নিম্নোক্ত পদগুলোতে বর্তমানে কে নিয়োগ দেন? কে সিদ্ধান্ত নেন যে কোন ব্যক্তিকে এইসব পদে নিয়োগ করা হবে?
– নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার;
– অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলগণ;
– সরকারী কর্ম কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার;
– দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার;
– মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার;
– প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার;
– প্রতিরক্ষা- বাহিনীসমূহের প্রধান
বর্তমান ব্যবস্থাঃ রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রীর “পরামর্শ” নিয়ে। সহজ বাংলায় প্রধানমন্ত্রী ঠিক করেন কাকে নিয়োগ করবেন এই সব পদে।
এতে সমস্যাটা কী হইসে?
সমস্যাঃ ধরেন, আপনি আপনার দোকানে একজন ক্যাশিয়ার রেখেছেন। এখন ক্যাশিয়ার যাতে চুরি না করে, কাজ ঠিকমতো করে, এইজন্য আপনার একজন লোক লাগবে। এখন এই পাহারাদারকে কে নিয়োগ দিবে? ক্যাশিয়ার? ক্যাশিয়ার যদি নিজে কেবল তার পছন্দের লোককে নিয়োগ করে তার ওপর নজরদারি করার জন্য, তাহলে আপনার দোকানের অবস্থা কেমন হবে?
এইবার চিন্তা করুন – আপনি, দোকান মালিক, আসলে দেশের জনগণ। ক্যাশিয়ার সরকার বা প্রধানমন্ত্রী, আর এই নজরদারি করার লোক হচ্ছে সাংবিধানিক বিভিন্ন পদে থাকা মানুষজন – যাদের কাজ হচ্ছে সরকার যাতে জনগণের ক্ষতি না করে তা নিশ্চিত করা। জনগণ ভোট দিয়ে সরকারকে তাদের দেখভালের দায়িত্ব দেয়। সরকার কাজ ঠিকমতো করছে কিনা সেটা দেখেন সাংবিধানিক এইসব পদে থাকা লোকজন। এরা যখন এদের কাজ ঠিকমতো করতে পারে না, তখন জনগণকে রাস্তায় নামতে হয়।
তাহলে সমস্যা কী? প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন তাদেরকে যাদের কাজ সরকারকে নজরদারিতে রাখা।
সমাধান কী?
সংবিধান সংস্কার কমিশন একটা সমাধান প্রস্তাব করেছে। তারা বলেছে যে তারা একটা কমিটি বানাবে। এটার নাম ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’। এই কমিটিতে থাকবে কারা?
– রাষ্ট্রপতি,
– প্রধানমন্ত্রী,
– বিরোধীদলীয় নেতা,
– নিম্নকক্ষের স্পিকার,
– উচ্চকক্ষের স্পিকার,
– বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি,
– বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার,
– বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার,
– সরকারি দল এবং বিরোধী দলের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সদস্যরা বাদ, আইনসভার উভয় কক্ষের অন্য সব দলের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাদের মধ্য থেকে মনোনীত ১ জন সদস্য
এই প্রস্তাব কীভাবে আমাদের সমস্যার সমাধান করে? এই প্রস্তাবে শুধু সরকারি দলের না, বিরোধী দল, এবং অন্যান্য দলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকে। প্রধানমন্ত্রী চাইলেই মনমতো কাউকে নিয়োগ দিতে পারবেন না। আলোচনা করতে হবে আরো আটজন মানুষের সাথে, যাদের মধ্যে অনেকে তার দলের লোক না। এতে একটা দামাদামি হবে সরকারপক্ষ আর তাদের বিরোধীপক্ষের মধ্যে। সরকার পক্ষ মনমতো কারো নাম প্রস্তাব করতে পারবে না। বিরোধীপক্ষও সবাইকে বাতিল করতে পারবে না। তাদের মাঝামাঝি একটা জায়গায় আসতে হবে।
এর ফলে যাদের নিয়োগ হবে, তারা জানে যে তারা কেবল প্রধানমন্ত্রীর মনের ইচ্ছার কারণে এই চাকরি পান নাই। সবাই একমত হয়ে তাদেরকে এই চাকরি দিয়েছে। আমরা আশা করতে পারি যে এই লোকগুলো মন দিয়ে তাদের কাজ করবেন, কেবল প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে কাজ করবেন না। সরকার খারাপ কাজ করলে তখন তারা সাহস নিয়ে খবরদারি করতে পারবেন।
এটা কী আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য সবচাইতে ভালো প্রস্তাব? না। কিন্তু এটা একটা প্রস্তাব। এটা সমস্যাটাকে সমস্যা বলে। সমাধানের একটা ব্যবস্থা আমাদেরকে বলে।
বিএনপি বলেছে তারা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল চায় না। প্রধানমন্ত্রীই নিয়োগ করবেন এই সব সাংবিধানিক পদে। তাদের বক্তব্য –
“এই কাউন্সিল করা হলে সরকার দুর্বল হবে” (প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল)
তাহলে তারা কি সমস্যাটা স্বীকার করে? এই কাউন্সিল যদি ভালো সমাধান না হয়, তাহলে তাদের বিকল্প প্রস্তাব কী? নাকি বর্তমান ব্যবস্থা যার কারণে তারা ১৬ বছর দৌড়ের উপর ছিলো সেটাই ভালো ছিলো?
আরেক জায়াগায় দেখলাম তারা বলেছে –
“যখন সংসদ থাকবে না, সেই সময়ে এনসিসির পাঁচ সদস্যের চারজনই থাকবেন অনির্বাচিত। সংবিধানের মূল নির্যাস হলো, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির শাসন।” (সমকাল, ২৩ এপ্রিল)
যখন সংসদ ভেঙে যাবে, সাংবিধানিক কাউন্সিলে কারা থাকবেন? রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, আর প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত দুইজন উপদেষ্টা। একই তো লোক, দুই জায়গায়। প্রধান উপদেষ্টা, আর অন্য দুই উপদেষ্টা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থাকলে সমস্যা নাই, কিন্তু জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলে থাকলে সমস্যা?
যখন সংসদ থাকবে না, তখন তো এমনিতেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নাই। অনির্বাচিত লোকজনে ভরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এতো ভালো লাগলে, সাংবিধানিক কাউন্সিলে অনির্বাচিত লোক থাকলে সমস্যাটা কী? কোন কারণে অনির্বাচিত উপদেষ্টারা ভালো, কিন্তু অনির্বাচিত সাংবিধানিক কাউন্সিলের লোকজন খারাপ? যখন সংসদ ভেঙে যাবে, সাংবিধানিক কাউন্সিলে কারা থাকবেন? রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, আর প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত দুইজন উপদেষ্টা। একই তো লোক, দুই জায়গায়। প্রধান উপদেষ্টা, আর অন্য দুই উপদেষ্টা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থাকলে সমস্যা নাই, কিন্তু জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলে থাকলে সমস্যা?
সমস্যা হয়তো আছে। সেটা খুলে বলুক। কিন্তু আপনি সেটা দেখবেন না। প্রধান বিচারপতি অনির্বাচিত লোক। তাকে বাদ দিয়ে এই কাউন্সিল করলে ভালো হবে? তাহলে সেটা বলুক। আপনি সেটাও দেখবেন না।
সবচাইতে ভয়ংকর কাজটা করে টিভি মিডিয়া। এই পুরো আলাপটাকে মিসরিপ্রেজেন্ট করে এইভাবে –
“অনির্বাচিত লোকজন দিয়ে ভরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল মানবে না বিএনপি।”
আর কোনো ইনফরমেশন দেয় না। সাংবিধানিক কাউন্সিলে আসলে কতোজন থাকবে? কতোজন নির্বাচিত? কতোজন অনির্বাচিত? কখন অনির্বাচিত লোক বেশি? এটা দুটি কারণে হতে পারে। এক – তাদের এই সক্ষমতা নাই এই প্রস্তাবকে সহজে বোঝার বা বুঝায় বলার, আর বিএনপির বক্তব্যকে খোঁচায় দেখার – যে আসলে ঘটনা কী।
দুই – তারা ধরে নিয়েছে যেহেতু বিএনপি সরকার গঠন করবে, আমরা গা বাঁচাই। তারা সেলফ-সেন্সর করতেসে। আমার মতো বোকাসোকা লোক যদি ১০ মিনিট অনলাইনে ছাপা খবর পড়ে বিএনপির কথায় এই ঘাপলাগুলা ধরতে পারে, তাদের ধরতে না পারার কোনো কারণ নাই। সুতরাং দ্বিতীয়টাই ঘটছে বলে ধরে নিচ্ছি।
সংস্কারের সবচাইতে বড় সমস্যাটা হচ্ছে এটা চাপা পড়ে গিয়েছে এর ভারী নামের নিচে, আর এর ব্যাপক কলেবরের ভারে। সব আলোচনা সমাধান প্রস্তাব নিয়ে। কোনো আলোচনা সমস্যা নিয়ে না। আমরা কি সমস্যাগুলো স্বীকার করি? সমাধান ভালো না লাগতে পারে, কিন্তু এই সমস্যাগুলো সমাধান করা দরকার, সরকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার – এই বিষয়ে কি আমরা একমত?
অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কাছে এখনো মনে হয় – যারা সংস্কার চান, তারা মেসেজগুলাকে সমাধান দিয়ে ফ্রেম না করে, সমস্যা দিয়ে ফ্রেম করলে বেশি পপুলার সাপোর্ট পাবেন। রাজনৈতিক দলগুলার উপরে বেশি চাপ দিতে পারবেন।
ইয়াসিন শাফি, পিএইচডি শিক্ষার্থী, পলিটিক্যাল সায়েন্স, পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি
Leave A Reply