পুলিশের ছররা গুলি নাকি ‘আসল গুলি’ নয়। ও দিয়ে শুধু ভয় দেখানো হয়। এমন ধারণা অনেককাল ধরেই চলে এসেছে। মূলত পাখিশিকারের জন্য ব্যবহৃত হতো এই গুলি, যা কিনা সময়ের পরিক্রমায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশী পুলিশের অন্যতম হাতিয়ারে। এই ছররা গুলিতেই প্রাণ খোয়ায় জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার মুখ থেকে উরু পর্যন্ত লেগে ছিল ছররা গুলির চিহ্ন। একেকটি গুলি শরীরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে এত বেশি গর্ত তৈরি করে যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পাখি শিকারের গুলিতে এসময়টাতে যেন পাখির মতোই শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হয়েছিল বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী। অনেকেই যারা আবু সাঈদের মতো প্রাণ হারাননি, তবে আজো নিজেদের শরীরে বয়ে চলেছেন ছররা গুলির ভার। অনেকে হারিয়েছেন চোখের দৃষ্টি, অনেককে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয়েছে।
অবশ্য শুধু যে ছররা গুলি ছুঁড়েই পুলিশ মানুষকে ছত্রভঙ্গ করে, তা নয়। জায়গায়-বেজায়গায় সাউন্ড গ্রেনেড, হ্যান্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, কাঁদুনে গ্যাসের মতো আরও বহু হাতিয়ার ব্যবহারেও পুলিশকে খুব একটা পিছপা হতে দেখা যায়নি কোনো আন্দোলনের সময়েই।
রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে দাঁড়ায়, তখন একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোনোভাবেই নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। সুযোগ ছিল না কোনোকালেই। কেননা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বছরের পর বছর ধরে নিরাপত্তা রক্ষার নামের আড়ালে জনগণের নিরাপত্তা খণ্ডন করে চলেছে পুলিশ বাহিনীর বহু সদস্য।
২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়টাতে পুলিশের অবন্ধুসুলভ আচরণের ফলে একটা বেশ লম্বা সময় পর্যন্ত পুলিশের উপর বিশ্বাস উঠেই গিয়েছিল। তারপরও বিগত সরকারব্যবস্থার পতনের পর মানুষ ক্ষীণভাবে হলেও আশা করেছিল যে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা এবারে হয়তো নিরাপত্তার জন্যই এগিয়ে আসবেন। কিন্তু আদতে কি তা হচ্ছে? পুলিশ তার দমনমূলক আচরণ থেকে একটুও কি বেরিয়ে আসতে পেরেছে?
গত জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি পুলিশের কঠোর আক্রমণের শিকার হতে হয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহকারী সাংবাদিকদেরও। পুলিশী হামলার পর থমথমে আবহাওয়ায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ পুলিশের ছবি-ভিডিও নেয়ার সময় আলোকচিত্রীদের সম্মুখীন হতে হয় বিব্রতকর পরিস্থিতির। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে এই যে, এখন আবার বাংলাদেশ পুলিশের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে গত জুলাই-আগস্টে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশী হামলার প্রমাণাদি স্বরূপ ছবি-ভিডিও ইত্যাদি আপলোডের আহ্বান জানিয়েছে। তার মানে, একদিকে পুলিশ জনগণের সহমর্মী হয়ে ওঠার একধরনের প্রচেষ্টা দেখাচ্ছে এবং অন্যদিকে এখনো আগের মতোই চালিয়ে যাচ্ছে নিপীড়ন। পুলিশের এই দ্বিমুখী আচরণ কি তবে উপরমহলের দ্বিমুখী ভাবেরই বহিঃপ্রকাশ? এ ধরনের প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয়।
এর উত্তরে চলমান ফেব্রুয়ারি মাসের আন্দোলনগুলোর কথাও ঘুরেফিরে আসে। শাহবাগ মোড়ে নিজেদের নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা। আর সেই আন্দোলনে বিগত আরো বহুবারের মতো নেমে আসে পুলিশের নিপীড়নমূলক হাত। ছুঁড়ে দেয়া হয় জলকামান, লাঠিপেটা করে আহত করা হয় বহু আন্দোলনকারীকে। মনে হয়, যেন সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে ছত্রভঙ্গ করাই পুলিশের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।অবশ্য এসব হামলার ক্ষেত্রে পুলিশ নিজে থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না, সেটি বেশ ভালোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ আরেকটি ইস্যু। কেননা পুলিশ এবং বিদ্যমান সকল ধরনের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি সরকারব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তারা এধরনের পদক্ষেপ নেবে– সেটাই স্বাভাবিক। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে পুলিশ, র্যাব, ক্ষেত্রবিশেষে সিআইডির দ্বারা বিরোধীদলীয় ব্যক্তিদের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি ঘটনার পৌনঃপুনিকতায় পুলিশের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা প্রায় উঠেই গিয়েছিল। সরকার ব্যবস্থার বদলের ফলে বাকি সব কিছুর মতো পুলিশের ইমেজে কিছুটা হলেও বদল আসা জরুরি ছিল। কিন্তু তা যে ঘটেনি, এবং ঘটার সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে– এর স্পষ্ট প্রমাণ শাহবাগে চলমানরত আন্দোলনে আবারো পুলিশের দমন-পীড়ন।
যেকোনো সভা-সমাবেশ কিংবা আন্দোলনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিয়মতান্ত্রিকতা রক্ষা করার দায় অবশ্যই পুলিশের রয়েছে। কিন্তু সেই নিয়মতান্ত্রিকতার প্রহসনের মাধ্যমে যে কেউ যে কোনো সময় বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার কাছে কোনো দাবি উত্থাপন করলে, সেই সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীর উপর চড়াও হওয়া নিশ্চয়ই কোনো সমাধান নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা চলমান। এবং যে সময়টাতে পনেরো-ষোল বছরের স্বৈরতান্ত্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসার কথা, অথবা অন্তত সেইদিকে একটি জাতি হিসেবে যাবার চেষ্টা– সে সময় পুলিশের একই আচরণ সে আশাকে অনেকটাই দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। মানুষ কি তবে এখনো নিজের চাহিদা আর প্রতিবাদ জানাতে পারবে না? এখনো তাদেরকে পুলিশের লাঠিচার্জের ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে হবে? কত কত মানুষ শুধু এই পুলিশী নির্যাতনের কারণে আহত ও নিহত হয়েছে, তবু যেন পুলিশের জন্য নেই কোনো গতিরোধক ব্যবস্থা– তা সে শেখ হাসিনার সরকারে হোক কিংবা উপদেষ্টামণ্ডলীর মন্ডলে হোক।
আন্তর্জাতিক আইন এবং সমান্তরালভাবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক নীতিতে ব্যক্তির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নেয়ার একটি স্বাধীন অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা সেই অধিকারের বিষয়ে লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ঠিকই, কিন্তু যখন এ অধিকারের চর্চার সুযোগ আসার কথা– তখনই বারবার অধিকার লঙ্ঘিত হতে দেখা যায়। যার পেছনে কাণ্ডারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে বিদ্যমান সরকার এবং তার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে যায় পুলিশের মতো নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
আন্তর্জাতিক আইন এবং সমান্তরালভাবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক নীতিতে ব্যক্তির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নেয়ার একটি স্বাধীন অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা সেই অধিকারের বিষয়ে লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ঠিকই, কিন্তু যখন এ অধিকারের চর্চার সুযোগ আসার কথা– তখনই বারবার অধিকার লঙ্ঘিত হতে দেখা যায়। যার পেছনে কাণ্ডারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে বিদ্যমান সরকার এবং তার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে যায় পুলিশের মতো নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই একটি কথা বলতেন– ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’। কথাটি সত্য হলে দেশবাসীর জন্য তা নিতান্ত স্বস্তির হতো, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, কথাটি কখনোই সত্যি হয়ে উঠতে পারেনি। পুলিশ বারবার নিজের পেশাদারিত্ব থেকে ছুটে গিয়ে পালন করেছে এক নির্দয় লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকা। জনগণের জানমাল রক্ষার বদলে ঘটিয়েছে রক্তপাত। যে রক্তপাতের নিশান নতুন, পুরনো সব বাংলাদেশেই রয়ে গেছে। রক্তের সেই চিহ্ন যদি মুছে ফেলতে হয়, তবে পুলিশ বাহিনীকে নতুন ছাঁচে গড়তে হবে। তাদের মূল উদ্দেশ্য যাতে শুধু বিদ্যমান সরকারের পক্ষ থেকে আঘাতের হাত না হয়– তারা যেন নিজেই জনগণের ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারেন, সেই পরিসরটা সৃষ্টি করতে হবে। পুলিশ জনবিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে জনশক্তির অংশ হিসেবে নিজেকে যদি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবেই তাদের নাম থেকে এই কালিমা মোচন হবে, নয়তো বাংলাদেশের ইতিহাসে পুলিশ দমন-পীড়নের মুখপাত্র হিসেবেই রয়ে যাবে ভবিষ্যতেও।
অনিন্দিতা চৌধুরী একজন লেখক ও গবেষক
Leave A Reply