উপদেষ্টা মাহফুজ আলম লিখেছেন, “৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে।” আমি একমত। তবে দ্বিমত করছি যখন তিনি লেখেন, “যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে।”
১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ যাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে, মাহফুজ না তাদের পরিবারের সদস্য, না ভুক্তভোগী। তাকে এই অধিকার কে দিয়েছে জামায়াতকে ক্ষমা করে দেওয়ার? ঠিক যেমনভাবে আমি ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের হাতে হওয়া নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার চাই, সেই একই যুক্তিতে ১৯৭১ সালের গণহত্যার দায়ে জামায়াতের বিচার চাই। ঠিক যে কারণে আওয়ামী লীগের সংগঠন হিসেবে বিচার হওয়া উচিৎ, ঠিক একই কারণে জামায়াতেরও সংগঠন হিসেবে বিচার করতে হবে।
তবে মাহফুজ কেন শুধু আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধতা চান, কিন্তু জামায়াতকে ক্ষমা চাইলেই রাজনীতির সুযোগ দিতে চান? বিচার কেন পার্টি ভেদে ভিন্ন হবে? বিচার ও আইন সবার জন্য সমান হতে হবে, তাই নয় কি?
যদি বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক রাজনীতি পেতে হয়, তবে ১৯৭১-এর অপরাধের যেমন বিচার ও ক্ষমা জরুরি, তেমন ২০২৪-এর হত্যাকাণ্ডের বিচার ও ক্ষমা জরুরি। আপনি একজনের ক্ষেত্রে শুধু ক্ষমা গ্রহণ করবেন (যদিও তারা এই ক্ষমা কখনোই চায়নি, এমনকি এখন স্লোগান দেয় গোলাম আযমের বাংলায়) আর আরেকজনের ক্ষেত্রে বিচার চাইবেন, ক্ষমার সুযোগ রাখবেন না, তা কি পক্ষপাতিত্ব নয়?
রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এমন দ্বৈত নীতি নিয়ে রাজনীতির মৌলিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে নীতি এক হতে হবে—যে দল বা ব্যক্তি মানবতাবিরোধী অপরাধ করবে, ক্ষমতায় থাকতে অন্ধ হয়ে দেশের নাগরিকদের হত্যা করবে, তাদের একই আইনে বিচার করতে হবে, প্রতীকী অর্থে হলেও শাস্তি দিতে হবে। অতঃপর, যদি তারা অনুতপ্ত হয়, তবে ক্ষমার সুযোগ রাখতে হবে। তবে বিচার না করে শুধু ক্ষমা দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা যাবে না, এমনকি তা যদি অপরাধের ৫০ বছর পরও হয়।
গোলাম আযম মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে লবিং করেছেন, যাতে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়। তিনি হজের সময় বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডা করেছেন। ১৯৭২ সালে রিয়াদে ইসলামি যুব কনফারেন্সে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার দাবি করেছেন, লন্ডনে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি তৈরি করেছেন। ১৯৭৩ সালে লিবিয়ার বেনগাজিতে মুসলিম পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। ১৯৭৩ এ সৌদির বাদশাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অনুরোধ করেছেন
এবার আসুন দেখি ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী কারা? মূল যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তান আর্মি। তাদের সহযোগী হিসেবে যুদ্ধাপরাধ করেছে জামায়াতে ইসলামি। চীনপন্থী বামপন্থিরাও কম যায় না। যারা বিস্তারিত পড়তে চান, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫তম খণ্ড একবার ঘুরে আসবেন। তবে যেহেতু এখানে জামায়াত নিয়ে আলাপ করছি, তাই তাতেই সীমাবদ্ধ থাকি। পরের লেখায় চীনপন্থী বামপন্থিদের নিয়ে লেখা যাবে।
জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন (শিবিরের পূর্বের দল) সরাসরি পাকিস্তান আর্মিকে সাহায্য করে, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন পাকিস্তান সরকারের অনুগত গভর্নর আব্দুল মুত্তালিব মালিকের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানে যে সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই সরকারে জামায়াতে ইসলামি দলীয়ভাবে যোগ দিয়েছিল। চারটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিল তারা। অর্থাৎ জামায়াত গণহত্যাকারী সরকারের অংশ ছিল, শুধু বাইরে থেকে রাজনৈতিক সমর্থন দেয়নি। তখন গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির ছিলেন।
গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায় (১৯৯৪) 46 DLR (AD) (1994) 192 অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হকের সাবমিশন: গোলাম আযম মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে লবিং করেছেন, যাতে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়। তিনি হজের সময় বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডা করেছেন। ১৯৭২ সালে রিয়াদে ইসলামি যুব কনফারেন্সে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার দাবি করেছেন, লন্ডনে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি তৈরি করেছেন। ১৯৭৩ সালে লিবিয়ার বেনগাজিতে মুসলিম পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। ১৯৭৩ এ সৌদির বাদশাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অনুরোধ করেছেন।
ভোরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক দেখিয়েছিলেন, গোলাম আযম বলেছিলেন বাংলাদেশ নামের কিছু হলে সে আত্মহত্যা করবে। তো যে বাংলাদেশ হলে গোলাম আযম আত্মহত্যা করতেন, সেই বাংলাদেশে এসে জামায়াত-শিবির যখন স্লোগান দেয় “গোলাম আযমের বাংলায়”, যখন মাহফুজ শুধু বলেন “ক্ষমা চাইলেই হবে”—তবে কি আইরনি শোনায় না?
আমি মাহফুজকে সাধুবাদ জানাই, তিনি অন্তত জামায়াতের প্রশ্ন তুলেছেন। এর জন্য তাকে যথেষ্ট সমালোচনা নিতে হবে, জামায়াত-শিবির তাকে আক্রমণও করবে। তবে আমার এই লেখার উদ্দেশ্য মাহফুজকে সমালোচনা করা নয়, বরং একটি নৈতিক প্রশ্ন করা। যদি ২০১৪-এর অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগের সংগঠন ও দল হিসেবে বিচার হয়, ঠিক একই কারণে ১৯৭১ সালের অপরাধের জন্য জামায়াতের ব্যক্তিদের ও দলের বিচার হতে হবে।
আমি আন্তরিকভাবে চাই আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের বিচার হোক। অন্যথায়, আমাদের রাজনীতিতে যে সহিংসতার দুষ্টচক্র রয়েছে, তার থেকে আমরা বের হতে পারব না।
বিচার সবার জন্য সমান। আগে বিচার, পরে ক্ষমা।
আসিফ বিন আলী একজন শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক