জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ আমাদের জন্য এক ঐতিহাসিক জয়। হাসিনা সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বীকৃতি পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিক মঞ্চে – একটি মুহূর্ত যা আমাদের আইনি লড়াইয়ে অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু এই সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট হতে চলেছে কিছু ছাত্রনেতা এবং অনলাইন এক্টিভিস্টদের অপরিণামদর্শী আচরণে। তারা এই মুহূর্তকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগানোর বদলে প্রতিহিংসা এবং রাজপথের বিচারের দিকে ধাবিত হচ্ছেন।
৫ ফেব্রুয়ারি ৩২ নম্বরের ভবনে আগুন এবং ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে যার সূচনা হয়েছিল, এবং এখনো ছাত্রনেতৃবৃন্দ এবং অনলাইন এক্টিভিস্টদের একাংশ আওয়ামী লীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান যেভাবে জোরেশোরে জানাচ্ছেন – তা আমাদের বিপ্লবের নৈতিক শক্তিকেই দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমানভাবে দুর্বল করে ফেলছে।
কিন্তু এই পথ কি সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের দিকে নিয়ে যাবে, যার জন্য আমরা লড়াই করেছি? নাকি আমরা আবারও সেই পুরনো চক্রের দিকে ফিরে যাচ্ছি, যেখানে একের অত্যাচার অন্যের অনাচার দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়?
আওয়ামী লীগের পতনের পর এই মুহূর্তে আমরা একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে আছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ, অন্যদিকে জনরোষ এবং প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার পথ। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথটি বেছে নেব।
আওয়ামী লীগের পতনের পর এই মুহূর্তে আমরা একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে আছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ, অন্যদিকে জনরোষ এবং প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার পথ। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথটি বেছে নেব।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিষিদ্ধ করা এবং তাদের সমর্থকদের একঘরে করার যে পথ, সেটা তো আওয়ামী লীগেরই দেখানো পথ। আমরা কি সেই একই পথে হেঁটে আরেক স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করতে চাই? মনে রাখতে হবে, আমরা এই দীর্ঘ লড়াই করেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। আর ন্যায়বিচার কেবল আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব।
গণবিচারের কোন শেষ নেই। এক শত্রুর বিরুদ্ধে শুরু হয়ে ক্রমশ তা আইনহীনতার দিকে ধাবিত হয়। আজ যারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণবিচারের ডাক দিচ্ছেন, কাল তারাই অন্য কোন রাজনৈতিক শত্রু বা সমালোচকের বিরুদ্ধে একই পথ বেছে নেবেন। এভাবে আমরা কখনোই একটি সভ্য সমাজ গড়ে তুলতে পারব না।
বিশেষ করে ছাত্রনেতাদের এবং তাদের আসন্ন রাজনৈতিক দলের জন্য এই পথ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। জনগণ আর প্রতিহিংসার রাজনীতি দেখতে চায় না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এটি অত্যন্ত সমস্যাজনক; যারা বাংলাদেশকে অরাজক হিসেবে চিত্রিত করে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করতে চায় তাদের জন্য এটি একটি অপ্রত্যাশিত উপহার বই কিছু নয়।
অবশ্যই এটা সত্য যে আওয়ামী লীগ এখনো তাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি। বরং হাসিনা ভারত থেকে তার সমর্থকদের উস্কানি দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু একারণেই আমাদের আরও বেশি করে সুচিন্তিত, পদ্ধতিগত এবং আইনানুগ পথ বেছে নিতে হবে, যাতে আওয়ামী লীগ আর কখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ না পায়।
এর একটি কার্যকর পথ হতে পারে গণভোট। আওয়ামী লীগ এবং তার রাজনীতিকে বাংলাদেশ থেকে নিষিদ্ধ করা হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক জনগণের ভোটের মাধ্যমে। এই গণভোট করা যেতে পারে সংবিধানের অন্যান্য বড় পরিবর্তনের সাথে একযোগে, যা সংসদীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে না করে আগামী নির্বাচনের আগেই সরাসরি জনগণের সিদ্ধান্তে হওয়া উচিত।
শুধুমাত্র গণভোট নয়, জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনকে কাজে লাগিয়ে আমরা আওয়ামী লীগের যাবতীয় প্রোপাগান্ডা প্রতিহত করতে পারি। প্রতিবেদনের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত ব্যাপকভাবে প্রচার করে আমরা জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারি কীভাবে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই তথ্যগুলো ভারতীয় মিডিয়া বা আওয়ামী সমর্থকদের মিথ্যা প্রচারণাকে খণ্ডন করবে, এবং যারা এখনো সন্দেহের ঘোরে আছে তাদের চোখ খুলে দেবে। আর এভাবেই গণভোটে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের প্রস্তাব প্রয়োজনীয় জনসমর্থন পাবে।
একইভাবে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনা করে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে এই আইনি প্রক্রিয়া সন্দেহাতীত হবে এবং কোনো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক কখনো এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় আমরা শর্টকাট নিয়ে যে ভুল করেছিলাম, সেই শিক্ষা ভুলে যাওয়া চরম বোকামি হবে।
শুধুমাত্র এই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা নিশ্চিত করতে পারব যে আওয়ামী লীগ আর কখনো এই দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারবে না। যত বেশি আমরা বিচারবহির্ভূত কার্যক্রম এবং গণবিচারের দিকে ঝুঁকব, ততই আওয়ামী লীগের প্রচার যন্ত্র শক্তিশালী হবে, অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, এবং ছাত্রনেতারা ও তাদের নতুন দল প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই বিতর্কিত হয়ে পড়বে।
লেখক: রুবাইয়াত খান, মুক্তিপত্রের উপসম্পাদকীয় বিষয়ক সম্পাদক
Leave A Reply