বাংলাদেশে গণমাধ্যমের মালিকানা কাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত। বসুন্ধরা গ্রুপের মতো কর্পোরেট হাউসগুলোর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের উপর মালিকানার একচেটিয়া দখল মূলত গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী। কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও The Daily Sun–এই তিনটি পত্রিকায় ৮ এপ্রিল একই রিপোর্টের সিন্ডিকেটেড প্রকাশ মূলত Maxwell McCombs ও Donald Shaw-এর “Agenda-Setting Theory”-এর বাস্তব প্রতিফলন। যেখানে মিডিয়া শুধু ঘটনার প্রতিবেদন করে না, বরং কী নিয়ে জনতা ভাববে, সেটাও নির্ধারণ করে দেয়।
পলিটিক্যাল ইকনমি অব মিডিয়া বিশ্লেষক Robert McChesney এবং Noam Chomsky-এর মতে, গণমাধ্যম কর্পোরেট মালিকানার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে সংবাদ আর জনগণের সেবায় থাকে না; বরং তা হয় মালিকানার স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার। বসুন্ধরা গ্রুপের তিনটি পত্রিকায় একই হেডলাইন ও রিপোর্ট ছাপা হওয়া এই কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের স্পষ্ট উদাহরণ। একে বলা যায় “manufacturing consent” — যেখানে মতপ্রকাশের বৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে একমুখী বিবৃতি প্রতিষ্ঠা পায়।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’ নীতি মূলত মিডিয়া প্লুরালিজম বা বহুধাবাচকতার পক্ষে দাঁড়ায়। এটি Habermas-এর গণপরিসরের (Public Sphere) ধারণার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। যেখানে নাগরিকদের মুক্ত ও বহুমুখী মত প্রকাশই গণতন্ত্রের ভিত্তি। এক মালিকের একাধিক মিডিয়ার মাধ্যমে সংবাদ ট্রিটমেন্টের অভিন্নতার ফলে ৫টি দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায়। যেমন :-
১. মালিকানা কাঠামো ও মিডিয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রায়ন: বসুন্ধরা উদাহরণ
বাংলাদেশে কর্পোরেট মিডিয়া মালিকানার জটিলতা ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে। বসুন্ধরা গ্রুপের মতো বহুমাত্রিক ব্যবসায়িক কনগ্লোমারেট যখন একইসঙ্গে তিনটি জাতীয় পত্রিকা পরিচালনা করে এবং একযোগে এক ধরনের সংবাদ পরিবেশন করে, তখন তা শুধু সাংবাদিকতা নয়, গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই কেন্দ্রায়ন Ben Bagdikian-এর “Media Monopoly” ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে তিনি দেখান, কিভাবে কয়েকটি বৃহৎ কর্পোরেট হাউস সংবাদ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জনমতকে প্রভাবিত করে থাকে। বসুন্ধরার তিনটি পত্রিকা – কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও The Daily Sun – একই ভাষায়, একই শিরোনাম ও কনটেন্টে সংবাদ ছাপিয়ে সাংবাদিকতার বহুত্ববাদ নষ্ট করছে।
২. সিন্ডিকেট রিপোর্টিং ও Agenda-Setting: পাঠকের উপর নিয়ন্ত্রণ
সিন্ডিকেট রিপোর্টিং এক ধরনের ‘নিউজ ম্যানুফ্যাকচারিং’, যেখানে সংবাদ তৈরি হয় সম্পাদকীয় স্বাধীনতার ভিত্তিতে নয়, বরং কর্পোরেট পলিসি অনুযায়ী। McCombs & Shaw-এর “Agenda-Setting Theory” অনুযায়ী, গণমাধ্যম কেবল তথ্য সরবরাহ করে না, বরং নির্ধারণ করে জনগণ কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভাববে। বসুন্ধরার মাধ্যমে পরিচালিত তিনটি পত্রিকার একযোগে এক সংবাদ পরিবেশন এজেন্ডা সেটিংয়ের একটি সুস্পষ্ট কৌশল। এটি framing theory সঙ্গেও মিলে যায় – যেখানে ঘটনাকে নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়, যাতে পাঠক নির্ধারিত ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়।
৩. পলিটিক্যাল ইকনমি অব মিডিয়া: তথ্য বাজারে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ
Vincent Mosco তার “Political Economy of Communication” বইয়ে বলেন, গণমাধ্যম এক ধরনের ‘commodified’ পণ্য, যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। বসুন্ধরা গ্রুপের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংবাদপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। এই মিডিয়াগুলো প্রতিদিন মিলিয়ন কপি ছাপায়, যার মাধ্যমে তারা একদল পাঠকের মানসিক কাঠামো গড়ে তোলে – অর্থাৎ মিডিয়া আর জনসেবামূলক নয়, বরং কর্পোরেট এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’ নীতি আদতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং মালিকানা বৈচিত্র্যের নামে একটি কর্তৃত্ববাদী হস্তক্ষেপ হয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্র যখন নির্ধারণ করে কে কতগুলো গণমাধ্যম পরিচালনা করতে পারবে, তখন তা বাজার অর্থনীতির ‘মুক্ত নীতি’র বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়।
৪. পাঠকের ক্ষতি ও গণতান্ত্রিক ঝুঁকি
একই মালিকানায় পরিচালিত একাধিক সংবাদমাধ্যম ভিন্ন মত ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের সুযোগ সীমিত করে দেয়। Jürgen Habermas-এর “Public Sphere” ধারণায় গণমাধ্যম একটি উন্মুক্ত মত বিনিময়ের ক্ষেত্র হওয়া উচিত যেখানে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি স্থান পায়। কিন্তু বসুন্ধরার সিন্ডিকেটিং প্রক্রিয়া জনগণের সামনে বিকল্প ব্যাখ্যার সুযোগ হরণ করছে। ফলস্বরূপ, পাঠক একমুখী সংবাদ পাচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তথ্যের বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে।
৫. ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’ নীতির তাৎপর্য
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’ আসলে একটি গঠনমূলক হস্তক্ষেপ। এটি মিডিয়া মালিকানার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে পারে, যার ফলে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে উঠবে এবং সাংবাদিকতা পেশার পেশাদারিত্ব বজায় থাকবে। এটি media pluralism-এর ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে – যার মাধ্যমে বিভিন্ন মত, ভিন্ন কণ্ঠ ও বিকল্প ব্যাখ্যাগুলো প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়। একই কোম্পানি একাধিক সংবাদমাধ্যম চালালে সেই বহুত্ববাদ হারিয়ে যায়।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সমালোচনা:
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’ নীতি আদতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং মালিকানা বৈচিত্র্যের নামে একটি কর্তৃত্ববাদী হস্তক্ষেপ হয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্র যখন নির্ধারণ করে কে কতগুলো গণমাধ্যম পরিচালনা করতে পারবে, তখন তা বাজার অর্থনীতির ‘মুক্ত নীতি’র বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। গণমাধ্যম মালিকানা নিয়ন্ত্রণের এমন উদ্যোগ একদিকে যেমন ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে, অন্যদিকে কর্পোরেট সাংবাদিকতা থেকে গড়ে ওঠা বিশাল কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো হুমকির মুখে ফেলে। মূলত, নীতি বাস্তবায়নের নামে এটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপের পথ প্রশস্ত করতে পারে, যেখানে পছন্দনীয় মালিকানাকে টিকিয়ে রেখে বিরুদ্ধ স্বরকে দমন করা সহজ হবে।
এছাড়াও- ‘এক মালিক, এক গণমাধ্যম’ নীতিটি বাস্তবতা ও প্রযুক্তিগত বিবর্তনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আজকের ডিজিটাল যুগে একটি মালিকানার অধীনেই পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টাল ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম—সবগুলো মিলেই একটি মিডিয়া ইকোসিস্টেম তৈরি হয়। একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করার মানে হলো সেই ইকোসিস্টেমকে ভেঙে দেওয়া, যা তথ্য পরিবেশকে আরও দুর্বল ও খণ্ডিত করে তুলবে। এই নীতির ফলে বড় গ্রুপগুলোর বিকল্প তৈরি হওয়া তো দূরের কথা, বরং তারা তাদের প্রভাব অন্য উপায়ে বিস্তার ঘটাবে—যেমন ছদ্ম মালিকানা বা ভিন্ন রেজিস্ট্রেশন। ফলে, প্রকৃত সমস্যার সমাধান না হয়ে এটি হয়ে উঠবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের আরেকটি উপকরণ।
বসুন্ধরা আজকেই প্রথম করেনি :
আজ একযোগে সিন্ডিকেট রিপোর্ট ছাপিয়েছে। সবগুলো রিপোর্টের ট্রিটমেন্ট প্রথম পাতায়, ক্রেডিটলাইন, হেডলাইন! আশ্চর্যের বিষয় হলো – তিনটি সংবাদপত্র ভিন্ন হলেও নিউজ কিন্তু একই! এটাই মিডিয়ার সিন্ডিকেট রিপোর্টিং ও এজেন্ডা সেটিং। সাংবাদিকতায় এজেন্ডা সেটিং ও সিন্ডিকেট রিপোর্টিং এতদিন আমরা এদেশে তত্ত্বীয়ভাবে পড়লেও বসুন্ধরার মালিকানায় গণমাধ্যমগুলো গত ৪ মাস ধরে এরকম প্রায় ১৬টি ব্যবহারিক নমুনা উপস্থাপন করেছে।
টম এন্ড জেরি খেলার শেষ কোথায়?
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একক মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকা বা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের যে প্রভাবক ক্ষমতা, তা নিজ স্বার্থে কেন্দ্রীভূত করে। সে কারণে এই ব্যবস্থার অবসান হওয়া দরকার। বিদ্যমান এ ব্যবস্থার দ্রুত সমাধান করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, একই সাবান একাধিক মোড়কে বাজারজাত করা যেমন বাজারের প্রতিযোগিতাকে নষ্ট করে, একই মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকাও গণমাধ্যমের প্রতিযোগিতাকে নষ্ট করে এবং পাঠক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বসুন্ধরা বাংলাদেশের প্রভাবশালী গ্রুপ। সাংবাদিকতায় বহু মানুষের কর্মসংস্থানও করেছে তারা। এদিকে সরকার সংস্কার কাজে জোর দিচ্ছে। এক উদ্যোক্তার একটি গণমাধ্যম (ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া) নীতি কার্যকর করাই গণমাধ্যমের কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধের সেরা উপায় বলে মনে করে কমিশন। এখন দেখার বিষয়, বসুন্ধরা বনাম সরকারের এই টম এন্ড জেরি খেলার শেষ কোথায়!
রাজীব নন্দী, সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Leave A Reply