Tag: Reform

  • নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব: সম্ভাবনা ও সমালোচনা

    নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব: সম্ভাবনা ও সমালোচনা

    অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ সদস্য বিশিষ্ট সংস্কার কমিশন কর্তৃক সম্প্রতি নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে, যা দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একদিকে এটিকে নারীর ক্ষমতায়নের একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, অন্যদিকে এটি ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচিতও হয়েছে। এই প্রস্তাবনার আওতায় নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, উত্তরাধিকার, পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় বিধান সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ এসেছে। এই প্রস্তাবনাগুলোর কিছু ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে, তেমনি বিতর্কও তৈরি হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। তাই এ বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন প্রয়োজন।

    সংস্কার প্রস্তাবের কিছু উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট

    ১. রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি

    সংস্কার প্রস্তাবনায় স্থানীয় সরকারে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন পদ্ধতির পরিবর্তন করে, সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার পরিষদের মোট ওয়ার্ডের এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রার্থীদের জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা বাড়াবে। জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রেও সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের সুপারিশ রয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষে নারীদের জন্য ৩০% আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব তোলা হয়েছে, যেখানে নাগরিক সমাজ, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পেশাজীবী ও পিছিয়ে পড়া নারী প্রতিনিধিরা জায়গা পাবেন।

    ২. উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইনে সমতা

    কমিশনের সুপারিশমালার ২৫ পৃষ্ঠায় মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে নারী-পুরুষের সমান অংশ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী নারী-পুরুষের অংশের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, যা এই প্রস্তাব অনুযায়ী পরিবর্তনের আওতায় পড়বে। এছাড়া, সব ধর্মের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব এসেছে, যেখানে বিবাহ, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি একই নিয়মে চলবে। কমিশনের সুপারিশমালার ৯ম পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সকল ধর্মের জন্য একটি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সবাইকে ধর্মীয় পারিবারিক বিধান থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোতে আনা হবে। 

    ৩. আন্তর্জাতিক সনদ CEDAW বাস্তবায়নের দাবি

    নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ গৃহীত CEDAW (Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women) সনদ অনুসারে নারী-পুরুষের মধ্যে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী আইন ও নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। এই আন্তর্জাতিক সনদে বর্ণিত মূল নীতিগুলোর মধ্যে রয়েছে: বিবাহ ও পারিবারিক জীবনে সমান অধিকার, সম্পত্তিতে সমান হিস্যা, অভিভাবকত্বে সমান অংশীদারিত্ব এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে সমান সুযোগ। নারী কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, CEDAW বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান পারিবারিক আইন, উত্তরাধিকার আইন এবং ধর্মীয় ভিত্তিক বিধানের কিছু অংশ পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এটি বাস্তবায়নের অর্থ—ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামোর কিছু প্রচলিত নিয়ম বাতিল হওয়া।

    ৪. যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া

    নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবের ১২শ অধ্যায়ে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়, যৌনকর্মীরাও সমাজের একটি বাস্তব অংশ, এবং তাদের শ্রমকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের মৌলিক অধিকার যেমন স্বাস্থ্য সেবা, নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

    প্রস্তাবনাগুলোর পক্ষে যুক্তি

    আধুনিক বিশ্বে নারী আর কেবল ঘরকেন্দ্রিক কোনো সত্তা নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে তার অংশগ্রহণ একটি স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় বিষয়। নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যে কোনো দেশের টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত। উন্নয়ন তখনই টেকসই হবে, যখন নারী ও পুরুষ উভয়েই সমানভাবে সমাজ গঠনে অংশ নিতে পারবে।

    বাংলাদেশে নারীরা যদিও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবু এখনো তারা নানা সামাজিক বাধা, বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার। বিশেষ করে, গ্রামীণ সমাজে নারীর সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ সীমিত, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই বললেই চলে এবং পারিবারিক ও ধর্মীয় কাঠামো অনেক ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

    এই প্রেক্ষাপটে একটি সময়োপযোগী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আইনি কাঠামো নারীর প্রকৃত উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। আইনের মাধ্যমে নারীর অধিকার সুরক্ষিত হলে, তারা শিক্ষা ও অর্থনীতিতে আরও স্বাধীনভাবে অংশ নিতে পারবে এবং সমাজে সমান মর্যাদায় বাঁচতে পারবে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমান ব্যবস্থায় নারীকে প্রান্তিক করে রাখা হয় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যার ভুল প্রয়োগের মাধ্যমে। তাই কাঠামোগত সংস্কার ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজে নারীর অবস্থা বদলে দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

    সেক্ষেত্রে আলোচ্য সংস্কার প্রস্তাবগুলো নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। তবে এই প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে  ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনারও সৃষ্টি হয়েছে যা দৃষ্টিগোচর করা প্রয়োজন।

    প্রস্তাবনাগুলোর বিরুদ্ধে সমালোচনা

    ১. ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

    সবচেয়ে প্রবল সমালোচনা এসেছে ধর্মীয় গোষ্ঠী থেকে। ইসলামে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধান সুস্পষ্টভাবে আল-কুরআনের সূরা আন-নিসা-তে নির্ধারিত আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একজন পুত্রের ভাগ দুটি কন্যার সমান—অর্থাৎ, পুত্র পায় দ্বিগুণ। এই হিস্যা কেবল সামাজিক প্রথা নয়, বরং মুসলমানদের জন্য একটি ঈমানি বিশ্বাস ও ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ। ইসলামী স্কলারদের মতে, এসব বিধান আল্লাহর নির্ধারিত আইন; এগুলো পরিবর্তন করার কোনো মানবিক অধিকার নেই।

    একইভাবে, অভিন্ন পারিবারিক আইন (Uniform Family Code) বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল ধর্মাবলম্বীর জন্য একক আইন চালু করার প্রস্তাবও ইসলামী পারিবারিক আইনের স্বাধীন অস্তিত্বে হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন তারা।

    ২. CEDAW বাস্তবায়ন – ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত

    CEDAW-এর বেশ কিছু ধারায় বিয়ে, পরিবার, অভিভাবকত্ব ইত্যাদিকে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। ফলে এই সংস্কার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও কিছু আইনজ্ঞরা দাবি করছেন, CEDAW-এর অনেক ধারা ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে, এতে “ওয়ালী” (নারীর অভিভাবক), “মাহরাম” (যার সঙ্গে বিবাহ হারাম), এবং “তালাক” সংক্রান্ত ইসলামী বিধানকে বৈষম্যমূলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের মৌলিক ভিত্তির পরিপন্থী। ফলে, এই সনদ বাস্তবায়নের অর্থ হবে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পারিবারিক কাঠামোর কিছু প্রচলিত রীতি বাতিল করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো চাপিয়ে দেওয়া, যা দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

    এছাড়াও সমালোচকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় বাস্তবতা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি, নইলে তা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে।

    প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর জাতিসংঘের CEDAW সনদে স্বাক্ষর করে এবং তা অনুসমর্থন করে। এটি ছিল নারী অধিকার ও বৈষম্য দূরীকরণে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি।

    তবে, সনদ অনুসমর্থনের সময় বাংলাদেশ সরকার কিছু নির্দিষ্ট ধারার ক্ষেত্রে “সংরক্ষণ (reservation)” ঘোষণা করেছিল। এর মানে হচ্ছে, এসব ধারার সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান ধর্মীয় বা সামাজিক বিধান সাংঘর্ষিক বিবেচিত হওয়ায় সরকার এগুলো মানতে বাধ্য নয় বলে জানিয়েছিল। যেমন, ধারা ২ (f) – যেখানে বলা হয়েছে, সমস্ত প্রথা, রীতি ও আইন পরিবর্তন করতে হবে যদি সেগুলো নারীকে বৈষম্যের মুখে ফেলে; এটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল কারণ বাংলাদেশের দৃষ্টিতে, এটি ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

    নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক সম্প্রীতি একসঙ্গে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান, যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক ও মানবাধিকারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিতভাবে বিবেচনায় আসবে

    অনেক আন্তর্জাতিক চাপ এবং নারীবাদী সংগঠনের দীর্ঘদিনের দাবির পর, বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে এসব সংরক্ষণ আংশিকভাবে প্রত্যাহার করে। তবে এখনো ধারা ২ এবং ১৬(১)(c), (d), (g) ধারায় সংরক্ষণ বহাল আছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি CEDAW বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়—বিশেষ করে, যেখানে বিষয়টি ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়।

    সরকার এখনো এই সংবেদনশীল বিষয়ে “ধর্মীয় আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে” বলে জানিয়েছে। নারী কমিশনের সাম্প্রতিক সংস্কার প্রস্তাব CEDAW-এর আলোকে যেসব পরিবর্তনের কথা বলছে, সেগুলোর মধ্যে এই সংরক্ষিত ধারাগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের সুপারিশ রয়েছে। এবং এখানেই সবচেয়ে বড় বিতর্কের জন্ম হয়েছে—কারণ এই ধারা বাস্তবায়ন করলে তা ইসলামী উত্তরাধিকার আইন বা পারিবারিক আইনের কিছু অংশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

    ৩. নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক পার্থক্য অস্বীকার

    কমিশনের সুপারিশে নারী-পুরুষকে অভিন্ন দায়িত্বে রাখার কথা বলা হয়েছে, যেখানে ইসলামে ভূমিকার ভিত্তিতে আলাদা দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন, পুরুষকে ভরণপোষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, নারীকে মাতৃত্ব ও সন্তান পালনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।  সমালোচকরা বলছেন, এতে করে পরিবারের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। অনেক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, পশ্চিমা ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় প্রয়োগযোগ্য নয়।

    ধর্মীয় স্কলারদের মতে, এতে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঝুঁকি রয়েছে এবং এটি “সেকুলার আইন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা” হিসেবে সমালোচিত।

    পর্যালোচনা

    নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবে এমন বেশ কিছু পয়েন্ট যোগ করা হয়েছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সমাজে অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের অবস্থানকে শক্ত করতে সাহায্য করবে। যেমন যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত হলে যৌনকর্মীরা সহিংসতা, নিপীড়ন ও মানবপাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমবে। এতে তাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে এবং মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে। এছাড়া তাদের আর্থিক -সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সন্তানদের সুশিক্ষা ইত্যাদি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ও ভোটাধিকারের অধিকার দেওয়া হবে যা তাদের সমাজের মূলধারায় যুক্ত হতে সহায়ক হবে।

    রাষ্ট্র বনাম বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (২০০০) মামলার রায়ে পেশাদার যৌনকর্মকে বৈধতা দিয়ে আরো বলা হয় যে, জীবন ও জীবিকার স্বাধীনতা এবং আইনের সুরক্ষার সাংবিধানিক অধিকার যৌনকর্মীদের জন্যেও প্রযোজ্য এবং তাদের জীবিকার অধিকার হরণ করা বেআইনি। অথচ ২৫ বছরেও এই রায় বাস্তবায়ন হয়নি। তাই এই সংস্কার প্রস্তাব সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

    অন্যদিকে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বহু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে। সংবিধানে স্পষ্টভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের সামনে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার রয়েছে। এই বাস্তবতায়, একটি একক, সর্বজনীন পারিবারিক আইন কাঠামো (Uniform Family Code) প্রণয়ন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

    বর্তমানে প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা পারিবারিক আইন রয়েছে—যেমন মুসলিম পারিবারিক আইন, হিন্দু পারিবারিক আইন, খ্রিস্টান ম্যারেজ অ্যাক্ট ইত্যাদি। কিন্তু এই ধর্মভিত্তিক আইনের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নারী, সংখ্যালঘু এবং ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা সমস্যার সম্মুখীন হন। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু নারীর বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার প্রায় অনুপস্থিত, যা তাকে দীর্ঘদিনের নিপীড়নের শিকার করতেও বাধ্য করে অথবা, ভিন্ন ধর্মের দম্পতিদের জন্য আইনী জটিলতা তৈরি করে।

    এর একটি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি রাষ্ট্র একটি স্বেচ্ছা-ভিত্তিক একক পারিবারিক আইন কাঠামো প্রবর্তন করে, তাহলে কেউ চাইলে তার ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন অনুসরণ করতে পারবে, আবার কেউ চাইলে রাষ্ট্রীয় সাধারণ আইনের আশ্রয় নিতে পারবে। এটি কাউকে ধর্ম পালনে বাধা দেবে না, বরং নাগরিকের পছন্দের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করবে।

    এছাড়া, অনেক ধর্মীয় আইন যুগের পর যুগ অপরিবর্তিত থেকে গেছে, যেখানে সমাজ ও বাস্তবতা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ফলে, অনেক সময় ধর্মীয় আইনের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা সমাজে বৈষম্য তৈরি করে। একক আইন কাঠামো একটি সমতা ভিত্তিক ও মানবাধিকার সম্মত আইনি বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে, যেখানে ধর্মীয় ও সাংবিধানিক মূল্যবোধের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এটি বাধ্যতামূলক নয়, বরং “প্যারালাল অপশন” হিসেবে থাকবে। এতে করে কেউ ধর্মীয় আইন মেনে চলুক বা রাষ্ট্রীয় আইন গ্রহণ করুক, উভয়ের সম্মান ও অধিকার রক্ষা পাবে।

    প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এই আইনটি প্রাথমিকভাবে স্বেচ্ছা ভিত্তিক (optional) থাকবে। অর্থাৎ, কোনো নাগরিক চাইলে তার ধর্মীয় আইন অনুযায়ী পারিবারিক বিষয় নিষ্পত্তি করতে পারবে, আবার চাইলে এই নতুন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় আইন অনুসরণ করতে পারবে। এই প্রস্তাবনা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন তা কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া না হয়, বরং মানুষ তার ব্যক্তিগত পছন্দ ও অধিকার অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে, একইসঙ্গে প্রস্তাবে দীর্ঘমেয়াদে একটি “সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক আইন কাঠামো গঠনের” সুপারিশও রয়েছে। অর্থাৎ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আইনটি এমন এক অবস্থানে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, যেখানে এটি সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে উঠবে। এভাবে, একটি অভিন্ন আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হবে, যাতে ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য না থাকে।

    এই দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক ন্যায়বিচারের দিক থেকে ইতিবাচক হলেও, বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় সংবেদনশীল বিষয়। কারণ, পারিবারিক আইন শুধু আইনি বিষয় নয়—এটি ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও জীবনাচারের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাই আমার মনে হয়, এটি একটি অপশনাল চয়েজ হিসেবে থাকলেই ভালো, কিন্তু বাধ্যতামূলক হিসেবে কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া সমীচিন হবে না।  নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক সম্প্রীতি একসঙ্গে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান, যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক ও মানবাধিকারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিতভাবে বিবেচনায় আসবে। নারী কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব একটি সাহসী প্রচেষ্টা, যা সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আমরা আশাবাদী।

    অপরাজিতা দেবনাথ, অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট

  • জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল ও বিএনপির বিরোধিতা

    জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল ও বিএনপির বিরোধিতা

    নিম্নোক্ত পদগুলোতে বর্তমানে কে নিয়োগ দেন? কে সিদ্ধান্ত নেন যে কোন ব্যক্তিকে এইসব পদে নিয়োগ করা হবে?

    – নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার;

    – অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলগণ;

    – সরকারী কর্ম কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার;

    – দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার;

    – মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার;

    – প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার;

    – প্রতিরক্ষা- বাহিনীসমূহের প্রধান

    বর্তমান ব্যবস্থাঃ রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রীর “পরামর্শ” নিয়ে। সহজ বাংলায় প্রধানমন্ত্রী ঠিক করেন কাকে নিয়োগ করবেন এই সব পদে।

    এতে সমস্যাটা কী হইসে?

    সমস্যাঃ ধরেন, আপনি আপনার দোকানে একজন ক্যাশিয়ার রেখেছেন। এখন ক্যাশিয়ার যাতে চুরি না করে, কাজ ঠিকমতো করে, এইজন্য আপনার একজন লোক লাগবে। এখন এই পাহারাদারকে কে নিয়োগ দিবে? ক্যাশিয়ার? ক্যাশিয়ার যদি নিজে কেবল তার পছন্দের লোককে নিয়োগ করে তার ওপর নজরদারি করার জন্য, তাহলে আপনার দোকানের অবস্থা কেমন হবে?

    এইবার চিন্তা করুন – আপনি, দোকান মালিক, আসলে দেশের জনগণ। ক্যাশিয়ার সরকার বা প্রধানমন্ত্রী, আর এই নজরদারি করার লোক হচ্ছে সাংবিধানিক বিভিন্ন পদে থাকা মানুষজন – যাদের কাজ হচ্ছে সরকার যাতে জনগণের ক্ষতি না করে তা নিশ্চিত করা। জনগণ ভোট দিয়ে সরকারকে তাদের দেখভালের দায়িত্ব দেয়। সরকার কাজ ঠিকমতো করছে কিনা সেটা দেখেন সাংবিধানিক এইসব পদে থাকা লোকজন। এরা যখন এদের কাজ ঠিকমতো করতে পারে না, তখন জনগণকে রাস্তায় নামতে হয়।

    তাহলে সমস্যা কী? প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন তাদেরকে যাদের কাজ সরকারকে নজরদারিতে রাখা।

    সমাধান কী?

    সংবিধান সংস্কার কমিশন একটা সমাধান প্রস্তাব করেছে। তারা বলেছে যে তারা একটা কমিটি বানাবে। এটার নাম ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’। এই কমিটিতে থাকবে কারা?

    – রাষ্ট্রপতি,

    – প্রধানমন্ত্রী,

    – বিরোধীদলীয় নেতা,

    – নিম্নকক্ষের স্পিকার,

    – উচ্চকক্ষের স্পিকার,

    – বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি,

    – বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার,

    – বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার,

    – সরকারি দল এবং বিরোধী দলের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সদস্যরা বাদ, আইনসভার উভয় কক্ষের অন্য সব দলের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাদের মধ্য থেকে মনোনীত ১ জন সদস্য

    এই প্রস্তাব কীভাবে আমাদের সমস্যার সমাধান করে? এই প্রস্তাবে শুধু সরকারি দলের না, বিরোধী দল, এবং অন্যান্য দলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকে। প্রধানমন্ত্রী চাইলেই মনমতো কাউকে নিয়োগ দিতে পারবেন না। আলোচনা করতে হবে আরো আটজন মানুষের সাথে, যাদের মধ্যে অনেকে তার দলের লোক না। এতে একটা দামাদামি হবে সরকারপক্ষ আর তাদের বিরোধীপক্ষের মধ্যে। সরকার পক্ষ মনমতো কারো নাম প্রস্তাব করতে পারবে না। বিরোধীপক্ষও সবাইকে বাতিল করতে পারবে না। তাদের মাঝামাঝি একটা জায়গায় আসতে হবে।

    এর ফলে যাদের নিয়োগ হবে, তারা জানে যে তারা কেবল প্রধানমন্ত্রীর মনের ইচ্ছার কারণে এই চাকরি পান নাই। সবাই একমত হয়ে তাদেরকে এই চাকরি দিয়েছে। আমরা আশা করতে পারি যে এই লোকগুলো মন দিয়ে তাদের কাজ করবেন, কেবল প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে কাজ করবেন না। সরকার খারাপ কাজ করলে তখন তারা সাহস নিয়ে খবরদারি করতে পারবেন।

    এটা কী আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য সবচাইতে ভালো প্রস্তাব? না। কিন্তু এটা একটা প্রস্তাব। এটা সমস্যাটাকে সমস্যা বলে। সমাধানের একটা ব্যবস্থা আমাদেরকে বলে।

    বিএনপি বলেছে তারা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল চায় না। প্রধানমন্ত্রীই নিয়োগ করবেন এই সব সাংবিধানিক পদে। তাদের বক্তব্য –

    “এই কাউন্সিল করা হলে সরকার দুর্বল হবে” (প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল)

    তাহলে তারা কি সমস্যাটা স্বীকার করে? এই কাউন্সিল যদি ভালো সমাধান না হয়, তাহলে তাদের বিকল্প প্রস্তাব কী? নাকি বর্তমান ব্যবস্থা যার কারণে তারা ১৬ বছর দৌড়ের উপর ছিলো সেটাই ভালো ছিলো?

    আরেক জায়াগায় দেখলাম তারা বলেছে –

    “যখন সংসদ থাকবে না, সেই সময়ে এনসিসির পাঁচ সদস্যের চারজনই থাকবেন অনির্বাচিত। সংবিধানের মূল নির্যাস হলো, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির শাসন।” (সমকাল, ২৩ এপ্রিল)

    যখন সংসদ ভেঙে যাবে, সাংবিধানিক কাউন্সিলে কারা থাকবেন? রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, আর প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত দুইজন উপদেষ্টা। একই তো লোক, দুই জায়গায়। প্রধান উপদেষ্টা, আর অন্য দুই উপদেষ্টা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থাকলে সমস্যা নাই, কিন্তু জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলে থাকলে সমস্যা?

    যখন সংসদ থাকবে না, তখন তো এমনিতেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নাই। অনির্বাচিত লোকজনে ভরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এতো ভালো লাগলে, সাংবিধানিক কাউন্সিলে অনির্বাচিত লোক থাকলে সমস্যাটা কী? কোন কারণে অনির্বাচিত উপদেষ্টারা ভালো, কিন্তু অনির্বাচিত সাংবিধানিক কাউন্সিলের লোকজন খারাপ? যখন সংসদ ভেঙে যাবে, সাংবিধানিক কাউন্সিলে কারা থাকবেন? রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, আর প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত দুইজন উপদেষ্টা। একই তো লোক, দুই জায়গায়। প্রধান উপদেষ্টা, আর অন্য দুই উপদেষ্টা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থাকলে সমস্যা নাই, কিন্তু জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলে থাকলে সমস্যা?

    সমস্যা হয়তো আছে। সেটা খুলে বলুক। কিন্তু আপনি সেটা দেখবেন না। প্রধান বিচারপতি অনির্বাচিত লোক। তাকে বাদ দিয়ে এই কাউন্সিল করলে ভালো হবে? তাহলে সেটা বলুক। আপনি সেটাও দেখবেন না।

    সবচাইতে ভয়ংকর কাজটা করে টিভি মিডিয়া। এই পুরো আলাপটাকে মিসরিপ্রেজেন্ট করে এইভাবে –

    “অনির্বাচিত লোকজন দিয়ে ভরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল মানবে না বিএনপি।”

    আর কোনো ইনফরমেশন দেয় না। সাংবিধানিক কাউন্সিলে আসলে কতোজন থাকবে? কতোজন নির্বাচিত? কতোজন অনির্বাচিত? কখন অনির্বাচিত লোক বেশি? এটা দুটি কারণে হতে পারে। এক – তাদের এই সক্ষমতা নাই এই প্রস্তাবকে সহজে বোঝার বা বুঝায় বলার, আর বিএনপির বক্তব্যকে খোঁচায় দেখার – যে আসলে ঘটনা কী।

    দুই – তারা ধরে নিয়েছে যেহেতু বিএনপি সরকার গঠন করবে, আমরা গা বাঁচাই। তারা সেলফ-সেন্সর করতেসে। আমার মতো বোকাসোকা লোক যদি ১০ মিনিট অনলাইনে ছাপা খবর পড়ে বিএনপির কথায় এই ঘাপলাগুলা ধরতে পারে, তাদের ধরতে না পারার কোনো কারণ নাই। সুতরাং দ্বিতীয়টাই ঘটছে বলে ধরে নিচ্ছি।

    সংস্কারের সবচাইতে বড় সমস্যাটা হচ্ছে এটা চাপা পড়ে গিয়েছে এর ভারী নামের নিচে, আর এর ব্যাপক কলেবরের ভারে। সব আলোচনা সমাধান প্রস্তাব নিয়ে। কোনো আলোচনা সমস্যা নিয়ে না। আমরা কি সমস্যাগুলো স্বীকার করি? সমাধান ভালো না লাগতে পারে, কিন্তু এই সমস্যাগুলো সমাধান করা দরকার, সরকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার – এই বিষয়ে কি আমরা একমত?

    অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কাছে এখনো মনে হয় – যারা সংস্কার চান, তারা মেসেজগুলাকে সমাধান দিয়ে ফ্রেম না করে, সমস্যা দিয়ে ফ্রেম করলে বেশি পপুলার সাপোর্ট পাবেন। রাজনৈতিক দলগুলার উপরে বেশি চাপ দিতে পারবেন।

    ইয়াসিন শাফি, পিএইচডি শিক্ষার্থী, পলিটিক্যাল সায়েন্স, পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি

  • সংবিধান ও নির্বাচনঃ একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

    সংবিধান ও নির্বাচনঃ একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

    জুলাই অভ্যুত্থান রিলেটেড একটা রিসার্চের অংশ হিসেবে একটি ওয়ার্ড ক্লাউড জেনারেট করলাম কিছুদিন আগে। ডাটাসেটের প্রতিটা রো অভ্যুত্থানের একেকটা প্রটেস্ট/মিছিল/ইভেন্ট রিপ্রেজেন্ট করে, অনেকগুলোর সাথে কিছু নোটসও ছিলো, সেই নোটগুলো ইউজ করেই এটা আনা হয়েছে। খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার হচ্ছে, এই পুরো গ্রাফিকে নির্বাচন (Election) কথাটা একবারও আসে নাই, বাট সংস্কার (Reform) শব্দটা একাধিকবার এসেছে। যদিও আদতে এতে খুব অবাক হওয়ার কিছু নাই, কারণ আমরা যারাই আন্দোলনে ছিলাম, সবারই মনে থাকার কথা যে ওই সময়ে নির্বাচন নিয়ে কারোরই মাথাব্যথা ছিলো না, জুলাইয়ের স্পিরিট ছিলো ফ্যাসিবাদের পতন আর রাষ্ট্র সংস্কার।

    রাষ্ট্র সংস্কারের একটা অংশ সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই, কিন্তু বিএনপির পোষা জ্ঞানপাপী একটিভিস্টরা যেভাবে অভ্যুত্থানের মূল ফোকাস হিসেবে নির্বাচনকে সামনে নিয়ে আসছে, সেটা একেবারে ডাহা মিথ্যা আর ন্যারেটিভ শিফটের চেষ্টা ছাড়া কিছু না। যাই হোক, সংস্কার, বিশেষ করে সংবিধান, সরকার কাঠামোর সংস্কার কেন সবার আগে দরকার সেটা সম্ভবত আমাদের জেনারেশনের অনেকেই এখনো বুঝে না (অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করে)। বিএনপি ঠিক কি কারণে এই মহাগুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো, আর ক্ষমতায় আসলে কিভাবে আগের বস্তাপঁচা সিস্টেমের অপব্যবহার করবে এসব বোঝা দরকার। কারণ ২,০০০ এর কাছাকাছি মানুষের রক্ত এতো সহজে ব্যর্থ হয়ে যেতে দেয়া যাবে না.. সহজ কথা!

    বাংলাদেশে মোটামুটি স্ট্যাবল গণতন্ত্র আসে ১৯৯১ সালে। এরপর থেকে প্রায় সব নির্বাচনের সময়ই জাতীয় সংকট দেখা দিয়েছে আর এই সংকটগুলার মূল কারণ পার্লামেন্টে মেজরিটির অপব্যবহার আর বিএনপি – আওয়ামী লীগের মুনাফেকি! ১৯৯১ এ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি ৯০ এর গণ আন্দোলনের প্রত্যেকটা সমঝোতার বরখেলাপ করে.. এরপর মাগুরা উপনির্বাচনের কারচুপি আর ১৯৯৬ এ একদলীয় নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা। ২০০১ এ প্রচুর মানুষ মারা যায় নির্বাচনের সময় সহিংসতায়.. তবে বড় ধরনের কোন অচলাবস্থা ক্রিয়েট হয় নাই, কেন হয় নাই সে ডিস্কাশনে একটু পরে যাই।

    প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সাংবিধানিকভাবে শেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কথা। ২০০৬ এ বিএনপি – জামায়াত সংবিধান সংস্কার করে বিচারপতির অবসরের বয়স এমনভাবে বাড়ায় যাতে নিজেদের পছন্দের কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন। এই কারসাজির ফলাফল? লগি বৈঠার ভয়ংকর এক আন্দোলন আর ওয়ান ইলেভেন! এরপর ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে তো আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টে ২০০+ আসনের সুবিধা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দিলো! একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায়, ২০০৬ আর ২০১৩, দুইবারই দেশের ওই অচলাবস্থায় চলে যাওয়ার কারণ ছিলো সংসদে দুই তৃতীয়াংশ আসন থাকলেই যেভাবে ইচ্ছা সংবিধান চেঞ্জ করে ফেলার ক্ষমতাটা সরকারি দলের কাছে থাকা।

    ঠিক এই কারণেই হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০০১ এ চাইলেও তেমন ঝামেলা করতে পারে নাই, কারণ তাদের মেজরিটিই ছিলো না! বাংলাদেশের যেকোনো নির্বাচনে ২০০+ আসন পাওয়া খুব কঠিন কিছু না (ভারতের মতো বড় দেশগুলার তুলনায়) যদি নিজেদের পক্ষে ফ্লো থাকে, এরাউন্ড ৪১% ভোট দিয়েই বিএনপি ২০০১ এ ২০০+ আসন পেয়ে গেসিলো। তাই যতদিন সংবিধান সংশোধনের প্রসেস আরো কমপ্লিকেটেড, আরো প্রতিনিধিত্বশীল না করা হবে, ততদিনই সরকারি দল এই পাওয়ারটাকে মিসইউজ করে বাংলাদেশের ডেমোক্রেসির কবর রচনা করবে।

    এজন্যই সংবিধান সংস্কার কমিশন খুব চমৎকার একটা প্রস্তাব আনলো রিসেন্টলি। সেটা কি?

    সেটা হচ্ছে সংসদে একটা উচ্চকক্ষ থাকবে অন্যান্য বিভিন্ন দেশের আদলে, সংবিধান সংস্কারের জন্য নিম্ন আর উচ্চ দুই কক্ষেই ২/৩ মেজরিটি লাগবে, আর মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, উচ্চকক্ষের আসন বিন্যাস হবে জাতীয় নির্বাচনে দলগুলার পাওয়া টোটাল ভোটের পারসেন্টেজ অনুযায়ী। সো কোন দল যদি ২৫% ভোট পেয়েও নিম্নকক্ষে খুব কম আসন পায়, উচ্চকক্ষে ঠিকই তারা ২৫টা সিট পাবে। এটায় সুবিধা কি? প্রথমত, ওই ২৫% মানুষের একটা প্রপার রিপ্রেজেনটেশন সংসদে থাকলো। দ্বিতীয়ত, যখন ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা সংবিধান কাটাছেঁড়া করা থেকে সরকারি দলগুলোকে আটকানো যাবে। কারণ ২০০টা আসন পাওয়া খুব সম্ভব হলেও একটা দেশের ৬৬.৬৭% মানুষের ভোট টানা খুবই কঠিন। এটায় পাওয়ারের একটা ব্যালেন্স আসবে.. সংসদে বিরোধী দলগুলারও চমৎকার ভূমিকা রাখার চান্স থাকবে।

    খুবই চমৎকার না? বাট গেস হোয়াট.. বিএনপি এই প্রতিনিধিত্বশীল উচ্চকক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। তাদের দাবী হচ্ছে নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যার অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বন্টন করতে হবে। তাহলে আর উচ্চকক্ষের দরকারটা কি? এমন তো না যে উচ্চকক্ষে কেউ নিজের দলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে দলকে সাবোটাজ করবে। আসল কথা হচ্ছে বিএনপি সেই ১৯৯৬ আর ২০০৬ এর মতোই সংবিধান কাটাছেঁড়ার স্বাধীনতা চায়, আর যেহেতু তারা কনফিডেন্ট যে মেজর কোন অপনেন্ট না থাকায় তারা মেজরিটি পাবেই, তাই তারা এতো অবভিয়াস আর গুরুত্বপূর্ণ একটা সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, আর তাদের নির্লজ্জ একটিভিস্টরা এটার সাফাইও গাচ্ছে। এটা সরাসরি জুলাইয়ে যে স্বপ্ন আমাদের চোখে ছিলো, সেটার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।

    বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দ্বিতীয় আরেকটা বিশাল ফ্ল হলো সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে রীতিমতো ডিক্টেটর লেভেলের ক্ষমতা দিয়ে রাখা। এই ব্যাপারটা আমরা অনেকেই ভালোভাবে জানি না বা বুঝি না। একটা প্রপার ডেমোক্রেসিতে ক্ষমতার চেক এন্ড ব্যালেন্স খুবই ইম্পর্ট্যান্ট, যাতে কেউ বেশী ক্ষমতা পেয়ে গিয়ে সেটার অপব্যবহার না করতে পারে। এজন্যই সব সফল গণতান্ত্রিক দেশে সরকারপ্রধানের পাওয়ার কিছুটা কারটেইল করে অন্যদের ডিস্ট্রিবিউট করা হয়। এজন্যই ট্রাম্পের একের পর এক অধ্যাদেশকে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করতে পারে বিভিন্ন স্টেট, বরিস জনসনকে  রিজাইন করতে বাধ্য করা যায়, আর সবচেয়ে ভালো এক্সাম্পল দক্ষিণ কোরিয়ার, যেখানে সরকারপ্রধান মিলিটারি রুল জারি করার ২৪ ঘন্টার মধ্যে সংসদ সেটাকে রিভার্ট করে ফেলে।

    ২০০৬ আর ২০১৩, দুইবারই দেশের ওই অচলাবস্থায় চলে যাওয়ার কারণ ছিলো সংসদে দুই তৃতীয়াংশ আসন থাকলেই যেভাবে ইচ্ছা সংবিধান চেঞ্জ করে ফেলার ক্ষমতাটা সরকারি দলের কাছে থাকা।

    বাংলাদেশের সংবিধানে আনফরচুনেটলি.. প্রধানমন্ত্রীর এতোই বেশী ক্ষমতা, যে এ ধরনের কিছু কল্পনাও করা যায় না (যদি না নিজের দলেই সবাই বিপক্ষে চলে যায়), এবং ঠিক এই ব্যাপারটাই শেখ হাসিনাকে একজন প্রপার ডিক্টেটর হয়ে উঠতে হেল্প করে আসছিলো। এই কারণেই বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে রীতিমতো একটা কাল্ট গড়ে উঠে। ইন্টেরিম সরকারের সংস্কার কমিশন এই ব্যাপারটাও এড্রেস করে খুব সুন্দরভাবে।

    প্রথমত, প্রধানমন্ত্রীর বেশ কিছু ক্ষমতা কিছুটা কমানো (বলে রাখা ভালো, প্রধানমন্ত্রী স্টিল বাই ফার সবচেয়ে পাওয়ারফুল থাকবে, বিএনপি যতই মিথ্যা কথা বলুক এ নিয়ে).. পাশাপাশি কেউ দুই মেয়াদের বেশী প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে এই প্রস্তাবগুলি রীতিমতো পরীক্ষিত.। এরপরেও বিএনপি এজ ইউজুয়াল এসবের বিরুদ্ধে! কারণ তারা তো ভাবছে তারাই নির্বাচন জিতবে তাহলে নিজের ক্ষমতা কেন কমাবে? “পরপর” ৩ বার না হলে ২+ বার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে এ প্রপোজালটাতো রীতিমতো হাস্যকর!

    চাইলে সংস্কার কমিশনের অনেক প্রস্তাব নিয়েই এমন আলোচনা করা যায় যেসবের বিরোধিতা করেছে বিএনপি বা অন্য কিছু দলও (যেমন জামায়াত আর্টিকেল ৭০ বাদ দেয়ার বিপক্ষে)। বিএনপির কিছু নেতা আরেকটা মিথ্যা কথা বারবারই বলে.. সেটা হচ্ছে এই সরকারের ম্যান্ডেট নাই, তাদের কাজ হচ্ছে কেবল নির্বাচন করা, সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার।

    প্রথমত, এই সরকারের চেয়ে বড় ম্যান্ডেট ১৯৭০ এর পরের কোন সরকারেরই ছিলো না। বিএনপি দিনের পর দিন নির্বাচন এর কথা বলে মানুষকে আন্দোলনে ডাকার পরেও মানুষ ভুলেও রাস্তায় নামে নাই.. কারণ সিস্টেম চেঞ্জ না হলে ক্ষমতার পালাবদল হয়ে খুব বেশী লাভ নাই এটা আমরা জানতাম। মানুষ কখন নামলো? ছাত্রদের ডাকে.. যখন দেখলো এবার রাষ্ট্রের মৌলিক সমস্যাগুলা সমাধানের একটা সম্ভাবনা আছে। কাজেই এই সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে সেই সমস্যাগুলার সমাধান করা, তথা সংস্কার করা।

    এই সরকারের প্রধান কাজ হলো অতীতের নির্বাচিত সরকারগুলো যেভাবে ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইনে পরিণত হয়েছিলো, যেভাবে ক্ষমতায় এসেই মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলো, সেটা যাতে ভবিষ্যতে না হয় এই ব্যাপারটা এনসিওর করা! এই কাজ কোন নির্বাচিত সরকার করবে না, করার কথাও না, কারণ কেউই যেচে পড়ে নিজের ক্ষমতা কমাবে না, বিএনপির নিজের ইতিহাসই এর প্রমাণ। এই কাজ ইন্টেরিমকেই করতে হবে.. এবং নির্বাচন এসবের পরেই হতে হবে। বিএনপি বাধা না দিলে এই বেসিক চেঞ্জগুলো করতে বেশী সময় লাগার কথাও না।

    আমাদের নিজেদেরও বুঝতে হবে, কারা আসলে জুলাইয়ের শহীদদের রক্তের সাথে গাদ্দারি করছে, কাদের সাথে এখন আগের ফ্যাসিবাদী শক্তি আর প্রতিবেশী দেশ একই সুরে কথা বলছে, কেন বলছে। কেন রীতিমতো দেশ বিক্রি করে দেয়া, সবধরনের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া, লুট করা রেজিম থেকে মুক্ত হওয়াকেও কেউ কেউ দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে নারাজ! সত্যি বলতে বিএনপি জামায়াত বা ইভেন এনসিপিকে নিয়েও আমি খুব একটা আশাবাদী না.. কিন্তু ঠিকভাবে সংবিধান, সরকার ব্যবস্থার সংস্কার করা গেলে যদি ভুল পক্ষকেও ক্ষমতায় আনে মানুষ, তবুও ৪/৫ বছর পর মানুষই তাদের টেনে নামাতে পারবে। কিন্তু সংস্কার না করে আবার আগের ভুলগুলোই চলতে দিলে আমরা হয়তো আর কখনো ভোটই দিতে পারবো না।

    আমরা এবার যে সুযোগ পেয়েছি, এটা আর কখনো আসবে না! এবার এই মগের মুল্লুক ফিক্স না করতে পারলে ২০০০ প্রাণ বৃথা হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক, এই সুযোগ যাতে আমরা না হারাই, হারাতে না দেই!

    সাইফুল বারী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন লেকচারার

  • সংস্কারমূলক রাজনীতির ধারণা ও প্রাসঙ্গিকতাঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

    সংস্কারমূলক রাজনীতির ধারণা ও প্রাসঙ্গিকতাঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

    সংস্কারমূলক রাজনীতি বলতে বোঝায় এমন একটি রাজনৈতিক দর্শন, যা বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির কাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করে। এটি বিপ্লবী রাজনীতির বিপরীত, যেখানে পুরোনো ব্যবস্থাকে উৎখাত করে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।

    বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, ও প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, সেখানে সংস্কারমূলক রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংস্কারমূলক রাজনীতির সূচনা হয় মূলত স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগেই, যখন ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংস্কার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে, যা সংস্কারমূলক রাজনীতির একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংস্কারমূলক রাজনীতির দাবি জোরালো হয়। বিশেষ করে নির্বাচনী ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ ও মানবাধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এটি বেশ পরিলক্ষিত হয়।

    ২০২২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে সংস্কারমূলক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নির্বাচনী সন্দেহ, দলীয়করণ, অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি হ্রাস, বৈষম্য, যুব সমাজের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ সংস্কারমূলক রাজনীতিকে আরও জরুরী করে তুলেছে। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সংস্কারমূলক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই গণঅভ্যুত্থানের মূল কারণ ছিল সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা, নির্বাচনী জালিয়াতি, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশের জনসাধারণের মুক্তি নিশ্চিত করা।

    ছাত্র-জনতার আন্দোলনটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলনের সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনের ফলে সরকার পতন হয় ও নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। নানা গোলযোগের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, দুর্নীতি দমন, ও যুব সমাজের দাবি মেটানো সহ বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে তাদের কমিটি গঠন করতে হয়।

    সংস্কারমূলক রাজনীতির প্রধান ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, অর্থনৈতিক নীতি, শিক্ষা ও যুব উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন, ডিজিটাল ভোটিং ও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য দুর্নীতি দমন ও ই-গভর্নেন্স চালু করা জরুরি। অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে ট্যাক্ট রিফর্ম, সামাজিক সুরক্ষা ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষা ও যুব উন্নয়নের জন্য কারিকুলাম সংস্কার, কোডিং, AI, ও ডিজিটাল স্কিল যুক্ত করা, এবং স্থানীয় সরকারে যুব কোটা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।

    তবে সংস্কারমূলক রাজনীতির বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সামাজিক প্রতিরোধ ও আন্তর্জাতিক চাপ সংস্কার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর সংস্কারে অনীহা, রাজস্ব বোর্ড, দূর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা সীমিত, রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর সংস্কার বিরোধিতা এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানী নির্ভরতা সংস্কারের গতিকে প্রভাবিত করে।

    তবে সংস্কারমূলক রাজনীতির বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সামাজিক প্রতিরোধ ও আন্তর্জাতিক চাপ সংস্কার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর সংস্কারে অনীহা, রাজস্ব বোর্ড, দূর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা সীমিত, রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর সংস্কার বিরোধিতা এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানী নির্ভরতা সংস্কারের গতিকে প্রভাবিত করে।

    সংস্কারমূলক রাজনীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য সিভিল সোসাইটির ভূমিকা, তরুণদের সম্পৃক্ততা, আন্তর্জাতিক সহায়তা ও মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB), সুজন – এর মতো সংগঠনগুলোর সাথে সরকারের অংশীদারিত্ব, ইউথ পলিসি ইনোভেশন কমিটি গঠন, বিশ্ব ব্যাংক, IMF, ও UN-এর টেকনিক্যাল সাপোর্ট নেওয়া এবং সংস্কারমূলক আলোচনাকে প্রাধান্য দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

    আবির আহমেদ খাঁন একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।