অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ সদস্য বিশিষ্ট সংস্কার কমিশন কর্তৃক সম্প্রতি নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে, যা দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একদিকে এটিকে নারীর ক্ষমতায়নের একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, অন্যদিকে এটি ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচিতও হয়েছে। এই প্রস্তাবনার আওতায় নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, উত্তরাধিকার, পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় বিধান সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ এসেছে। এই প্রস্তাবনাগুলোর কিছু ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে, তেমনি বিতর্কও তৈরি হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। তাই এ বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন প্রয়োজন।
সংস্কার প্রস্তাবের কিছু উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট
১. রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি
সংস্কার প্রস্তাবনায় স্থানীয় সরকারে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন পদ্ধতির পরিবর্তন করে, সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার পরিষদের মোট ওয়ার্ডের এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রার্থীদের জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা বাড়াবে। জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রেও সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের সুপারিশ রয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষে নারীদের জন্য ৩০% আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব তোলা হয়েছে, যেখানে নাগরিক সমাজ, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পেশাজীবী ও পিছিয়ে পড়া নারী প্রতিনিধিরা জায়গা পাবেন।
২. উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইনে সমতা
কমিশনের সুপারিশমালার ২৫ পৃষ্ঠায় মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে নারী-পুরুষের সমান অংশ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী নারী-পুরুষের অংশের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, যা এই প্রস্তাব অনুযায়ী পরিবর্তনের আওতায় পড়বে। এছাড়া, সব ধর্মের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব এসেছে, যেখানে বিবাহ, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি একই নিয়মে চলবে। কমিশনের সুপারিশমালার ৯ম পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সকল ধর্মের জন্য একটি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সবাইকে ধর্মীয় পারিবারিক বিধান থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোতে আনা হবে।
৩. আন্তর্জাতিক সনদ CEDAW বাস্তবায়নের দাবি
নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ গৃহীত CEDAW (Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women) সনদ অনুসারে নারী-পুরুষের মধ্যে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী আইন ও নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। এই আন্তর্জাতিক সনদে বর্ণিত মূল নীতিগুলোর মধ্যে রয়েছে: বিবাহ ও পারিবারিক জীবনে সমান অধিকার, সম্পত্তিতে সমান হিস্যা, অভিভাবকত্বে সমান অংশীদারিত্ব এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে সমান সুযোগ। নারী কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, CEDAW বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান পারিবারিক আইন, উত্তরাধিকার আইন এবং ধর্মীয় ভিত্তিক বিধানের কিছু অংশ পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এটি বাস্তবায়নের অর্থ—ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামোর কিছু প্রচলিত নিয়ম বাতিল হওয়া।
৪. যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া
নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবের ১২শ অধ্যায়ে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়, যৌনকর্মীরাও সমাজের একটি বাস্তব অংশ, এবং তাদের শ্রমকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের মৌলিক অধিকার যেমন স্বাস্থ্য সেবা, নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
প্রস্তাবনাগুলোর পক্ষে যুক্তি
আধুনিক বিশ্বে নারী আর কেবল ঘরকেন্দ্রিক কোনো সত্তা নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে তার অংশগ্রহণ একটি স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় বিষয়। নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যে কোনো দেশের টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত। উন্নয়ন তখনই টেকসই হবে, যখন নারী ও পুরুষ উভয়েই সমানভাবে সমাজ গঠনে অংশ নিতে পারবে।
বাংলাদেশে নারীরা যদিও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবু এখনো তারা নানা সামাজিক বাধা, বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার। বিশেষ করে, গ্রামীণ সমাজে নারীর সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ সীমিত, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই বললেই চলে এবং পারিবারিক ও ধর্মীয় কাঠামো অনেক ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটে একটি সময়োপযোগী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আইনি কাঠামো নারীর প্রকৃত উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। আইনের মাধ্যমে নারীর অধিকার সুরক্ষিত হলে, তারা শিক্ষা ও অর্থনীতিতে আরও স্বাধীনভাবে অংশ নিতে পারবে এবং সমাজে সমান মর্যাদায় বাঁচতে পারবে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমান ব্যবস্থায় নারীকে প্রান্তিক করে রাখা হয় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যার ভুল প্রয়োগের মাধ্যমে। তাই কাঠামোগত সংস্কার ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজে নারীর অবস্থা বদলে দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
সেক্ষেত্রে আলোচ্য সংস্কার প্রস্তাবগুলো নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। তবে এই প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনারও সৃষ্টি হয়েছে যা দৃষ্টিগোচর করা প্রয়োজন।
প্রস্তাবনাগুলোর বিরুদ্ধে সমালোচনা
১. ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক
সবচেয়ে প্রবল সমালোচনা এসেছে ধর্মীয় গোষ্ঠী থেকে। ইসলামে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধান সুস্পষ্টভাবে আল-কুরআনের সূরা আন-নিসা-তে নির্ধারিত আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একজন পুত্রের ভাগ দুটি কন্যার সমান—অর্থাৎ, পুত্র পায় দ্বিগুণ। এই হিস্যা কেবল সামাজিক প্রথা নয়, বরং মুসলমানদের জন্য একটি ঈমানি বিশ্বাস ও ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ। ইসলামী স্কলারদের মতে, এসব বিধান আল্লাহর নির্ধারিত আইন; এগুলো পরিবর্তন করার কোনো মানবিক অধিকার নেই।
একইভাবে, অভিন্ন পারিবারিক আইন (Uniform Family Code) বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল ধর্মাবলম্বীর জন্য একক আইন চালু করার প্রস্তাবও ইসলামী পারিবারিক আইনের স্বাধীন অস্তিত্বে হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন তারা।
২. CEDAW বাস্তবায়ন – ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত
CEDAW-এর বেশ কিছু ধারায় বিয়ে, পরিবার, অভিভাবকত্ব ইত্যাদিকে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। ফলে এই সংস্কার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও কিছু আইনজ্ঞরা দাবি করছেন, CEDAW-এর অনেক ধারা ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে, এতে “ওয়ালী” (নারীর অভিভাবক), “মাহরাম” (যার সঙ্গে বিবাহ হারাম), এবং “তালাক” সংক্রান্ত ইসলামী বিধানকে বৈষম্যমূলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের মৌলিক ভিত্তির পরিপন্থী। ফলে, এই সনদ বাস্তবায়নের অর্থ হবে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পারিবারিক কাঠামোর কিছু প্রচলিত রীতি বাতিল করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো চাপিয়ে দেওয়া, যা দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
এছাড়াও সমালোচকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় বাস্তবতা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি, নইলে তা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর জাতিসংঘের CEDAW সনদে স্বাক্ষর করে এবং তা অনুসমর্থন করে। এটি ছিল নারী অধিকার ও বৈষম্য দূরীকরণে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি।
তবে, সনদ অনুসমর্থনের সময় বাংলাদেশ সরকার কিছু নির্দিষ্ট ধারার ক্ষেত্রে “সংরক্ষণ (reservation)” ঘোষণা করেছিল। এর মানে হচ্ছে, এসব ধারার সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান ধর্মীয় বা সামাজিক বিধান সাংঘর্ষিক বিবেচিত হওয়ায় সরকার এগুলো মানতে বাধ্য নয় বলে জানিয়েছিল। যেমন, ধারা ২ (f) – যেখানে বলা হয়েছে, সমস্ত প্রথা, রীতি ও আইন পরিবর্তন করতে হবে যদি সেগুলো নারীকে বৈষম্যের মুখে ফেলে; এটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল কারণ বাংলাদেশের দৃষ্টিতে, এটি ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক সম্প্রীতি একসঙ্গে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান, যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক ও মানবাধিকারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিতভাবে বিবেচনায় আসবে
অনেক আন্তর্জাতিক চাপ এবং নারীবাদী সংগঠনের দীর্ঘদিনের দাবির পর, বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে এসব সংরক্ষণ আংশিকভাবে প্রত্যাহার করে। তবে এখনো ধারা ২ এবং ১৬(১)(c), (d), (g) ধারায় সংরক্ষণ বহাল আছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি CEDAW বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়—বিশেষ করে, যেখানে বিষয়টি ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়।
সরকার এখনো এই সংবেদনশীল বিষয়ে “ধর্মীয় আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে” বলে জানিয়েছে। নারী কমিশনের সাম্প্রতিক সংস্কার প্রস্তাব CEDAW-এর আলোকে যেসব পরিবর্তনের কথা বলছে, সেগুলোর মধ্যে এই সংরক্ষিত ধারাগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের সুপারিশ রয়েছে। এবং এখানেই সবচেয়ে বড় বিতর্কের জন্ম হয়েছে—কারণ এই ধারা বাস্তবায়ন করলে তা ইসলামী উত্তরাধিকার আইন বা পারিবারিক আইনের কিছু অংশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
৩. নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক পার্থক্য অস্বীকার
কমিশনের সুপারিশে নারী-পুরুষকে অভিন্ন দায়িত্বে রাখার কথা বলা হয়েছে, যেখানে ইসলামে ভূমিকার ভিত্তিতে আলাদা দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন, পুরুষকে ভরণপোষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, নারীকে মাতৃত্ব ও সন্তান পালনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এতে করে পরিবারের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। অনেক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, পশ্চিমা ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় প্রয়োগযোগ্য নয়।
ধর্মীয় স্কলারদের মতে, এতে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঝুঁকি রয়েছে এবং এটি “সেকুলার আইন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা” হিসেবে সমালোচিত।
পর্যালোচনা
নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবে এমন বেশ কিছু পয়েন্ট যোগ করা হয়েছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সমাজে অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের অবস্থানকে শক্ত করতে সাহায্য করবে। যেমন যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত হলে যৌনকর্মীরা সহিংসতা, নিপীড়ন ও মানবপাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমবে। এতে তাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে এবং মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে। এছাড়া তাদের আর্থিক -সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সন্তানদের সুশিক্ষা ইত্যাদি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ও ভোটাধিকারের অধিকার দেওয়া হবে যা তাদের সমাজের মূলধারায় যুক্ত হতে সহায়ক হবে।
রাষ্ট্র বনাম বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (২০০০) মামলার রায়ে পেশাদার যৌনকর্মকে বৈধতা দিয়ে আরো বলা হয় যে, জীবন ও জীবিকার স্বাধীনতা এবং আইনের সুরক্ষার সাংবিধানিক অধিকার যৌনকর্মীদের জন্যেও প্রযোজ্য এবং তাদের জীবিকার অধিকার হরণ করা বেআইনি। অথচ ২৫ বছরেও এই রায় বাস্তবায়ন হয়নি। তাই এই সংস্কার প্রস্তাব সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বহু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে। সংবিধানে স্পষ্টভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের সামনে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার রয়েছে। এই বাস্তবতায়, একটি একক, সর্বজনীন পারিবারিক আইন কাঠামো (Uniform Family Code) প্রণয়ন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা পারিবারিক আইন রয়েছে—যেমন মুসলিম পারিবারিক আইন, হিন্দু পারিবারিক আইন, খ্রিস্টান ম্যারেজ অ্যাক্ট ইত্যাদি। কিন্তু এই ধর্মভিত্তিক আইনের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নারী, সংখ্যালঘু এবং ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা সমস্যার সম্মুখীন হন। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু নারীর বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার প্রায় অনুপস্থিত, যা তাকে দীর্ঘদিনের নিপীড়নের শিকার করতেও বাধ্য করে অথবা, ভিন্ন ধর্মের দম্পতিদের জন্য আইনী জটিলতা তৈরি করে।
এর একটি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি রাষ্ট্র একটি স্বেচ্ছা-ভিত্তিক একক পারিবারিক আইন কাঠামো প্রবর্তন করে, তাহলে কেউ চাইলে তার ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন অনুসরণ করতে পারবে, আবার কেউ চাইলে রাষ্ট্রীয় সাধারণ আইনের আশ্রয় নিতে পারবে। এটি কাউকে ধর্ম পালনে বাধা দেবে না, বরং নাগরিকের পছন্দের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করবে।
এছাড়া, অনেক ধর্মীয় আইন যুগের পর যুগ অপরিবর্তিত থেকে গেছে, যেখানে সমাজ ও বাস্তবতা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ফলে, অনেক সময় ধর্মীয় আইনের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা সমাজে বৈষম্য তৈরি করে। একক আইন কাঠামো একটি সমতা ভিত্তিক ও মানবাধিকার সম্মত আইনি বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে, যেখানে ধর্মীয় ও সাংবিধানিক মূল্যবোধের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এটি বাধ্যতামূলক নয়, বরং “প্যারালাল অপশন” হিসেবে থাকবে। এতে করে কেউ ধর্মীয় আইন মেনে চলুক বা রাষ্ট্রীয় আইন গ্রহণ করুক, উভয়ের সম্মান ও অধিকার রক্ষা পাবে।
প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এই আইনটি প্রাথমিকভাবে স্বেচ্ছা ভিত্তিক (optional) থাকবে। অর্থাৎ, কোনো নাগরিক চাইলে তার ধর্মীয় আইন অনুযায়ী পারিবারিক বিষয় নিষ্পত্তি করতে পারবে, আবার চাইলে এই নতুন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় আইন অনুসরণ করতে পারবে। এই প্রস্তাবনা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন তা কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া না হয়, বরং মানুষ তার ব্যক্তিগত পছন্দ ও অধিকার অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে, একইসঙ্গে প্রস্তাবে দীর্ঘমেয়াদে একটি “সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক আইন কাঠামো গঠনের” সুপারিশও রয়েছে। অর্থাৎ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আইনটি এমন এক অবস্থানে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, যেখানে এটি সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে উঠবে। এভাবে, একটি অভিন্ন আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হবে, যাতে ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য না থাকে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক ন্যায়বিচারের দিক থেকে ইতিবাচক হলেও, বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় সংবেদনশীল বিষয়। কারণ, পারিবারিক আইন শুধু আইনি বিষয় নয়—এটি ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও জীবনাচারের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাই আমার মনে হয়, এটি একটি অপশনাল চয়েজ হিসেবে থাকলেই ভালো, কিন্তু বাধ্যতামূলক হিসেবে কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া সমীচিন হবে না। নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক সম্প্রীতি একসঙ্গে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান, যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক ও মানবাধিকারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিতভাবে বিবেচনায় আসবে। নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব একটি সাহসী প্রচেষ্টা, যা সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আমরা আশাবাদী।
অপরাজিতা দেবনাথ, অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট
Leave A Reply