মানুষ বলে বাংলাদেশে বিপ্লব হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে আসলে বিপ্লব হয়ে গিয়েছে, বিপ্লব হয়েছে মানুষের ভিতরে।
জুলাই এ যে বিপ্লব হয়েছে, তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ হলো ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে শিবিরের একচেটিয়া বিজয়। মানুষের চিন্তা চেতনা যে কতো ডিগ্রি ঘুরেছে তা বাইরে থেকে আঁচ করা সহজ ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঁচা বাঙালি এখন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো যেই দল, তাদের উপর আস্থা রাখছে।
বাংলাদেশের মানুষকে ১৬ বছর ধরে জোর করে গিলানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা। মানুষ স্বভাবতই স্বাধীনতা-প্রিয়, জোর জবরদস্তি মানুষ পছন্দ করে না। তাই জোর করে মুখে ঠুসে দিলে বাচ্চারা সাধারণত গেলে না, মুখে নিয়ে বসে থাকে, অথবা বমি করে দেয়। এক আধবার গিলে ফেললেও অভক্তি চলে আসে সেই খাবারের প্রতি। বাংলাদেশের মানুষের সাথেও ব্যপারটা ওরকমই ঘটেছে, মানুষ সেসব গেলেনি।
এইসবের পাশাপাশি মানুষকে আরো একটা জিনিস গেলানো হতো, তা হলো জামাত-শিবির খারাপ। মুক্তিযুদ্ধ করে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশের জামাতের প্রতি অভক্তি থাকা অস্বাভাবিক না। জামাতের নেতাদের যখন ফাঁসি দেয় শেখ হাসিনা, তখনও অনেক মানুষ এইটা ভেবে আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলো যে রাজাকারদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
১৪ জুলাই এর “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রজাকার” স্লোগান একটা প্রাথমিক বিপ্লব ঘটায় মানুষের মন ও মগজে। এরপর হাসিনার ক্রমাগত হত্যাযজ্ঞ আর হিংস্রতা মানুষ যখন চোখের সামনে দেখে, তখন হাসিনার প্রতি ঘৃণা এতোটাই বাড়ে, যে হাসিনার বিরোধিতাই হয়ে ওঠে প্রধানতম আত্মতৃপ্তি। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সর্ববৃহৎ শত্রু জামাতে ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে মানুষ।
শেখ হাসিনার শাসনকালে সবচেয়ে বেশি জুলুমের শিকার হয় জামাত ইসলাম আর শিবির। তাদেরকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিলো সে। তার তৈরি আয়নাঘরসহ তার সময়ে হওয়া অনেক জুলুম নির্যাতনের নজির মানুষের সামনে চলে আসে জুলাই এর পর। অতঃপর, আরও কিছু মাস পর বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আর আবেগের জায়গা দখল করে নেয় জামাত-শিবির।
“বিকল্প কে?” প্রশ্নে এসে যখন বিপ্লব আটকে যেত, শেখ হাসিনাকে সরানো নিয়ে দ্বিধা তৈরি হতো, সেই প্রশ্নের উত্তরের শূন্যস্থানে জামাত ইসলামকে বসিয়ে জুলাই এর আগে ভাবেনি মানুষ। ছাত্ররা বিকল্প দল তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক অপরিপক্কতা এবং অভ্যন্তরীণ কলহের কারণে তারা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মানুষের আস্থা অর্জন করতে এখনো পারেনি। তার উপরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ পথভ্রষ্ট হয়ে জনগণের আস্থা গুড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল যাকে বলা হয়, বিএনপি, তারা এই এক বছরে এতোগুলো অরাজকতা ঘটিয়েছে, যা মানুষের মনে বিএনপির প্রতি ঘৃণা তৈরি করে দিয়েছে। তারা বিএনপিকে চায় না। আর বিএনপিকে ঠেকাতে হাতিয়ার হতে পারে জামাত ইসলাম।
অবশেষে ফলাফল হলো, মানুষের মনের বিপ্লব জানান দিলো ছাত্রসংসদ নির্বাচনে। কিন্তু এই বিপ্লব সেই বিপ্লব না, যেই বিপ্লবের কথা চিন্তা করে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছিলো। সুশাসন, অধিকার, মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য জুলাই এ যখন মানুষ সংগ্রাম করেছে, তখনও তারা বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বারা এসব করা সম্ভব বলে ভরসা করেনি, কারণ হলো অতীত অভিজ্ঞতা। কিন্তু জুলাই পরবর্তী সময়ে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ও লোকবলের ফলে খুব দ্রুতই মানুষের আস্থার জায়গা দখল করে নিয়েছে জামায়াতে ইসলামি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আবেগপ্রবণ এবং হুজুগে। সাময়িক আবেগে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, দূরদর্শী চিন্তা করে না। যেজন্য তারা হয়ে ওঠে কোনো এক নির্দিষ্ট দলের অন্ধভক্ত। মানুষের এই অন্ধভক্তিই একটা দলকে করে তুলতে পারে স্বৈরাচারী। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যাদের উপর ভরসা করে, তাদের উপর শতভাগ ভরসা করে। তাদের কোনো নেতিবাচক দিক তারা দেখতে পায়না, দেখলেও বিশ্বাস করে না। সেই দলের সমালোচনা করতে পারা তো অনেক দূরের ব্যপারে, তাদের সমালোচনা শুনতেও পারে না। যেসব মানুষ সমালোচনা করার মতো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে, তাদেরকে আবেগী জনগণ ও সেই দলের জনশক্তি কোণঠাসা করে ফেলে। ফলত, সেই দল হয়ে ওঠে স্বেচ্ছাচারী।
অথচ মানুষের মগজে বিপ্লব তো হওয়া উচিৎ ছিলো এমন, যে মানুষেরই ক্ষমতায়ন হবে। তারা কোণঠাসা করে রাখবে দলগুলোকে। ক্রমাগত সন্দেহ করে আর প্রশ্ন করে শক্তিগুলোকে সতর্ক রাখবে, যেন তারা স্বৈরাচারী না হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বিপ্লব ঘটেনি। মানুষ বিনা পারিশ্রমিকের ক্ষমতা পছন্দ করে না। তারা সব ক্ষমতা কোনো এক মহানায়ক অথবা দলের উপর ন্যাস্ত করে আরামে ঘুম দিতে চায়। আর এজন্যই এই দেশে খুব সহজেই ক্ষমতাসীন দল হয়ে ওঠে স্বৈরাচারী।
জামায়াতে ইসলামি এখনো ক্ষমতাসীন দল না। কিন্তু যেই অন্ধভক্তি সাধারণ মানুষের পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় তারা জামায়াতে ইসলামির হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ঘুম দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ক্ষমতা তাদের আস্থাভাজন দলের হাতে তুলে দিক জনগণ, সেটা সমস্যা না। সমস্যা হলো নিজেদের হাতে কিছুই না রেখে সম্পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দেওয়া। সমস্যা হলো কেউ প্রশ্ন তুললে যৌক্তিক উত্তর না দিয়ে তাকে দীর্ঘসময়ের শত্রু করে তোলার ও নাজেহাল করার প্রবণতা।
ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন, জনগণ যদি ক্ষমতার ভাগ নিজেদের হাতে না রাখে, সরকারকে জবাবদিহিতার মধ্যে না রাখে, তাহলে স্বাধীনতা চুরি হতে খুব বেশিদিন সময় লাগবে না। আবেগ বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে হতে হবে ক্ষমতাবান, সন্দেহপ্রবন এবং রাজশক্তির সমালোচক। ক্ষমতার হাত বদলে দেশ বদলায় না, দেশ বদলায় লাঠি হাতে ক্ষমতাসীন দলকে সোজা রাখার মাধ্যমে। এই বিপ্লব যদি জনগণের মধ্যে না ঘটে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে স্বাধীনতা সঙ্গ দিবে না, যেই দলই ক্ষমতায় আসুক।
মালিহা নামলাহ।শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়