সংস্কারমূলক রাজনীতি বলতে বোঝায় এমন একটি রাজনৈতিক দর্শন, যা বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির কাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করে। এটি বিপ্লবী রাজনীতির বিপরীত, যেখানে পুরোনো ব্যবস্থাকে উৎখাত করে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, ও প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, সেখানে সংস্কারমূলক রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংস্কারমূলক রাজনীতির সূচনা হয় মূলত স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগেই, যখন ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংস্কার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে, যা সংস্কারমূলক রাজনীতির একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংস্কারমূলক রাজনীতির দাবি জোরালো হয়। বিশেষ করে নির্বাচনী ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ ও মানবাধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এটি বেশ পরিলক্ষিত হয়।
২০২২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে সংস্কারমূলক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নির্বাচনী সন্দেহ, দলীয়করণ, অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি হ্রাস, বৈষম্য, যুব সমাজের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ সংস্কারমূলক রাজনীতিকে আরও জরুরী করে তুলেছে। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সংস্কারমূলক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই গণঅভ্যুত্থানের মূল কারণ ছিল সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা, নির্বাচনী জালিয়াতি, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশের জনসাধারণের মুক্তি নিশ্চিত করা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলনের সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনের ফলে সরকার পতন হয় ও নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। নানা গোলযোগের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, দুর্নীতি দমন, ও যুব সমাজের দাবি মেটানো সহ বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে তাদের কমিটি গঠন করতে হয়।
সংস্কারমূলক রাজনীতির প্রধান ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, অর্থনৈতিক নীতি, শিক্ষা ও যুব উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন, ডিজিটাল ভোটিং ও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য দুর্নীতি দমন ও ই-গভর্নেন্স চালু করা জরুরি। অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে ট্যাক্ট রিফর্ম, সামাজিক সুরক্ষা ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষা ও যুব উন্নয়নের জন্য কারিকুলাম সংস্কার, কোডিং, AI, ও ডিজিটাল স্কিল যুক্ত করা, এবং স্থানীয় সরকারে যুব কোটা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে সংস্কারমূলক রাজনীতির বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সামাজিক প্রতিরোধ ও আন্তর্জাতিক চাপ সংস্কার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর সংস্কারে অনীহা, রাজস্ব বোর্ড, দূর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা সীমিত, রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর সংস্কার বিরোধিতা এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানী নির্ভরতা সংস্কারের গতিকে প্রভাবিত করে।
তবে সংস্কারমূলক রাজনীতির বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সামাজিক প্রতিরোধ ও আন্তর্জাতিক চাপ সংস্কার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর সংস্কারে অনীহা, রাজস্ব বোর্ড, দূর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা সীমিত, রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর সংস্কার বিরোধিতা এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানী নির্ভরতা সংস্কারের গতিকে প্রভাবিত করে।
সংস্কারমূলক রাজনীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য সিভিল সোসাইটির ভূমিকা, তরুণদের সম্পৃক্ততা, আন্তর্জাতিক সহায়তা ও মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB), সুজন – এর মতো সংগঠনগুলোর সাথে সরকারের অংশীদারিত্ব, ইউথ পলিসি ইনোভেশন কমিটি গঠন, বিশ্ব ব্যাংক, IMF, ও UN-এর টেকনিক্যাল সাপোর্ট নেওয়া এবং সংস্কারমূলক আলোচনাকে প্রাধান্য দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আবির আহমেদ খাঁন একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।
Leave A Reply