শুরুতেই সমালোচনার মুন্ডপাত করাটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই মুন্ডপাত করার আগে একটু বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। আমরা সমালোচনা শব্দটার সাথে পরিচিত হলেও এর সঠিক সংজ্ঞা, ধারণা ও ব্যবহার অনেকেই জানি না অথবা ভুল প্রয়োগ করে থাকি। ভুল প্রয়োগটা কিভাবে করে থাকি সেটা খুঁচিয়ে বের করলেই সংজ্ঞা বের হয়ে আসবে। সোজা কথায় কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসবে।
আমরা সাধারণত সমালোচনা করতে এবং বলতে শুধু নেতিবাচক দিকটিকেই বুঝি। সমালোচনা শুধু নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা নয়। এই সহজ কথাটা আমরা জানি না বা মানতে চাই না। সমালোচনা যদি শুধু নেতিবাচক আলোচনা না হয় তাহলে এর সত্য সংজ্ঞা কি?
সমালোচনা হলো কোনো বিষয়ের ভালো-মন্দের তুলনামূলক আলোচনা। আরেকটু সহজভাবে যদি বলি তাহলে যেকোনো কিছুর ভালো এবং মন্দ দিকের আলোচনা। কিন্তু আমাদের ধারণা এই যে সমালোচনা মানেই মন্দ কথা।
আবার আমরা যারা সমালোচনার সত্য সংজ্ঞাটা জানি তাদের মধ্যে অনেকে কোনো এক অজানা কারণে মন্দ বা অনুন্নত দিকটার আলোচনা নিয়েই পড়ে থাকি। এটা সকল স্তরের মানুষের জন্য পচন স্বরুপ। কেননা, সমালোচনা সম্পর্কে মানবজাতির ধারণার মূল বা শিকড় মাটির অনেক গভীরে অবস্থিত। পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজ, দেশ- প্রত্যেক জায়গায় জালের মতো বিস্তার করছে।
সকল স্তরেই আমরা সমালোচনার ইজ্জত নষ্ট করি। যখন সমালোচনা করি তখন শুধু মন্দ দিকের আলোচনা করে যেমন এর মুন্ডপাত করি তেমনি যখন ধারণা করি তখনও একই কাজ করি। উদাহরণস্বরুপ, রাষ্ট্রের বিগত ১৫ বছরের সরকারব্যবস্থার তুলনা করলেই বিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার না হলেও টর্চের এক ঝলক আলোর মতো খানিকটা পরিষ্কার তো হবেই।
১৯৫২ সালে মানুষ জীবন দিয়েছিলো শুধু বাংলা ভাষায় পুস্তক রচনা করা কিংবা শুধুমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নয়। ১৯৫২ সালে মানুষ জীবন দিয়েছিলো আরও একটি কারণে আর সেটি হলো স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য।
সরকার পতনের আগে অস্পষ্টভাবে এবং পতনের পরে স্পষ্টভাবে এই দিকটা উঠে এসেছে। বিগত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারতো না, যেটিকে আমার ভাষায় বলি সমালোচনা। অথচ ১৯৫২ সালে মানুষ জীবন দিয়েছিলো শুধু বাংলা ভাষায় পুস্তক রচনা করা কিংবা শুধুমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নয়। ১৯৫২ সালে মানুষ জীবন দিয়েছিলো আরও একটি কারণে আর সেটি হলো স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য।
কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারব্যবস্থায় তাকেই পাকড়াও করা হতো যে ব্যক্তি স্বাধীনভাবে সরকারের মন্দ দিকগুলো নিয়ে সমালোচনা করতো। গণতান্ত্রিক সরকার মানেই জনগণের নির্বাচিত সরকার। তাহলে জনগণ কেন সরকারের ভালো দিকের সাথে মন্দ দিকের আলোচনা করতে পারবে না? সরকার কেন তার মন্দ দিকের সমালোচনা মেনে নিতে পারে না?
উত্তর হিসেবে কি পাওয়া যায়? উত্তর হিসেবে এটাই আসে যে- সরকার যে সমালোচনার সংজ্ঞা জানে না তা নয়, আসলে সরকার সমালোচনার সত্য সংজ্ঞা মানে না, মানতে চায় না।
আওয়ামী লীগের পতনের পর মোটামুটি অবস্থানের দুটি দলের কথা বলা যায়- বিএনপি ও জামায়াত। ১৫ বছর ধরে অত্যাচার, অবিচার সহ্য করার পর বোবা হয়ে যাওয়া মানুষগুলো ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের কারণে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।
জুলাই বিপ্লবের এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর মানুষ এখন স্বাধীনভাবে কথা বলছে। মানুষ প্রাণ খুলে সমালোচনা করছে। কিন্তু এই সমালোচনার স্থায়িত্ব কতোদিন? নতুন সরকার গঠনের পর বিগত ১৫ বছরে যা ঘটেছে তারই যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কী?
দেশে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করলেও মানুষ মন খুলে সমালোচনা করতে পারছে। কিন্তু নতুন সরকার গঠনের পর সেই সরকারব্যবস্থায় জনগণ সরকারের সমালোচনা করলে তাদেরকেও কি আয়নাঘরের মতো জায়গায় পাঠানো হবে? নাকি নতুন সরকার সত্য সমালোচনা মন্দ হলেও মেনে নিবে?
১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গঠনের পর ভগ্ন দেশে সরকারের দুরবস্থা বা মন্দ দিক প্রকাশ পেয়েছিলো। তার কিছু স্পষ্ট সমালোচনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন আবুল ফজল স্যার। সমালোচনা ছাড়া সঠিক পথ দেখানো সম্ভব নয়। আবুল ফজল স্যারের সমালোচনা গ্রন্থটির নাম ‘শুভবুদ্ধি’। কেউ যদি স্পষ্ট সমালোচনার ধারণা চান তাহলে এই বইটি পড়ে দেখার অনুরোধ রইলো।
সবশেষে আমরা বাঙালিরা স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ চাই, সত্য সমালোচনা করার অধিকার ফিরে পেতে চাই।
আগুন ঝরা ফাগুনে, রক্তাক্ত ভাষার মাসে- আসুন সকলে সত্য সমালোচনার মাধ্যমে দেশটাকে সঠিক পথে নিয়ে যাই।
অদিতি হক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন সদ্য গ্র্যাজুয়েট
Leave A Reply