বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার একটি প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা হবে চারটি প্রদেশ। প্রদেশগুলোতে পৃথক প্রাদেশিক সরকার থাকার প্রস্তাবও রয়েছে।
সমর্থকদের মতে, প্রাদেশিক ব্যবস্থা শাসন ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণের সুযোগ করে দেবে। কিন্তু, বাংলাদেশের মত ছোট একটি দেশে চারটি প্রদেশের কি আদৌ প্রয়োজন রয়েছে?
ঐতিহাসিকভাবে, বিকেন্দ্রীকরণ বরাবরই একটি অধরা লক্ষ্য থেকে গেছে। ১৯১৯ সালের ‘বেঙ্গল ভিলেজ সেলফ-গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট’ থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের ‘স্থানীয় সরকার আইন’ পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম চালানো হয়েছে। তবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধের কারণে এসব প্রচেষ্টা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে। নানাবিধ জটিলতা ও রাজনৈতিক জটের কারণে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি একটি অবাস্তব প্রস্তাব।
নতুন প্রদেশ তৈরি হলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আরও বাড়বে এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা সৃষ্টি হবে। প্রাদেশিক ব্যবস্থা দায়িত্বের ওভারল্যাপ তৈরি করতে পারে এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্বজুড়ে ফেডারেল ব্যবস্থায় এ ধরনের সমস্যার উদাহরণ রয়েছে, যা জনসেবার বিলম্ব ঘটাতে পারে। বরং, বিদ্যমান বিভাগীয় কাঠামোর মধ্যেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করলে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সহজ করা সম্ভব হবে।
সংবিধানে বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করলেও কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র এটি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে। ২০০৯ সালের ‘উপজেলা পরিষদ আইন’ সহ অন্যান্য আইন স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা বললেও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
ঢাকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিকেন্দ্রীকরণের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রাদেশিক ব্যবস্থার সমর্থকরা যুক্তি দেন যে এটি ক্ষমতার আরও ন্যায়সঙ্গত বণ্টন নিশ্চিত করবে। তবে, অতীত অভিজ্ঞতা ভিন্ন ইঙ্গিত দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮০-এর দশকে জেনারেল এরশাদের অধীনে উপজেলা ব্যবস্থা চালু করা হলেও আমলারা স্থানীয় সরকারকে প্রকৃত ক্ষমতা দিতে বাধা দেয়। একই চিত্র প্রাদেশিক ব্যবস্থাতেও পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা ছাড়তে আগ্রহী নাও হতে পারে।
আমলারা স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতা দিতে চায় না, কারণ এতে তাদের ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস পাবে। যখন এরশাদ উপজেলা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, তখন তিনি ক্ষমতা ভাগাভাগির বিভিন্ন ব্যবস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা ক্রমশ ইউএনওদের হাতে চলে যায়। ইউএনওরা উপজেলা চেয়ারম্যানদের সচিব হিসেবে কাজ করার কথা ছিল এবং তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (ACR) লেখার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু আমলারা এটি মেনে নিতে রাজি হননি। খোদ ঢাকা শহরেই নির্বাচিত মেয়ররা কয়েক দশক ধরে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করেছেন। ১৯৯৪ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মেট্রোপলিটন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি সমন্বয় সংস্থা তৈরির প্রস্তাব দেন, যাতে ঢাকা ওয়াসা, ডেসা, তিতাস গ্যাস, মেট্রোপলিটন পুলিশ, রেলওয়ে ও রাজউকের মতো সংস্থাগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকত। তবে মন্ত্রণালয় এটিকে অবাস্তব বলে প্রত্যাখ্যান করে, বিশেষত পুলিশ বিভাগের ওপর সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সরকার অনিচ্ছুক ছিল।
২০০২ সালে সাদেক হোসেন খোকা মেয়র নির্বাচিত হলে ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেন। কিন্তু সেটিও টেকসই হয়নি। পরে দায়িত্ব চলে যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা নেন, ফলে মেয়রের ক্ষমতা আরও সীমিত হয়ে পড়ে।
প্রদেশ গঠনের পরিবর্তে বিদ্যমান বিভাগ ও উপজেলা পর্যায়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে তা অধিক কার্যকর হতে পারে। এতে নতুন আমলাতান্ত্রিক স্তর যোগ না করেই প্রশাসনিক অদক্ষতা দূর করা সম্ভব হবে।
প্রদেশ গঠনের পরিবর্তে বিদ্যমান বিভাগ ও উপজেলা পর্যায়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে তা অধিক কার্যকর হতে পারে। এতে নতুন আমলাতান্ত্রিক স্তর যোগ না করেই প্রশাসনিক অদক্ষতা দূর করা সম্ভব হবে।
আমরা বিভাগগুলোর ক্ষমতা বাড়াতে পারি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে নতুন দুটি বিভাগের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। এখন, স্থানীয় সরকারকে যদি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব। আমাদের স্থানীয় সরকার ও আমলাতন্ত্রে আরও জবাবদিহিতা প্রয়োজন, যা বিভাগীয় ব্যবস্থার মধ্যেই করা সম্ভব।
প্রাদেশিক ব্যবস্থা আমাদের রাজনৈতিক বিভক্তিকে আরও উসকে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে ভিন্ন দল ক্ষমতায় এলে সংঘাত আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনটা হরদম ভারতে দেখা যায়, অথচ ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো বাংলাদেশের চাইতে অনেকগুণে শক্তিশালী। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল প্রাদেশিক-জাতীয় স্তরে রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা রাখে না। তারা এখনো প্রস্তুত নয়।
আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোতে ইউএনও ও ডিসিদের উচিত স্থানীয় প্রশাসনের সহায়ক হওয়া, কিন্তু বাস্তবে তারা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ধরে রাখে। নতুন সংস্কার প্রস্তাবে উল্টো ডিসিদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
আমরা বিকেন্দ্রীকরণকে শুধুমাত্র স্লোগানে সীমাবদ্ধ রেখেছি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটানোর জন্য স্থানীয় সরকারকে যথাযথ ক্ষমতা দেইনি। অন্য দেশে স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশল কার্যকর হয়েছে, যেখানে জেলাগুলো তাদের নিজস্ব সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু আমরা সবকিছুর জন্য ঢাকার ওপর নির্ভর করেছি।
প্রাদেশিকতা কাগজে-কলমে সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, তবে আসল প্রশ্ন হলো, এই সংস্থাগুলো বাস্তব ক্ষমতা পাবে কি না? যদি না পায়, তবে এর অর্থ কী?
Leave A Reply