গণঅভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু কারণেই “নাম” কুড়িয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম ব্যাপার হচ্ছে, উনার একটা “চমৎকার” মিসোজিনিস্ট আর সেক্সিস্ট চরিত্র আছে। উনি প্রায়শঃই উনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেগম জিয়াকে সেক্সিস্ট আক্রমণ করতে ভালোবাসতেন। ভরা মজলিশে এমন সব কথাবার্তা বলতেন যে কোন ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলার পক্ষে সে সব শুনে কান গরম না করে স্থির থাকা মোটামুটি অসম্ভব। কিন্তু অদ্ভুত কথা হচ্ছে, উনার এসব নোংরামিতে দাঁত কেলিয়ে হেসে যেতেন এই দেশের শিক্ষিত বিদ্ব্যতজনদের বড় একটা অংশ। তাদেরকে কখনোই এসবে অস্বস্তি হয়নি। এসব যৌন রসাত্মক আলোচনার মধ্যে যে সামান্যতম সত্যতার অংশ ছিল কি ছিল না, তাতেও কারো তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই দেশের নারীবাদীদের এ ব্যাপারে কোন হেলদোল বা আপত্তির কথা কখনো শুনিনি। ফেসবুকের কিছু লেখক বোধ করি সে কারণেই মজা করে তাদেরকে ডাকেন, “নৌকাওয়ালা নারীবাদী”। নৌকামার্কার স্বার্থ ক্ষুন্ন হয় এমন কোন ইন্সিডেন্টে তারা মুখ খোলাকে স্রেফ গর্হিত পাপ মনে করেন।
রাণীমার নোংরামিটুকু বেশ মাথা পেতে নিতেন তারা। অন্যদিকে অভিমানী খালেদা এসব যথেচ্ছারে টু শব্দটিও করেননি। খালেদা কিন্তু চাইলে হাসিনার ভূতপূর্ব ব্যক্তিগত সহকারীর লেখা বই থেকে, দু লাইন শুনিয়ে হাসিনার কান দুটো গরম করে দিতে পারতেন। আমাদের ভাগ্য এই কারণে সুপ্রসন্ন যে, খালেদা তার স্বভাবসুলভ আভিজাত্যে সে রাস্তায় হাটার কথা ভাবেননি কখনো। নাহলে রাজনীতির পাশাপাশি এই কুৎসিত যৌন আক্রমণের দ্বৈরথও আমাদের হজম করতে হতো। হয়তো তারই প্রতিদান অল্প করে হলেও খালেদা পাচ্ছেন এখন, এক অবারিত সম্মান।
জুলাই এলো, হাসিনা বিতাড়িত, খালেদা সম্মানিত। বলা যেতে পারে, নারীশক্তি সম্মানিত। কিন্তু নারীর স্লাটশেইমিং কি “নতুন বাংলাদেশে” বন্ধ হয়েছে? রিয়েলিটি কি বলে? রাজনীতিতে নারীর জায়গা কতোখানি উদার হলো? কয়েকটা উদাহরণেই ব্যাপারটা দেখা যাক।
তাজনুভা জাবীন এনসিপির একজন আলোচিত নেত্রী। তাজনুভা সম্ভবতঃ এর আগে মিডিয়াতে কাজ করেছিলেন। সে সূত্র ধরেই ফেসবুকে এক সাংবাদিক তাজনুভাকে নিয়ে রীতিমতো অশ্রাব্য গোছের একটা পোস্ট দিলেন, তাতে বেশ আমোদিতই হলেন তার ফলোয়ারগণ। তাজনুভার বিরুদ্ধে অভিযোগ এতোখানিই নোংরা যে, এনসিপির লোকজন স্টাম্বল্ড হয়ে ছিলেন অনেকবেলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তখন কিছু মানুষ তার প্রতিবাদ করলেন, শেষে এসে শামিল হলেন এনসিপির নেতাকর্মীরা। এনসিপির মতন নতুন দলেরই যদি এই হাল হয়, তাহলে পুরনো দলগুলোর অবস্থা কেমন হতে পারে সেটা সহজেই বোঝা যায়।
অন্যদিকে ছাত্রদলের আনিকা কবির, মানসুরা আলমরা প্রায় সময়েই কুৎসিত সব যৌন রসাত্মক আক্রমণের শিকার হন রাজনৈতিক মতভিন্নতার জন্য। তাদের দোষ তারা বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত এবং আরো বড় অপরাধ তারা নারী। যে কোন ইস্যুতে তারা মুখ খুললেই কোন এক আওয়ামী লীগ নেত্রীর সাথে জড়িয়ে শুরু হয় নোংরামি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা তাসনিম জারা, সামান্থা, উমামা, তাজনুভাকে নিয়ে স্লাটশেইমিং পছন্দ করেন না, তারা আবার রুমিন ফারহানা, মানসুরা, আনিকাদের নিয়ে নোংরামিকে বেশ মজা নিয়ে উপভোগ করেন। ব্যাপারটা উল্টোভাবেও সত্য। ব্যাপারটা এখানে সিলেক্টিভ। “আমার” দলের নারীনেত্রীদের নিয়ে কিছু বলবেন না, কিন্তু “আপনার” দলের নারীনেত্রীদের চরিত্রহননে আমি আছি! নীতি বটে!
এই একটা ব্যাপারে সম্ভবতঃ সব রাজনৈতিক দলের কমবেশি ঐক্যমত্য আছে। কমবেশি সবাই এই জিনিসে বেশ মজা পান। নারীদের এরকম সেক্সিস্ট ফ্রেইমিং আওয়ামী লীগ রীতমতো কুখ্যাতি লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ আমলে কোন নারী আওয়ামী লীগের ইন্টারেস্টের বাইরে এলেই, ভার্চুয়ালি তার কাপড়চোপড় খোলা শুরু হয়ে যেত। এ ক্ষেত্রে অগ্রদূত বলা যায় সিপি গ্যাংয়ের সঙ্গীসাথীরা। সে কাজে হাততালি দিতেন আওয়ামী লীগের নারী সমর্থকগণেরাই। অবশ্য শেখ হাসিনা যেই দলের প্রধান তার নেতাকর্মীদের কাছে এরচেয়ে ভালো কিছু কিভাবে আশা করা যায়! কিন্তু অন্যান্য দল? তারা কেন এরকম কুৎসিত প্রবণতায় জড়িয়ে পড়বেন?
জুলাই ফ্যাসিস্টের পতন ডেকে এনেছে, কিন্তু আমাদের মনস্তত্ত্বের কতোখানি পরিবর্তন এনেছে? আমরা তো রয়ে গেছি সেই রদ্দিমার্কা অবস্থানে। এখনো রাজনীতিতে নারীকে ফ্রেইমিং করা হয় একটা অব্জেক্ট হিসেবে। নারীর রাজনৈতিক মেধার বদলে আমরা তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই আগ্রহী, সে নারী যদি দেখতে সুদর্শনা হন, তাহলে তো কথাই নেই! জুলাই এলেও, নারীর অবস্থানের কোন রদবদল দেখতে পাই না, বরং সেটা সংকুচিত হয়েছে।
সত্য বলতে আমরা প্রত্যেকেই একটা “হাসিনা” বয়ে নিয়ে যাই, যতদিন না পর্যন্ত এই হাসিনাকে মুছে ফেলতে না পারি, নতুন বন্দোবস্তের দেখা মেলা বহুদূরের রাস্তা।
সে কথা বেশ নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি
তাশরিক হাসান,পেশায় প্রকৌশলী।সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্ট।
 
									 
					 
