প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা আজ পৃথিবীকে একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত করেছে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা এবং ইন্টারনেটের বিস্তার আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরিহার্য। কিন্তু এখনও বাংলাদেশের বহু অঞ্চল রয়েছে যেখানে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা পৌঁছায়নি।
ঠিক এমন এক প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স চালু করেছে “স্টারলিংক”—একটি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা। এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করলে কী সুবিধা এবং কী ঝুঁকি তৈরি হতে পারে—তা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
স্টারলিংক কী ও কীভাবে কাজ করে?
স্টারলিংক হলো স্পেসএক্সের একটি প্রকল্প যা পৃথিবীর নিম্ন-কক্ষপথে (LEO) হাজার হাজার ছোট স্যাটেলাইট স্থাপন করে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করে। এই স্যাটেলাইটগুলো ভূপৃষ্ঠে থাকা একটি ছোট রিসিভার ডিভাইসের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ সরবরাহ করে। এটি প্রচলিত অপটিক ফাইবার বা মোবাইল টাওয়ারের পরিবর্তে আকাশপথেই তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে
স্টারলিংক হলো স্পেসএক্সের একটি প্রকল্প যা পৃথিবীর নিম্ন-কক্ষপথে (LEO) হাজার হাজার ছোট স্যাটেলাইট স্থাপন করে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করে। এই স্যাটেলাইটগুলো ভূপৃষ্ঠে থাকা একটি ছোট রিসিভার ডিভাইসের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ সরবরাহ করে। এটি প্রচলিত অপটিক ফাইবার বা মোবাইল টাওয়ারের পরিবর্তে আকাশপথেই তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে।
বাংলাদেশে স্টারলিংকের সম্ভাব্য সুবিধাসমূহ
১. প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার
বাংলাদেশের চরের স্কুল, পার্বত্য এলাকা বা সুন্দরবনের মতো দুর্গম অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। সেখানে স্টারলিংকের মাধ্যমে একাধিক ব্যবহারকারী একটি অ্যান্টেনা ব্যবহার করে সরাসরি উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজির (IIT) অধ্যাপক ড. শামসুল আরেফিন এ প্রসঙ্গে বলেন:
“আমাদের দেশের ডিজিটাল বিভাজন দূর করতে হলে বিকল্প প্রযুক্তির সন্ধান জরুরি। স্টারলিংক এই বিভাজন কমাতে একটি সম্ভাবনাময় সমাধান হতে পারে।”
২. দুর্যোগকালে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ
ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার সময় বিদ্যুৎ ও মোবাইল টাওয়ার নষ্ট হয়ে গেলে স্টারলিংক একমাত্র নির্ভরযোগ্য বিকল্প হতে পারে। এটি সরকার, এনজিও, উদ্ধারকারী দল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত তথ্য প্রবাহে সহায়ক হবে।
৩. শিক্ষাখাতে বিপ্লব
দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস বা ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ থেকে বঞ্চিত থাকে। স্টারলিংক ব্যবহার করে বিদ্যালয়গুলোতে সহজে অনলাইন লার্নিং চালু করা যাবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
৪. স্বাস্থ্যসেবায় টেলিমেডিসিন বিস্তার
গ্রামীণ ক্লিনিকে বা ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ইন্টারনেট থাকলে ঢাকা বা বড় শহরের চিকিৎসকের সঙ্গে ভিডিও কনসালটেশন সম্ভব হবে। এতে করে শহর-গ্রামের চিকিৎসাসেবার ফারাক কমে আসবে।
৫. সরকারি ও বেসরকারি প্রশাসনে দ্রুততা
উপজেলা পর্যায়ের ভূমি অফিস, থানা, উপজেলা পরিষদ ইত্যাদির ডিজিটালাইজেশন প্রকল্পগুলোতে স্টারলিংক যোগ হলে সরকারি কার্যক্রম হবে আরও গতিশীল ও স্বচ্ছ।
৬. পর্যটন খাতে উন্নয়ন
বান্দরবান, কাপ্তাই বা সেন্ট মার্টিনের মতো ইন্টারনেটবিচ্ছিন্ন পর্যটন এলাকায় স্টারলিংক ব্যবহারের মাধ্যমে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ও সংযুক্ত অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা যাবে। এতে দেশের পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা বাড়বে।
স্টারলিংকের সম্ভাব্য ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ
১. জাতীয় নিরাপত্তা ও সাইবার হুমকি
স্টারলিংক একটি বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণাধীন হওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের সাইবার নিরাপত্তা নীতিমালার বাইরে চলে যেতে পারে। এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার বা গোয়েন্দাগিরির ঝুঁকি থেকে যায়।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বিটিআরসি’র সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন:
“যেকোনো ইন্টারনেট প্রযুক্তি জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ। স্টারলিংকের মতো প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণহীন হলে তা ভবিষ্যতে ভয়াবহ নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করতে পারে।”
২. স্থানীয় ISPs-এর জন্য হুমকি
বাংলাদেশে প্রায় ২০০০-এর বেশি ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্টারলিংক যদি স্বল্পমূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট দেয়, তবে অনেক স্থানীয় প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে না। ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস ও বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য গড়ে উঠতে পারে।
৩. নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর দুর্বলতা
বর্তমানে বিটিআরসি স্থানীয় আইএসপি এবং মোবাইল অপারেটরদের কার্যক্রম কঠোরভাবে তদারকি করতে পারে। কিন্তু স্টারলিংকের মতো আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট সংস্থার ওপর একই মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা কঠিন। এটি ডেটা সুরক্ষা ও লাইসেন্সিংয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করে।
৪. খরচজনিত সমস্যা ও শ্রেণিবৈষম্য
বর্তমানে স্টারলিংক ব্যবহার করতে রিসিভার ডিভাইস বাবদ প্রায় ৪০০-৭০০ ডলার ও প্রতি মাসে ৯৯ ডলার গুনতে হয়। এই ব্যয় বাংলাদেশের গড় জনগণের জন্য অতি উচ্চমূল্যের। ফলে এটি শুধু উচ্চবিত্তের প্রযুক্তি হিসেবে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
৫. মহাকাশ বর্জ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি
স্টারলিংকের ১২,০০০-এর বেশি স্যাটেলাইট মহাকাশে ঘুরছে, এবং ভবিষ্যতে এটি ৪২,০০০ পর্যন্ত যেতে পারে। এত বিপুল সংখ্যক স্যাটেলাইট সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করে, যা আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
৬. জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় বিঘ্ন
স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলো সূর্যালোকে প্রতিফলিত হয়ে রাতের আকাশে “সাদা দাগ” তৈরি করে, যা টেলিস্কোপে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। ফলে জ্যোতির্বিদদের গবেষণা ব্যাহত হতে পারে।
নীতিনির্ধারণ ও প্রস্তুতির প্রস্তাবনা
স্টারলিংকের মতো বৈশ্বিক প্রযুক্তি যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তাহলে সেটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত নীতিমালা ও প্রস্তুতি। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলে দেয়, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে আগে থেকেই প্রয়োজনীয় নীতিকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি না থাকলে সুফলের পরিবর্তে নেতিবাচক প্রভাবও সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবেচনা করা উচিত:
১. বিস্তারিত নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি
প্রস্তাবিত ব্যবস্থা:
ক. পৃথক ‘স্যাটেলাইট ইন্টারনেট রেগুলেশন পলিসি’ গঠন
খ. লাইসেন্সিং ও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা যাচাই
গ. বিটিআরসি-এর অধীনে একটি ‘স্যাটেলাইট সেবা পরিবীক্ষণ সেল’ গঠণ
২. স্থানীয় অংশীদারিত্বের শর্ত সংযোজন
প্রস্তাবিত ব্যবস্থা:
ক. ব্যবসায়িক অনুমোদনের শর্ত হিসেবে অন্তত ২৫% স্থানীয় অংশীদারিত্ব বাধ্যতামূলক
খ. স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণাভিত্তিক চুক্তি
গ. দেশীয় হার্ডওয়্যার নির্মাতাদের সাথে উপকরণ উৎপাদনে সহযোগিতা
৩. সাইবার নিরাপত্তা আইন হালনাগাদ ও মানদণ্ড নির্ধারণ
প্রস্তাবিত ব্যবস্থা:
ক. স্টারলিংকের জন্য সুনির্দিষ্ট “ডেটা লোকালাইজেশন” শর্ত
খ. বিদেশি সেবা প্রদানকারীদের তথ্য নিরীক্ষায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অধিকার
গ. গ্রাহকের গোপনীয়তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন
৪. ভর্তুকি বা সহযোগিতামূলক প্যাকেজ প্রণয়ন
প্রস্তাবিত ব্যবস্থা:
ক. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও প্রশাসনিক ভবনের জন্য ভর্তুকি সুবিধা
খ. দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে বিশেষ সরকারি প্রকল্পের আওতায় স্টারলিংক সংযোগ প্রদান
গ. স্টারলিংক ব্যবহারকারী এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে করছাড় বা সহায়তা
পরিশেষে
স্টারলিংক প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রগতিকে এক নতুন মাত্রা দিতে পারে। তবে কোনো প্রযুক্তির একতরফা গ্রহণ নয়, প্রয়োজন তার সুফল ও ঝুঁকির পূর্ণ বিবেচনায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ পথ খুঁজে বের করা। সরকারের উচিত স্টারলিংকের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির স্বার্বভৌমত্ব বজায় রেখে একটি বাস্তবসম্মত ও ভবিষ্যতমুখী নীতি গ্রহণ করা।
মাহমুদ নেওয়াজ জয়, স্নাতক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়