জুলাই অভ্যুত্থান রিলেটেড একটা রিসার্চের অংশ হিসেবে একটি ওয়ার্ড ক্লাউড জেনারেট করলাম কিছুদিন আগে। ডাটাসেটের প্রতিটা রো অভ্যুত্থানের একেকটা প্রটেস্ট/মিছিল/ইভেন্ট রিপ্রেজেন্ট করে, অনেকগুলোর সাথে কিছু নোটসও ছিলো, সেই নোটগুলো ইউজ করেই এটা আনা হয়েছে। খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার হচ্ছে, এই পুরো গ্রাফিকে নির্বাচন (Election) কথাটা একবারও আসে নাই, বাট সংস্কার (Reform) শব্দটা একাধিকবার এসেছে। যদিও আদতে এতে খুব অবাক হওয়ার কিছু নাই, কারণ আমরা যারাই আন্দোলনে ছিলাম, সবারই মনে থাকার কথা যে ওই সময়ে নির্বাচন নিয়ে কারোরই মাথাব্যথা ছিলো না, জুলাইয়ের স্পিরিট ছিলো ফ্যাসিবাদের পতন আর রাষ্ট্র সংস্কার।
রাষ্ট্র সংস্কারের একটা অংশ সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই, কিন্তু বিএনপির পোষা জ্ঞানপাপী একটিভিস্টরা যেভাবে অভ্যুত্থানের মূল ফোকাস হিসেবে নির্বাচনকে সামনে নিয়ে আসছে, সেটা একেবারে ডাহা মিথ্যা আর ন্যারেটিভ শিফটের চেষ্টা ছাড়া কিছু না। যাই হোক, সংস্কার, বিশেষ করে সংবিধান, সরকার কাঠামোর সংস্কার কেন সবার আগে দরকার সেটা সম্ভবত আমাদের জেনারেশনের অনেকেই এখনো বুঝে না (অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করে)। বিএনপি ঠিক কি কারণে এই মহাগুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো, আর ক্ষমতায় আসলে কিভাবে আগের বস্তাপঁচা সিস্টেমের অপব্যবহার করবে এসব বোঝা দরকার। কারণ ২,০০০ এর কাছাকাছি মানুষের রক্ত এতো সহজে ব্যর্থ হয়ে যেতে দেয়া যাবে না.. সহজ কথা!
বাংলাদেশে মোটামুটি স্ট্যাবল গণতন্ত্র আসে ১৯৯১ সালে। এরপর থেকে প্রায় সব নির্বাচনের সময়ই জাতীয় সংকট দেখা দিয়েছে আর এই সংকটগুলার মূল কারণ পার্লামেন্টে মেজরিটির অপব্যবহার আর বিএনপি – আওয়ামী লীগের মুনাফেকি! ১৯৯১ এ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি ৯০ এর গণ আন্দোলনের প্রত্যেকটা সমঝোতার বরখেলাপ করে.. এরপর মাগুরা উপনির্বাচনের কারচুপি আর ১৯৯৬ এ একদলীয় নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা। ২০০১ এ প্রচুর মানুষ মারা যায় নির্বাচনের সময় সহিংসতায়.. তবে বড় ধরনের কোন অচলাবস্থা ক্রিয়েট হয় নাই, কেন হয় নাই সে ডিস্কাশনে একটু পরে যাই।
প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সাংবিধানিকভাবে শেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কথা। ২০০৬ এ বিএনপি – জামায়াত সংবিধান সংস্কার করে বিচারপতির অবসরের বয়স এমনভাবে বাড়ায় যাতে নিজেদের পছন্দের কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন। এই কারসাজির ফলাফল? লগি বৈঠার ভয়ংকর এক আন্দোলন আর ওয়ান ইলেভেন! এরপর ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে তো আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টে ২০০+ আসনের সুবিধা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দিলো! একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায়, ২০০৬ আর ২০১৩, দুইবারই দেশের ওই অচলাবস্থায় চলে যাওয়ার কারণ ছিলো সংসদে দুই তৃতীয়াংশ আসন থাকলেই যেভাবে ইচ্ছা সংবিধান চেঞ্জ করে ফেলার ক্ষমতাটা সরকারি দলের কাছে থাকা।
ঠিক এই কারণেই হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০০১ এ চাইলেও তেমন ঝামেলা করতে পারে নাই, কারণ তাদের মেজরিটিই ছিলো না! বাংলাদেশের যেকোনো নির্বাচনে ২০০+ আসন পাওয়া খুব কঠিন কিছু না (ভারতের মতো বড় দেশগুলার তুলনায়) যদি নিজেদের পক্ষে ফ্লো থাকে, এরাউন্ড ৪১% ভোট দিয়েই বিএনপি ২০০১ এ ২০০+ আসন পেয়ে গেসিলো। তাই যতদিন সংবিধান সংশোধনের প্রসেস আরো কমপ্লিকেটেড, আরো প্রতিনিধিত্বশীল না করা হবে, ততদিনই সরকারি দল এই পাওয়ারটাকে মিসইউজ করে বাংলাদেশের ডেমোক্রেসির কবর রচনা করবে।
এজন্যই সংবিধান সংস্কার কমিশন খুব চমৎকার একটা প্রস্তাব আনলো রিসেন্টলি। সেটা কি?
সেটা হচ্ছে সংসদে একটা উচ্চকক্ষ থাকবে অন্যান্য বিভিন্ন দেশের আদলে, সংবিধান সংস্কারের জন্য নিম্ন আর উচ্চ দুই কক্ষেই ২/৩ মেজরিটি লাগবে, আর মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, উচ্চকক্ষের আসন বিন্যাস হবে জাতীয় নির্বাচনে দলগুলার পাওয়া টোটাল ভোটের পারসেন্টেজ অনুযায়ী। সো কোন দল যদি ২৫% ভোট পেয়েও নিম্নকক্ষে খুব কম আসন পায়, উচ্চকক্ষে ঠিকই তারা ২৫টা সিট পাবে। এটায় সুবিধা কি? প্রথমত, ওই ২৫% মানুষের একটা প্রপার রিপ্রেজেনটেশন সংসদে থাকলো। দ্বিতীয়ত, যখন ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা সংবিধান কাটাছেঁড়া করা থেকে সরকারি দলগুলোকে আটকানো যাবে। কারণ ২০০টা আসন পাওয়া খুব সম্ভব হলেও একটা দেশের ৬৬.৬৭% মানুষের ভোট টানা খুবই কঠিন। এটায় পাওয়ারের একটা ব্যালেন্স আসবে.. সংসদে বিরোধী দলগুলারও চমৎকার ভূমিকা রাখার চান্স থাকবে।
খুবই চমৎকার না? বাট গেস হোয়াট.. বিএনপি এই প্রতিনিধিত্বশীল উচ্চকক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। তাদের দাবী হচ্ছে নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যার অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বন্টন করতে হবে। তাহলে আর উচ্চকক্ষের দরকারটা কি? এমন তো না যে উচ্চকক্ষে কেউ নিজের দলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে দলকে সাবোটাজ করবে। আসল কথা হচ্ছে বিএনপি সেই ১৯৯৬ আর ২০০৬ এর মতোই সংবিধান কাটাছেঁড়ার স্বাধীনতা চায়, আর যেহেতু তারা কনফিডেন্ট যে মেজর কোন অপনেন্ট না থাকায় তারা মেজরিটি পাবেই, তাই তারা এতো অবভিয়াস আর গুরুত্বপূর্ণ একটা সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, আর তাদের নির্লজ্জ একটিভিস্টরা এটার সাফাইও গাচ্ছে। এটা সরাসরি জুলাইয়ে যে স্বপ্ন আমাদের চোখে ছিলো, সেটার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দ্বিতীয় আরেকটা বিশাল ফ্ল হলো সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে রীতিমতো ডিক্টেটর লেভেলের ক্ষমতা দিয়ে রাখা। এই ব্যাপারটা আমরা অনেকেই ভালোভাবে জানি না বা বুঝি না। একটা প্রপার ডেমোক্রেসিতে ক্ষমতার চেক এন্ড ব্যালেন্স খুবই ইম্পর্ট্যান্ট, যাতে কেউ বেশী ক্ষমতা পেয়ে গিয়ে সেটার অপব্যবহার না করতে পারে। এজন্যই সব সফল গণতান্ত্রিক দেশে সরকারপ্রধানের পাওয়ার কিছুটা কারটেইল করে অন্যদের ডিস্ট্রিবিউট করা হয়। এজন্যই ট্রাম্পের একের পর এক অধ্যাদেশকে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করতে পারে বিভিন্ন স্টেট, বরিস জনসনকে রিজাইন করতে বাধ্য করা যায়, আর সবচেয়ে ভালো এক্সাম্পল দক্ষিণ কোরিয়ার, যেখানে সরকারপ্রধান মিলিটারি রুল জারি করার ২৪ ঘন্টার মধ্যে সংসদ সেটাকে রিভার্ট করে ফেলে।
২০০৬ আর ২০১৩, দুইবারই দেশের ওই অচলাবস্থায় চলে যাওয়ার কারণ ছিলো সংসদে দুই তৃতীয়াংশ আসন থাকলেই যেভাবে ইচ্ছা সংবিধান চেঞ্জ করে ফেলার ক্ষমতাটা সরকারি দলের কাছে থাকা।
বাংলাদেশের সংবিধানে আনফরচুনেটলি.. প্রধানমন্ত্রীর এতোই বেশী ক্ষমতা, যে এ ধরনের কিছু কল্পনাও করা যায় না (যদি না নিজের দলেই সবাই বিপক্ষে চলে যায়), এবং ঠিক এই ব্যাপারটাই শেখ হাসিনাকে একজন প্রপার ডিক্টেটর হয়ে উঠতে হেল্প করে আসছিলো। এই কারণেই বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে রীতিমতো একটা কাল্ট গড়ে উঠে। ইন্টেরিম সরকারের সংস্কার কমিশন এই ব্যাপারটাও এড্রেস করে খুব সুন্দরভাবে।
প্রথমত, প্রধানমন্ত্রীর বেশ কিছু ক্ষমতা কিছুটা কমানো (বলে রাখা ভালো, প্রধানমন্ত্রী স্টিল বাই ফার সবচেয়ে পাওয়ারফুল থাকবে, বিএনপি যতই মিথ্যা কথা বলুক এ নিয়ে).. পাশাপাশি কেউ দুই মেয়াদের বেশী প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে এই প্রস্তাবগুলি রীতিমতো পরীক্ষিত.। এরপরেও বিএনপি এজ ইউজুয়াল এসবের বিরুদ্ধে! কারণ তারা তো ভাবছে তারাই নির্বাচন জিতবে তাহলে নিজের ক্ষমতা কেন কমাবে? “পরপর” ৩ বার না হলে ২+ বার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে এ প্রপোজালটাতো রীতিমতো হাস্যকর!
চাইলে সংস্কার কমিশনের অনেক প্রস্তাব নিয়েই এমন আলোচনা করা যায় যেসবের বিরোধিতা করেছে বিএনপি বা অন্য কিছু দলও (যেমন জামায়াত আর্টিকেল ৭০ বাদ দেয়ার বিপক্ষে)। বিএনপির কিছু নেতা আরেকটা মিথ্যা কথা বারবারই বলে.. সেটা হচ্ছে এই সরকারের ম্যান্ডেট নাই, তাদের কাজ হচ্ছে কেবল নির্বাচন করা, সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার।
প্রথমত, এই সরকারের চেয়ে বড় ম্যান্ডেট ১৯৭০ এর পরের কোন সরকারেরই ছিলো না। বিএনপি দিনের পর দিন নির্বাচন এর কথা বলে মানুষকে আন্দোলনে ডাকার পরেও মানুষ ভুলেও রাস্তায় নামে নাই.. কারণ সিস্টেম চেঞ্জ না হলে ক্ষমতার পালাবদল হয়ে খুব বেশী লাভ নাই এটা আমরা জানতাম। মানুষ কখন নামলো? ছাত্রদের ডাকে.. যখন দেখলো এবার রাষ্ট্রের মৌলিক সমস্যাগুলা সমাধানের একটা সম্ভাবনা আছে। কাজেই এই সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে সেই সমস্যাগুলার সমাধান করা, তথা সংস্কার করা।
এই সরকারের প্রধান কাজ হলো অতীতের নির্বাচিত সরকারগুলো যেভাবে ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইনে পরিণত হয়েছিলো, যেভাবে ক্ষমতায় এসেই মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলো, সেটা যাতে ভবিষ্যতে না হয় এই ব্যাপারটা এনসিওর করা! এই কাজ কোন নির্বাচিত সরকার করবে না, করার কথাও না, কারণ কেউই যেচে পড়ে নিজের ক্ষমতা কমাবে না, বিএনপির নিজের ইতিহাসই এর প্রমাণ। এই কাজ ইন্টেরিমকেই করতে হবে.. এবং নির্বাচন এসবের পরেই হতে হবে। বিএনপি বাধা না দিলে এই বেসিক চেঞ্জগুলো করতে বেশী সময় লাগার কথাও না।
আমাদের নিজেদেরও বুঝতে হবে, কারা আসলে জুলাইয়ের শহীদদের রক্তের সাথে গাদ্দারি করছে, কাদের সাথে এখন আগের ফ্যাসিবাদী শক্তি আর প্রতিবেশী দেশ একই সুরে কথা বলছে, কেন বলছে। কেন রীতিমতো দেশ বিক্রি করে দেয়া, সবধরনের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া, লুট করা রেজিম থেকে মুক্ত হওয়াকেও কেউ কেউ দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে নারাজ! সত্যি বলতে বিএনপি জামায়াত বা ইভেন এনসিপিকে নিয়েও আমি খুব একটা আশাবাদী না.. কিন্তু ঠিকভাবে সংবিধান, সরকার ব্যবস্থার সংস্কার করা গেলে যদি ভুল পক্ষকেও ক্ষমতায় আনে মানুষ, তবুও ৪/৫ বছর পর মানুষই তাদের টেনে নামাতে পারবে। কিন্তু সংস্কার না করে আবার আগের ভুলগুলোই চলতে দিলে আমরা হয়তো আর কখনো ভোটই দিতে পারবো না।
আমরা এবার যে সুযোগ পেয়েছি, এটা আর কখনো আসবে না! এবার এই মগের মুল্লুক ফিক্স না করতে পারলে ২০০০ প্রাণ বৃথা হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক, এই সুযোগ যাতে আমরা না হারাই, হারাতে না দেই!
সাইফুল বারী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন লেকচারার
Leave A Reply