বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে এককেন্দ্রিক এই প্রশাসনিক কাঠামো দেশের সমতাভিত্তিক উন্নয়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করা হয়, তবে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, অর্থনৈতিক বিকাশ এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। তবে এটি বাস্তবায়নের পথে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায়, দেশজুড়ে নীতি বাস্তবায়ন ও জনসেবা কার্যকরভাবে পরিচালিত হয় না। যদি বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করা হয় (যেমন—পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ), তাহলে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব প্রশাসন থাকবে, যা স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান মনে করেন, “প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু হলে স্থানীয় প্রশাসন আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দ্রুত হবে এবং জনগণের সেবার মান উন্নত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের সরকারি দপ্তরগুলোর ওপর চাপ কমানোর জন্য বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। প্রতিটি প্রদেশের নিজস্ব প্রশাসন থাকলে জনগণ ঢাকায় ছুটে আসার পরিবর্তে নিজেদের এলাকায় সরকারি সেবা পাবে, যা সামগ্রিকভাবে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াবে।”
বিশ্বব্যাপী সফল উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, এবং চীন। ভারত ২৮টি রাজ্যে বিভক্ত হওয়ায় প্রতিটি রাজ্য স্বতন্ত্রভাবে উন্নয়নের পরিকল্পনা নিতে পারে। এমন ব্যবস্থা বাংলাদেশেও চালু হলে, প্রশাসনিক কার্যক্রম দ্রুত হবে এবং দুর্নীতির মাত্রা কমতে পারে, কারণ জনগণের কাছে প্রশাসনের জবাবদিহি বাড়বে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা ও চট্টগ্রাম, যেখানে দেশের প্রায় ৭০% বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বাকিরা পিছিয়ে থাকার মূল কারণ হলো অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও বিনিয়োগের অভাব। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। দেশের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছে। যদি আমরা প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালু করি, তাহলে বিনিয়োগ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।”
প্রাদেশিক ব্যবস্থা চালু হলে, বিনিয়োগ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে, যা স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ঘটাবে।এছাড়া, রাজস্ব আহরণ বাড়বে, কারণ প্রতিটি প্রদেশ নিজেদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে পারবে। কৃষিনির্ভর অঞ্চলগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়বে, কারণ স্থানীয় সরকার তাদের উপযোগী নীতি প্রণয়ন করতে পারবে।
প্রাদেশিক ব্যবস্থা চালু হলে, বিনিয়োগ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে, যা স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ঘটাবে।এছাড়া, রাজস্ব আহরণ বাড়বে, কারণ প্রতিটি প্রদেশ নিজেদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে পারবে। কৃষিনির্ভর অঞ্চলগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়বে, কারণ স্থানীয় সরকার তাদের উপযোগী নীতি প্রণয়ন করতে পারবে।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় গুজরাট ও কর্ণাটক অর্থনৈতিকভাবে বেশি এগিয়ে, কারণ তারা নিজেদের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে স্বাধীনতা পেয়েছে। একইভাবে, যদি বাংলাদেশের প্রতিটি প্রদেশ স্বাধীনভাবে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে, তাহলে ঢাকার ওপর চাপ কমবে এবং সামগ্রিক অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে।
আরও পড়ুনঃ https://muktipotro.com/6224
বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও অসম উন্নয়ন স্পষ্ট। দেশের অধিকাংশ উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল ঢাকায় অবস্থিত। ফলে গ্রাম বা দূরবর্তী শহরের মানুষ উন্নত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রাদেশিক ব্যবস্থায়, প্রতিটি প্রদেশ নিজস্ব শিক্ষা ও স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করতে পারবে এবং স্থানীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হবে, যা সেবার মান বাড়াবে।
মালয়েশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াতে প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় রয়েছে, যা অঞ্চলভেদে শিক্ষা ও প্রযুক্তির চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে প্রাদেশিক পর্যায়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
শিক্ষাবিদ ড. ফরিদ আহমেদ বলেন, “ঢাকার বাইরে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হলে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে প্রতিটি প্রদেশ তাদের নিজস্ব শিক্ষা নীতি তৈরি করতে পারবে, যা স্থানীয় চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।”
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলই অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। তবে পর্যটন ব্যবসা প্রায় পুরোপুরি কক্সবাজার, সুন্দরবন এবং কিছু পাহাড়ি এলাকায় সীমাবদ্ধ। প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা থাকলে প্রতিটি প্রদেশ তাদের নিজস্ব পর্যটন শিল্প বিকাশের উদ্যোগ নিতে পারবে। যদি প্রতিটি প্রদেশের নিজস্ব পর্যটন উন্নয়ন পরিকল্পনা থাকে, তাহলে কেবল কক্সবাজার বা সুন্দরবন নয়, সিলেট, বান্দরবান, রাঙামাটি, রংপুর এবং রাজশাহীর পর্যটনশিল্পও বিকশিত হতে পারে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা অত্যন্ত কেন্দ্রীয়কৃত, যার ফলে জাতীয় রাজনীতির অস্থিরতা প্রভাব ফেলে স্থানীয় প্রশাসনে। যদি প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়, তবে জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমতে পারে। স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও জবাবদিহি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।
যদিও চারটি প্রদেশে বিভক্ত হলে অনেক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, তবে এটি বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথমে একটি পরীক্ষামূলক অঞ্চলে বিকেন্দ্রীকরণ চালু করে এর কার্যকারিতা যাচাই করা যেতে পারে। তারপর পর্যায়ক্রমে পুরো দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করা যেতে পারে । চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করা হলে প্রশাসনিক দক্ষতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। তবে এটি বাস্তবায়নের আগে সুস্পষ্ট নীতিমালা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলে, বিকেন্দ্রীকরণ উন্নয়নের একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে, যা বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
খন্দকার রুকাইয়া সিদ্দিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী
Leave A Reply