ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) আরও বেড়ে যায়, যখন পাকিস্তান জানায় — যদি ভারত প্রাণঘাতী এক জঙ্গি হামলার বদলা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর পানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে তারা সেটাকে “যুদ্ধ ঘোষণা” বলে মনে করবে।
পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির জরুরি বৈঠকের পর, সরকার ভারতীয় সিদ্ধান্তের জবাবে কয়েকটি পদক্ষেপের ঘোষণা দেয় — যেমন: পাকিস্তানের আকাশসীমা ভারতের বিমানগুলোর জন্য বন্ধ করে দেওয়া, ইসলামাবাদে ভারতের কূটনীতিকদের সংখ্যা কমানো, আর ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া।
ভারত সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো গোষ্ঠীকে মঙ্গলবারের হামলার জন্য দায়ী করেনি, যা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের এক জনপ্রিয় পর্যটন এলাকায় ঘটেছিল। তবে বুধবার ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়, যার মধ্যে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি পানি চুক্তি (সিন্ধু পানি চুক্তি) বাতিলের ইঙ্গিত।
পাকিস্তান বৃহস্পতিবার ভারতের এসব পদক্ষেপকে “একপাক্ষিক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বেআইনি” বলে নিন্দা জানায়। পাকিস্তান বলছে, তারা হামলার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত না।
বিশেষ করে পানি চুক্তি নিয়ে পাকিস্তান কড়া প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা জানায়, ভারত যদি নদীগুলোর প্রবাহ আটকে দেয়, তাহলে তা কঠিনভাবে প্রতিহত করা হবে। পাকিস্তানের কৃষি ব্যবস্থার প্রায় ৯০% নির্ভর করে ভারত থেকে আসা সিন্ধু নদী এবং তার শাখানদীগুলোর পানির ওপর।
১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তিকে এতদিন দুই দেশের মধ্যে একটিমাত্র স্থায়ী শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। যুদ্ধের সময়ও এই চুক্তি টিকে ছিল। এই চুক্তির ভেঙে পড়া এখন অনেক বড় কৌশলগত সংকট তৈরি করবে
১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তিকে এতদিন দুই দেশের মধ্যে একটিমাত্র স্থায়ী শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। যুদ্ধের সময়ও এই চুক্তি টিকে ছিল। এই চুক্তির ভেঙে পড়া এখন অনেক বড় কৌশলগত সংকট তৈরি করবে।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকের আগ পর্যন্ত পাকিস্তান অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিল। যদিও মঙ্গলবার কাশ্মীরে দুই ডজনের বেশি ভারতীয় বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল, তারপরও তারা উত্তেজনা বাড়াতে চায়নি।
কিন্তু পাকিস্তানের মানুষ দেখছে, ভারতীয় নেতারা সামরিক প্রতিশোধের হুমকি দিচ্ছেন, এবং টেলিভিশনগুলো যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে নানা আলোচনা করছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন — দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে এর ফলাফল খুবই ভয়ঙ্কর হতে পারে।
পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক নাজম উস সাকিব বলেন, “আগামী কয়েক সপ্তাহ বা মাসে উত্তেজনা বাড়বে এবং এই ভঙ্গুর অঞ্চল আরও অস্থির হতে পারে।”
কাশ্মীর নিয়ে এই টানাপোড়েন নতুন কিছু না। ভারত ও পাকিস্তান আগে একাধিকবার কাশ্মীর ইস্যুতে যুদ্ধে জড়িয়েছে।
ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্রুত পাকিস্তানকে দায়ী করে সংবাদ প্রচার শুরু করে। পাকিস্তান পাল্টা অভিযোগ করে বলেযে, ভারত নিজের নিরাপত্তা ব্যর্থতার দায় এড়াতে পাকিস্তানকে দোষ দিচ্ছে।
পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও বলেন, পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ভারতবিরোধী জঙ্গিদের সাহায্য করে। ভারত বলছে, এসব জঙ্গি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে হামলা চালায়।
পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে — তারা বলছে, ভারত পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে সহায়তা করে। সম্প্রতি বেলুচিস্তানে হামলার ঘটনা বেড়েছে, যেমন ট্রেন ছিনতাইয়ের ঘটনা। পাকিস্তান দাবি করছে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও ভারতের মদদপুষ্ট হামলা হয়েছে।
কাশ্মীরে সর্বশেষ বড় হামলা হয়েছিল ২০১৯ সালে, যেখানে ডজনখানেক ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়। তারপর ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়, যা যুদ্ধের কাছাকাছি পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।
কিছু বিশ্লেষক বলছেন, এবারের সংঘাত ২০১৯ সালের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী বলেন, “এবারের উত্তেজনা আগের চেয়েও বড় হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারত এই হামলার সুযোগ নিচ্ছে যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করে এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাপ সামাল দিতে পারে।”
বুধবার পর্যন্ত পাকিস্তান বলছিল, তারা ভারতের কোনো সেনা মোতায়েনের লক্ষণ দেখেনি। তবে সীমান্তে সেনারা সতর্ক রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একজন পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, পাকিস্তান প্রতিরোধে প্রস্তুত থাকবে, তবে সরাসরি উত্তেজনা বাড়াতে চাইবে না।
কিছু বিশ্লেষক এমনও বলছেন, হামলাটা ভারত নিজেরাই সাজিয়েছে, যেহেতু সেটা মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের ভারত সফরের সময় হয়েছে।
পাকিস্তানের জিও নিউজে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ সাঈদ মিনহাস মজা করে বলেন, “২০১৯ সালে আমরা ভারতীয় পাইলট অভিনন্দনকে চা খাইয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এবার যদি আবার আসে, তাহলে তাকে চায়ের সঙ্গে বিস্কিটও দেবো!”
বর্তমান উত্তেজনা ২০১৯ সালের ঘটনার স্মৃতি আবার ফিরিয়ে এনেছে। সেবার পুলওয়ামা হামলার পর ভারত পাকিস্তানের ওপর বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে এবং পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে আটক করে। পরে শান্তির বার্তার দৃষ্টান্তস্বরূপ তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন হামলার দায় কেউ খোলাখুলি স্বীকার করেনি। যারা দায় স্বীকার করেছে, তাদের পরিচয় স্পষ্ট না। হামলার শিকারও ছিল বেসামরিক সাধারণ মানুষ, নিরাপত্তা বাহিনী নয়।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখনো এ বিষয়ে সরাসরি কোনো বিবৃতি দেয়নি। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করেছে এবং হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন — ২০১৯ সালের মতো এবার ভাগ্য সহায় নাও হতে পারে।
সাবেক তথ্যমন্ত্রী মুর্তজা সোলাংগি বলেন, “গতবার সৌভাগ্যক্রমে যুদ্ধ এড়ানো গিয়েছিল। এবার অবস্থা আরও ভয়াবহ।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান অবস্থা, উত্তপ্ত ভারতীয় মিডিয়া — সবকিছু মিলিয়ে মোদির জন্য শান্ত থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ভারত যদি উন্মাদনা বন্ধ না করে, তাহলে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক আসফান্দিয়ার মীর বলেন, “আগে দুই দেশের মধ্যে গোপন কূটনৈতিক যোগাযোগ ছিল, যা বড় বিপর্যয় ঠেকাতে সাহায্য করত। এখন সেই ব্যবস্থাও নেই। তাই ভুল বোঝাবুঝি বা ভুল সিদ্ধান্তের ঝুঁকি আরও বেড়েছে।”
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন
Leave A Reply