২০১৩ সালে যখন সেক্যুলার, বামপন্থি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শাহবাগ হয় তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কলা ভবনে আমাদের ক্লাস চলে। বহু ছেলে-মেয়ে তখন শাহবাগ যায়। ছবি তোলে, খুব আবেগী কথা বলে।
শুরু থেকেই আমরা কয়েকজন বন্ধু সেই আন্দোলনে গেলাম না। কেন? আমরা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচার চাই, এই নিয়ে আমাদের মনে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু দ্বিধা ছিল পপুলার জাস্টিসের বিরুদ্ধে, দ্বিধা ছিল বাইনারি ঘৃণার বিরুদ্ধে, দ্বিধা ছিল বিরোধীদের দানব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তাদের হত্যাযজ্ঞ করে তোলার বিরুদ্ধে।
আমার বহু সেক্যুলার ও বামপন্থি বন্ধু এই নিয়ে আমার সাথে তর্কও করতো। আমি সমালোচনা করে অনুগল্প লিখতাম। তাতে দুই একজন কথা বলা বন্ধ করে দিল। অবস্থা এমন হল যে সেই সময় শাহবাগ নিয়ে কিছু বললেই তাকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে তার সমালোচনার গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকার করা হতো।
পরের ঘটনাটা ইতিহাস। শাহবাগ একই রকম কট্টরপন্থী আরেকটি আন্দোলন হেফাজত তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করলো। হেফাজত শাপলায় এসে অতি বিতর্কিত নারী বিদ্বেষী দাবি জানিয়ে আরেকটি শাহবাগ ধরনের আন্দোলন শুরু করলো। ঢাকা শহরে, রাতের অন্ধকারে হেফাজতের উপর পুলিশ অভিযান চালালো, বহু হেফাজত সদস্যকে হত্যা করা হলো। এই হত্যাকাণ্ড পরে অস্বীকার করা হলো, এমনকি আন্দোলন করতে আসা নাগরিকদের যে ধর্মীয় ট্যাগ দিয়ে হত্যা করা হয় তা নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করলো।
২০২৫-এ দ্বিতীয় শাহবাগ শুরু হয়। জামায়াত-শিবির, এনসিপি, হেফাজত ও কট্টরপন্থী ইসলামপন্থীরা সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে এই আন্দোলনে জড়ো হয়েছিলেন। এই আন্দোলনের পরিকল্পনা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই হচ্ছিল। অন্তত দুই মাস। ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল। বলতে দ্বিধা নেই যারা এই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাদের অনেকেই ইতোপূর্বের শাহবাগের সাথে সম্পৃক্ত এবং সেই শাহবাগকে ফ্যাসিবাদী ভূমিকায় আনতে বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা রেখেছেন।
তো এই নতুন শাহবাগে পুরনো শাহবাগের ভূত আমরা দেখতে পেয়েছি। পার্থক্য একটাই, ২০১৩-এর শাহবাগ আন্দোলনের উদ্যোক্তা সেক্যুলার কর্মী, বামপন্থি লোকজন ও আওয়ামী লীগ। সরকার সমর্থনে সেই আন্দোলন জনপ্রিয়তা পায়। ২০২৫-এর শাহবাগের উদ্যোক্তা জামায়াত-শিবির, এনসিপি, হেফাজত ও কট্টর ইসলামপন্থীরা, যার বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকায় রয়েছেন পিনাকী ভট্টাচার্য। কিন্তু উদ্দেশ্য এক, পপুলার জাস্টিস।
সাংবাদিক হাসান আল মাহমুদ লিখেছেন, “গণতন্ত্রকে হত্যা করার দায়ে অভিযুক্ত ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে গড়ে ওঠা গণজমায়েতে গণতন্ত্রকে কুফরি মনে করা, গণতান্ত্রিক রাজনীতি করা দলগুলোকে মুরতাদ আখ্যা দেয়া এবং সশস্ত্র পন্থায় বিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোও ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছে। তারা বিচ্ছিন্নভাবে নয় বরং দলবদ্ধভাবে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সেখানে অবস্থান করেছেন। গতকাল যমুনার সামনে যেমন ছিল, আজকে শাহবাগেও তারা আছে। এগুলো ডকুমেন্টেড। ফলে আওয়ামী প্রোপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। একটি গণতন্ত্র বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করার গণতান্ত্রিক জমায়েতে সরাসরি গণতন্ত্র বিরোধী আরেকটি গোষ্ঠী অংশ নিচ্ছে এটি নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টিং ঘটনা।”
২০১৩ সালে শাহবাগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন পিনাকী। সেই সময় জামায়াতের বিরুদ্ধে তার ছড়ানো সেক্যুলার ঘৃণা প্রবাদ প্রতিম। সেই আন্দোলনেরও এক ডিপ স্টেটের হাত ছিল, যাদের সাথে পিনাকী ও আর অনেকেই যোগ দেন। এই ডিপ ষ্টেট পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগকে সাহায্য করেছিল ও বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল
হাসান খুব সহজ করে ২০২৫-এর শাহবাগ আন্দোলনের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। “একটি গণতন্ত্র বিরোধী দলকে” অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে “নিষিদ্ধ করার গণতান্ত্রিক জমায়েতে” অর্থাৎ ২০২৫-এর শাহবাগ মঞ্চে “সরাসরি গণতন্ত্র বিরোধী আরেকটি গোষ্ঠী” অংশ নিচ্ছেন।
এই গণতন্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীর পেছনে কে রয়েছে? এর একটা প্রমাণ আমরা পাই পিনাকী ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক লেখায়। পিনাকী লিখেছেন “হামিদকে যাইতে দিছে ডিপ স্টেটের একটা অংশ। … এইটারে ঠেকাইছে ডিপ স্টেটের আরেক অংশ।” তিনি আরও লেখেন, “ডিপ স্টেটে প্রো-রেভ্যুলেশনারীদের কন্ট্রোল, কমান্ড আর ইফিশিয়েন্সি বাড়ছে।” হামিদের এই ঘটনাই তো শাহবাগ ২.০ এর প্রেক্ষাপট তৈরি করলো। তাই নয় কি?
২০১৩ সালে শাহবাগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন পিনাকী। সেই সময় জামায়াতের বিরুদ্ধে তার ছড়ানো সেক্যুলার ঘৃণা প্রবাদ প্রতিম। সেই আন্দোলনেরও এক ডিপ স্টেটের হাত ছিল, যাদের সাথে পিনাকী ও আর অনেকেই যোগ দেন। এই ডিপ ষ্টেট পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগকে সাহায্য করেছিল ও বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
কিছু প্রশ্ন খুব জরুরি এই প্রেক্ষিতে। এই ডিপ স্টেট কে বা কারা? এই ডিপ স্টেটের উদ্দেশ্য কী? এই ডিপ স্টেটের লক্ষ্য কী ইসলামপন্থীদের দিয়ে শাহবাগ ২.০ করিয়ে একটি ডানপন্থী বিপ্লবের সূচনা করা? যেই বিপ্লবের কথা ফরহাদ মজহার অনেক দিন থেকেই বলছেন? যেই বিপ্লবের রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকবেন জামায়াত, এনসিপি ও হেফাজত, আর সামরিক নেতৃত্বে থাকবে এই নব্য গড়ে ওঠা, পিনাকীর ভাষায় “প্রো রেভ্যুলেশনারী ডিপ স্টেট”।
তাহলে আমরা যে সকলের জন্য গণতন্ত্রের কথা বলছি, তার কী হবে? আমরা যে সকলের জন্য রাষ্ট্রের আলাপ করছি, তার কী হবে? আর কতদিন আমরা এই ডিপ স্টেটের খপ্পরে পড়ে গণতন্ত্রবিহীন থাকব? এই ডিপ স্টেটের পরের টার্গেট কে? বিএনপি? নাকি নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া?
গত আট মাসে আমরা দেখলাম জামায়াত নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধাপরাধ বিচার সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছাকৃতভাবে আওয়ামী লীগের বিচারে গড়িমসি করলো। সরকারের নাকের ডগায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা, যারা জুলাই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল, তারা নিরাপদে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল।
আবার সেই সরকারের সমর্থক ছাত্র অংশ জামায়াত ও হেফাজতের সমর্থনে এক নতুন আন্দোলন শুরু করলেন, সহজ পথে (সরকারি আদেশে) আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে। পপুলার জাস্টিস তাদের ডিমান্ড। নৈতিক রাজনীতির আলাপ নেই, সব কিছু গায়ের জোরে করতে হবে। সমালোচনা করলেই সেই জুলাই চেতনার শত্রু। এ কেমন আলাপ?
প্রশ্ন থেকে যায় এই ন্যারেটিভ বানানোর পেছনে “প্রো রেভ্যুলেশনারী ডিপ স্টেট” এর কী লাভ? আসলেই কি উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, না কি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধের আবেগ কাজে লাগিয়ে পিনাকীর ভাষায় প্রো-রেভ্যুলেশনারী ডিপ স্টেটের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা? আমাদের কপালে যে জলদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরত যাওয়া নেই তা দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে।
আসিফ বিন আলী একজন শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক