর নিষেধাজ্ঞা,ন্যাবিচার করার কথা বলা হয়েছে । এমনকি বাংলাদেশ এর সংবিধান এর ধারা ৩১,৩২,৩৩,৩৫ একই অধিকারে কথা বলা হয়েছে ।সারমর্ম হচ্ছে রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে একই অধিকার দিতে বাধ্য ।
অথচ গোপালগঞ্জের নিহতদের ক্ষেত্রে ঠিক ভিন্ন বিষয় ঘটেছে , যারা হত্যা কাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাদের হাতে কোন ধরনের অস্ত্র ছিল না কিংবা অস্ত্র থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় নি সুতরাং রাষ্ট্র কতৃক তারা যেই নির্মমটার শিকার হয়েছেন তার দায় সরকারকেই নিতে হবে । জুলাই পরবর্তীতে এই সরকারের লক্ষ্য ছিল একটা দায় ও দরদের সরকার ব্যাবস্থা গড়ে তুলা অথচ বর্তমান সরকার এইক্ষেত্রে সুবিধাজনক ভাবে বেছে নেওয়ার দিকে অর্থ্যাৎ চেরিপিকিং এর দিকে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সেসব দলের কিংবা সংগঠনের গায়ের জোর বেশি তাদের সেদিকেই সরকারের পাল নড়ে ।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২ সপ্তাহের বেশি হতে চললো এই হত্যাকাণ্ড গুলোর কোন ময়নাতদন্ত কিংবা এই ধরনের প্রাধান্য দিয়ে বিচারকার্য চোখে পড়ে নি, অন্তত মিডিয়া এইখান থেকে চোখ সরিয়ে ইস্যু অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছে । এইখানেই খাটে নিৎসের যুক্তিটি। যারা রাষ্ট্রের চোখে নিহত তারা সমাজের সর্বনিচুস্তরেও থাকেন কিনা সন্দেহ। অথচ এই সরকার এর সুযোগ ছিল সবার সরকার হয়ে উঠা । হয়ে উঠতে পারেনি। মানবাধিকার শুধু ক্ষমতাশীন এর অধিকার হয়ে উঠেছে।
কাজী মোহাম্মদ আলদীন ফারদিন,পড়াশোনা অর্থনীতি নিয়ে। চারপাশের সবকিছু অর্থনীতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখতে ভালোবাসি। এই বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকেও সমাজ, দর্শন ও রাজনীতির প্রেক্ষাপটে লেখনীতে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করি। বিশ্বাস করি, একদিন পৃথিবী সবার জন্য সাম্যের হয়ে উঠবে।