সাদিক সাহেব একজন ওয়ার্ড কমিশনার। রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এর একজন মনোনীত প্রতিনিধি হওয়ায় তার উক্ত ওয়ার্ড এবং আসনে খুব দাপট রয়েছে। গত দুইবার টানা ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন, আগামী নির্বাচনে এমপি পদে নির্বাচন করবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। এলাকায় কোনো মানুষ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। তাই দিন দিন সাদিক সাহেব হয়ে উঠছেন এলাকার ত্রাস এবং দলের প্রিয় ও আস্থাভাজন পাত্র।
সাদিক সাহেব এর পরিবারে আছে তার দুই ছেলে, এক মেয়ে আর সাদিক সাহেব এর স্ত্রী। সাদিক সাহেব এর বড় ছেলের নাম ইমরান মাহমুদ, ছোট ছেলের নাম প্রেম মাহমুদ, মেয়ের নাম হলো আইরিন।
ইমরানকে বলা চলে সে একদম তার বাবার প্রতিচ্ছবি, বরং তার চেয়েও খারাপ। যত প্রকার অন্যায় আছে সব কিছুতেই পারদর্শী ইমরান। দিন যতই যায় ইমরান ততই অত্যাচারী হয়ে পড়ে । আর যতই অন্যায় করুক না কেন, প্রশাসন তো তার বাবার কথায় উঠে বসে। তাই নির্ভয়ে যেকোনো অন্যায় কাজ করে ফেলে।
ছোট ছেলে প্রেম মাহমুদ, পড়াশুনাতে খুব ভালো ছাত্র । ছেলে হিসেবে প্রেমের মতো ভালো ছেলে খুব কম আছে। যেখানে বাবা ও বড় ভাই অসহায়দের শোষণ করে, সেদিকে প্রেম সেই অসহায়দের পাশে দাঁড়ায়। এলাকায় বাকিরা ইমরানকে দেখতে পারে না, আর প্রেমকে সবাই পছন্দ করে।
মেয়ে আইরিন এখন কলেজে পড়ছে। সে তার বাসায় কম তার চাচার বাসায় বেশি থাকে। বাসায় থাকতে বলতে রাতে ঘুমাতে আসে। সাদিক সাহেব এর স্ত্রীর নাম নুর জাহান বেগম। ইমরানের বেগতিক অবস্থা দেখে নুর জাহান বেগম সাদিক এর অত্যাচার সহ্য করে হলেও প্রেম আর আইরিনকে তার বাবার এই অপকর্মের জগৎ থেকে দূরে রেখেছে। পরিচয় পর্ব শেষ হলে চলেন এবার মূল ঘটনাতে যাই।
সাদিক সাহেব এসি চালু করে টেলিভিশন এর সামনে বসলেন। ২০২১ সালে ওহিদুল ইসলাম সহ সাতজনের করা একটি রিটের খবর দেখতে পেলেন। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ কোটা নিয়ে পরিপত্র বাতিল করে দিয়েছে এবং কোটা পুনরায় ব্যবহার করেছে। খবর দেখতে দেখতে সাদিক সাহেব এর মোবাইল এ জরুরি ফোন এলো, পার্টি অফিসে যাওয়ার জন্য জরুরি তলব এসেছে এখনই যেতে হবে।
সাদিক সাহেবঃ “ প্রেম তৈরি হও। আজকে তোমাকে নিয়ে পার্টি অফিস যাব।”
প্রেমঃ “আব্বু, আমার আগামীকাল ভার্সিটিতে এ্যাসাইনমেন্ট দেয়ার লাস্ট ডেট। তুমি যাও, আমি অন্যদিন যাব।”
সাদিক সাহেবঃ “এত পড়াশুনা করে কি হবে? পড়াশুনা তো আমিও করেছি। কিন্তু সফলতা শুধু রাজনীতিতে। রাজনীতিতে কাঁচা পয়সা। যতদ্রুত বুঝবে তোমার জন্য ভালো।”
প্রেমঃ “আব্বু, তুমি তো জানো আমি তোমার ওই স্বৈরাচারী দলকে মোটেই পছন্দ করি না।” এই বলে প্রেম থু থু ফেলল।
সাদিক সাহেবঃ “ আর কিছু বলতে হবে না তোকে। ওই মাগী যা বুঝায় তাই বুঝিস, বাপ যে ভালো চায় সেটা আজ না হোক কাল ঠিক বুঝবি। আর একটা বিষয় বুঝে নে, দল স্বৈরাচার হোক আর যাই হোক, যে দলের ক্ষমতা এবং অর্থ আছে সে দলই সফল। আমি বেঁচে থাকতে থাকতে তোরা দুই ভাই তোদের পায়ের মাটি শক্ত করে নে। আগামী ইলেকশনে আমি এমপি হলে তুই আমার সাথে থাকবি আর তখন তোর ভাই হবে কমিশনার।”
প্রেমঃ “তুমি বললেই তো হবে না, জনগণ যাকে ভোট দিবে সেই হবে মন্ত্রী আর কমিশনার।”
সাদিক সাহেবঃ “জনগণের আশায় থাকলে তৃতীয় বারের মত কমিশনার হতে হতো না। যতদিন নেত্রী পাশে আছে আল্লাহ নিজে আসলেও পারবে না আমাকে এমপি হওয়া থেকে আটকাতে। তুই রাজনীতিতে মনোযোগী হো তখন বুঝবি, হো হো হো।”
নুর জাহান বেগমঃ “আহা আপনি যেখানে যাচ্ছেন যান, ছেলের কাজ আছে বললোই তো!”
সাদিক সাহেবঃ “তুই চুপ কর মাগী! তোর জন্য আমার এই ছেলে-মেয়েগুলো এমন হইসে। এইগুলো আমার পোলাপাইন নাকি কে জানে। কার লগে আকাম কইরা আইসিলি কে জানে। ইমরানই খালি আমারে বুঝে, আর বাকি সব হইসে কুলাঙ্গার।”
সাদিক সাহেব সিগারেট হাতে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলো। নুর জাহান বেগমের সাথে সাদিক সাহেব এর এমন দুর্ব্যবহার নতুন কিছু না। মাঝে মাঝে গায়েও হাত তুলে সাদিক সাহেব।
রাতে সাদিক সাহেব ও ইমরান একসাথে খাওয়া-দাওয়া করতে বসেছে। সাদিক সাহেব ইমরানকে প্রশ্ন করলো, “এলাকাতে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো?”
ইমরানঃ “ হ্যাঁ সবকিছু ঠিকঠাক। ওই ছোটখাটো সমস্যা তো থাকেই। সেগুলো আমি দেখে নিচ্ছে। তোমার সেগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”
সাদিক সাহেবঃ “ভাবছি প্রেমকে রাজনীতিতে নিয়ে আসব। কি বলো?”
ইমরানঃ “গাধাকে দিয়ে কখনো হাল চাষ হয় না। আমার মতে তোমার ছেলে মস্ত বড় গাধা।”
সাদিক সাহেবঃ “গাধাকে দিয়ে হাল চাষ না করানো গেলেও বোঝা তো টানানো যায়। আর প্রেমের এখনই সময় রাজনীতিতে যোগদান করার। দেখা যাবে একদিন এই গাধাও বাঘ হয়ে গেছে।
ইমরানঃ “আমিও সেটাই চাই, আমার ভাই বাঘ হয়ে উঠুক। আইরিন কোথায়?”
সাদিক সাহেবঃ “আর কোথায় থাকবে নাফির বাসায় গিয়েছে হয়তো।”
ইমরানঃ “গাধার বোন গাধি। আর তাকে বাসা থেকে বের হতে দাও কেন। জানো না, বাইরে পাঠানো পছন্দ না।”
নুরজাহান বেগম ইমরান ও তার বাবার মাঝে বলল, “বাহিরে আর কোথায় নাফি’র বাসায় তো গিয়েছে।”
ইমরান ঝাড়ির সুরে, “আহা, মা! তোমাকে কতবার বলেছি আমাদের মাঝে কথা বলতে না। যে জিনিস বুঝো না সেটা নিয়ে কথা বলতে হবে না।”
সাদিক সাহেব, “আহা বাদ দে। প্রেমের জন্মদিনে একটা দাওয়াতের আয়োজন করতে যাচ্ছি, কি বলিস?এই দাওয়াতে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের দাওয়াত করব। আর প্রেমের সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দেব। কি বলো?”
ইমরান, ”হ্যাঁ তাই কর।”
নাফি হল আইরিনের চাচাতো বোন। আইরিন এবং নাফির বাড়ি পাশাপাশি। আইরিনের নিজের বাড়িতে থাকতে খুব বিরক্ত লাগে, কারণ সারাদিন বাহিরের মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে বাড়িতে। কখনো এই রাজনৈতিক নেতা ওই রাজনৈতিক নেতা। তাই আইরিন নিজের বাড়িতে না থেকে তার চাচার বাড়িতে বেশিরভাগ সময় কাটায়। তার বোন নাফির সঙ্গে সময় কাটাতে আইরিন বেশি পছন্দ করে। নাফি এখন অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে। নাফি যেমন রূপবতী ঠিক তেমন গুণবতী মেয়ে। যে কেউ তার রূপে-গুণে মুগ্ধ হবে। আইরিন তার নাফিকে তার আইকন মনে করে। তাই সারাক্ষণ নাফির সাথেই কাটায়। আর নাফিরও আইরিনকে বেশ ভালো লাগে।
আজ প্রেমের জন্মদিন আর এটার জন্য সাদিক সাহেব নেতা কর্মীদের দাওয়াত দিয়েছে, প্রেমকে আজ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। আজ থেকে প্রেম অফিসিয়ালি রাজনীতিতে যোগ দিবে। ছেলে নোংরা রাজনীতিতে জড়াবে এটার জন্য সকাল থেকে নুর জাহান বেগমের মন কেমন যেন করছে। তাই সকালেই নাফিদের বাসায় গিয়ে বসে আছে। নার্গিস বেগম নুর জাহান বেগমকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মায়ের মন কি আর মানে!
নাফিঃ “বড় আম্মু এমন করে চিন্তা করবেন না। আপনার শরীর তো খারাপ করবে। আপনি সারারাত ঘুমান নাই। আজ তো আর কাজ নাই, আপনি না হয় একটু ঘুমিয়ে নেন।
নুর জাহান বেগম নাফির রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সাদিক সাহেব আর ইমরান এদিকে দাওয়াত এর বাকি আয়োজন দেখছে।
প্রেম এখনো ঘুম থেকে উঠে নাই। কিছুক্ষণের পর আযান দিবে তাই আইরিন এসেছে প্রেমকে জাগিয়ে তুলতে।
“ভাইয়া, ওই ভাইয়া। উঠো, নামাজের সময় হচ্ছে উঠবে না? এই ভাইয়া।”
আইরিনের ডাকে প্রেম এর ঘুম ভাঙলো। প্রেম ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নামাজ পরে আসলো। বাসায় নুর জাহান বেগমকে না পেয়ে প্রেম তার চাচার বাড়িতে গেলো। চাচার বাসায় গিয়ে দেখে তার মা ঘুমোচ্ছে।
নার্গিস বেগমঃ “তোমার মা তোমার চিন্তায় কাল সারারাত ঘুমায় নাই। তাই এখন ঘুমাচ্ছে।”
প্রেম আর কিছু না বলে ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছে, আইরিন আর নাফি আগে থেকেই খেতে বসেছে।
নাফিঃ “ প্রেম ভাই, কেমন আছেন? আমাদের বাসার গেট আপনার মনে আছে তাহলে? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমাদের কথা ভুলে গিয়েছেন। নেতা হওয়ার পর যে কি হবে! আচ্ছা প্রেম ভাই একটা প্রশ্ন করি?”
নাফি কথা গুলো এক নিশ্বাসে বলে গেলো। প্রেম বলল, “ আগে পানি খাও, এক নিশ্বাসে এত কথা কিভাবে বলো তুমি!?” নাফি আবার এক নিশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু পানি খেয়ে নিল। নার্গিস বেগম প্রেমের জন্য খাবার নিয়ে এলো। প্রেম হাত ধুয়ে খেতে বসলো আর ওপাশ থেকে নাফি প্রেমের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। আইরিন বিষয়টা লক্ষ্য করে জোরে কাশি দিয়ে উঠে। আইরিন আগে থেকেই জানে, নাফি প্রেমকে ভীষণ ভাবে ভালবাসে। আর নাফির জীবনে একমাত্র পুরুষ প্রেম। কিন্তু আইরিন কখনো নাফিকে এই বিষয়ে নিয়ে কিছু বলে নি। আইরিন ভাবছে আজ বলবে।
নুর জাহান বেগমের ঘুম ভাঙতেই দেখলো, প্রেম তার পায়ের কাছে বসে বই পড়ছে। নুর জাহান বেগম এক নজরে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে। ছেলে যেন রাজনীতিতে না জড়ায় এটার জন্য কত নির্যাতন না সহ্য করে গেছে।কিন্তু আজ তিনি ব্যর্থ। আজ তার স্বামী, বড় ছেলের মত ছোট ছেলেও সেই স্বৈরাচারের অফিসিয়াল দালাল হতে চলল।
প্রেম বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, “ আম্মু তোমার দেয়া শিক্ষা এত দুর্বল ছিল না। তুমি নিছক ভয় পাচ্ছ, তুমি যা নিয়ে ভয় পাচ্ছো তা কখনো সত্যি হবে না। তুমি নির্ভয়ে থাকতে পারো।”
ছেলের মুখ থেকে এমন কথা শুনে নুর জাহান বেগম যেন প্রাণ ফিরে পেল। ঠিক তখন আইরিন রুমে প্রবেশ করল।
আইরিনঃ “কি কথা হচ্ছে মা ছেলের মধ্যে? আমাকেও একটু বলো।”
নুর জাহান বেগমঃ “আমার দেয়া শিক্ষা এত দুর্বল না, হ্যা দুর্বল না। আল্লাহ তুমি সাক্ষী আমার দেয়া শিক্ষা মোটেই দুর্বল না। মাওলা, তুমি আমার এই ছেলেকে কবুল করে নাও।”
আইরিনঃ তোমাকে ছোট আম্মু তো সকাল থেকেই বলছে তোমার দেয়া শিক্ষা এত দুর্বল না। যাক দেরি করে হলেও তো বুঝতে পেরেছো।”
প্রেম বই হাতে নিয়ে তার মায়ের কোলে শুয়ে পড়লো। নুর জাহান বেগম প্রেমের মাথায় হয় বুলিয়ে দিল।
নুর জাহান বেগম, “আয় মা তুইও আমার কাছে আয়। আজ আমার জীবন সার্থক।”
সন্ধ্যার পর আইরিন আর নাফি তৈরি হচ্ছে প্রেম এর বার্থডে পার্টির জন্য। নাফি খুব সাধাসিধে ভাবেই তৈরি হয়।
আইরিন নাফির চোখে কাজল দিতে দিতে ,“ আচ্ছা, নাফি আপু তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?”
নাফিঃ “না করলেই কি আর তুমি শুনবে! বলো কি বলবে।”
আইরিনঃ “তুমি যে প্রেম ভাইয়াকে এত ভালোবাসো এটা ভাইয়াকে কেনো বলো না?”
নাফি থমকে গেলো। কী বলবে বুঝতে পারছে না। সত্যি স্বীকার করবে নাকি করবে না।
নাফিঃ “তোমাকে কে বলল যে আমি প্রেম ভাইয়াকে পছন্দ করি?”
আইরিনঃ “কি মনে করো আমি কিছু বুঝি না, তুমি যে ভাইয়াকে ছোট কাল থেকে পছন্দ করো সেটা আমি অনেক আগে থেকে জানি। এখন বলো না, তুমি ভাইয়াকে বলো না কেন?”
নাফিঃ “হ্যা আমি তোমার ভাইয়াকে ছোট কাল থেকে ভীষণ ভালবাসি। আর তোমার ভাইয়া ছাড়া আমার জীবনে দ্বিতীয় কোনো পুরুষ নেই। আর প্রেম ভাইয়াকে বলতে খুব ভয় পাই। ভাইয়া কি না কি মনে করে!”
আইরিনঃ “আজকে তাহলে বলে ফেলো। পারবে না?”
নাফি আর কিছু বলল না। চার পাশে নীরবতা, আইরিন নাফিকে সাজিয়ে দিচ্ছে।
আইরিনঃ “একটা কাজ কর। চিঠি লিখো। গিফট এর সাথে চিঠিটা দিয়ে দিবা, বুঝলা?”
কাল থেকে সারাদেশে “বাংলা ব্লকেড” কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর নেতৃবৃন্দ। এটা নিয়ে কথা হচ্ছে পার্টি’তে। প্রেম এসে কেক কাটলো আর সবার সাথে পরিচয় হয়ে নিলো। নাফি প্রেমের জন্য গিফট এনেছে। গিফট এর ভিতরেই চিঠি দিয়েছে। গিফট দেয়ার সময় নাফির হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।
রাতে প্রেম আর কারো গিফট খুলল না। সবার দেয়া গিফট আলমারিতে তুলে রাখলো পরে খুলে দেখবে।
“তুমি কে, আমি কে
রাজাকার, রাজাকার।
কে বলেছে, কে বলেছে
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।”
গতকাল রাত থেকে সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর হল থেকে স্লোগান চলছে। মিডিয়াতে ব্যাপক সারা ফেলেছে। আওয়ামীলীগ এর সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে সারাদেশের ছাত্রলীগ, যুবলীগ কর্মী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালাচ্ছে। এতে পিছিয়ে নেই ইমরান। ইমরান তার ছেলে পেলেদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করার জন্য। আর ছেলে পেলেরা খুশিতে পাখির মতো সাধারণ জনগণ ও শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে অত্যাচার করছে। এই নোংরা খেলায় সাদিক সাহেব খুব খুশি। প্রেম রাজনীতিতে পা দেয়ার সাথে সাথে এমন একটা পরিস্থিতি পেয়েছে যেখানে প্রেম বুঝতে পারবে আওয়ামী লীগ আসলেই কতটা শক্তিশালী দল। প্রেমের হাতেও আজ একটা বন্দুক। প্রেমের শরীর আজ কেমন গরম হয়ে আছে। মন চাইছে তার আসে পাশে থাকা সব পশু গুলোকে গুলি করে মেরে দিতে। কিন্তু করতে পারছে না। প্রেমকে নিয়ে তার বাবা ও ভাই এলাকা পাহারায় বসে আছে আর দল ভাগ করে ছেলে পেলে পাঠাচ্ছে কে কোন থানায় যাবে। সাথে পুলিশ, আনসার বাহিনীর ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছে যেনো এক সাথে কাজ করতে পারে।
প্রেম বসে বসে ভাবছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে। তারা কি আসলে কোনো অযৌক্তিক কিছু নিয়ে আন্দোলন করছে? তারা কি দেশের কোনো ক্ষতি করেছে? তাদের আন্দোলন তো খুব সাধারণ ভাবেই চলছিল। স্বৈরাচারী মনোভাব না নিয়ে সরকার প্রথম দিক থেকে যদি শিক্ষার্থীদের কথা শুনতো তবে কি আজ এই অরাজকতা চলতো? এই আন্দোলন যৌক্তিক। দেশের গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করে আছে এই স্বৈরাচারী দলের দালালরা। কেউ যাচ্ছে ছাত্রলীগ থেকে কেউবা যুবলীগ থেকে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে তাদের ছেলে মেয়ে এবং নাতি পুতি দেরও দেয়া হচ্ছে চাকরি। যার ফলে মেধাবীরা যোগ্য স্থানে যাচ্ছে না। যখন মুক্তিযুদ্ধ চলে তখন সাদিক সাহেব এর বয়স ৮-৯। কিন্তু তার কাছেও আছে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট। এই সুবাদে প্রেম ও তার পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদের সমপরিমাণ সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু আসলে ৮-৯ বছর বয়সের একজন বাচ্চা কি আসলেই মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে। এমন কত শত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে কে জানে! এসব ভাবতে ভাবতে প্রেমও শিক্ষার্থীদের সাথে একমত হয়ে উঠল।
গতকাল রাত থেকে সারাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ। নিজের পরিবার এর মানুষ যেভাবে নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের ও সাধারণ মানুষদের ওপর অত্যাচার করছে সেটা প্রেম কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না। গত পরশু দিন রংপুরে আবু সাঈদ নামক এক ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই জেরে সাহস পায় আওয়ামী লীগ এর বাকি পেটোয়া বাহিনী। গতকাল ইমরান তার এলাকার ছেলেদের মাঝে ঘোষণা দিয়েছে যে যত বেশি শিক্ষার্থীদের অত্যাচার করতে পারবে সেই অনুযায়ী বখশিশ এর ব্যবস্থা রয়েছে। বখশিশ এর আশায় ছেলেরা আর আগ্রহ নিয়ে অত্যাচার বাড়িয়ে দিয়েছে। সাথে আছে পুলিশ এখন আর ভয় এর কোনো কারণ নেই। রাতে এসে রিপোর্ট করে আর সে অনুযায়ী বখশিশ নিয়ে যায়।
রাতে প্রেম নিজের রুমে মন খারাপ করে বসে আছে। মোবাইলে নেট না থাকার কারণে কোনো কাজ করতে পারছে না। তাই তার বার্থডেতে যে গিফট পেয়েছে সেগুলো বের করলো। একটা একটা করে খুলছে আর পাশে রাখছে। প্রেমের হাতে এখন নাফির দেয়া গিফট। প্যাকেট খুলতেই দেখলো একটা সাদা রঙের কাজ করা পাঞ্জাবি। প্রেমের খুব পছন্দ হলো। সাথে রয়েছে একটা চিঠি। চিঠিতে_
“প্রতি রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু তোমার কথা ভাবি। আমার মনে একটা প্রশ্ন শুধু ঘুরপাক খায়। আমি তোমায় এত কেনো ভালবাসি? তুমিও কি আমায় ভালবাসো?
জবাবের অপেক্ষায়।”
প্রেম চিঠিটা পড়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
আজ শুক্রবার, ফজরের নামাজ শেষে প্রেম আল্লাহর দরবারে হাত তুলে মোনাজাত করছে।তবে আজ মোনাজাত বড় করে করল। দেশের এমন অবস্থাতে প্রেমের মন আনচান করছে। মোনাজাত শেষ করে প্রেম ঠিক করলো, আজ সে ছাত্রদের সাথে মাঠে নামবে। এলাকার সবাই পরিচিত হওয়ায় সে মুখ থেকে যাবে।
ঘড়িতে সময় দুপুর ২ টা ১২ মিনিট। জুম্মার নামাজ শেষ করে প্রেম বাসায় এসে খাওয়া দাওয়া করছে আর ভাবছে, বাসায় কাউকে জানিয়ে আন্দোলনে যাবে কি না। খাওয়া শেষ করে প্রেম মায়ের রুমে গিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।
প্রেমঃ “আচ্ছা আম্মু, দেশের ছাত্র-জনতার ওপর যে অন্যায় ভাবে অত্যাচার-খুন চলছে এর জন্য কি তোমার একটুও মন খারাপ হয় না?
নুরজাহান বেগমঃ “ হবে না কেন? অবশ্যই হয়। কিন্তু দেখো ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এমন খুনিদের সাথে এক ছাদের নিচে থাকতে হচ্ছে। এর চেয়ে মরন ভালো।”
প্রেমঃ “সত্যি মা তাহলে কি মরণ ভালো? আচ্ছা মা আমি যদি এই আন্দোলনে যাই তুমি কি খুব কষ্ট পাবে? তাতে যদি আমার প্রাণ যায় তুমি কি আমায় ছাড়া থাকতে পারবে?”
নুরজাহান বেগমঃ “তুমি যদি সত্যের পথে শহীদ হও তবে আমার এতে কোন দুঃখ নাই। তবে নিয়ত থাকতে হবে আল্লাহর জন্য শহীদ হওয়া।”
প্রেমঃ “তাহলে মা আজ আমি আন্দোলনে যাচ্ছি। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলে যাচ্ছি, আমি নিয়ত করছি আল্লাহর জমিনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যদি আমার মৃত্যু হয় তবে আলহামদুলিল্লাহ।”
নুরজাহান বেগমঃ “আল্লাহ তোমাকে কবুল করুক। আর সাথে নিয়ে আইরিনকে যেও। তোমাদের দুজনকে আল্লাহর হেফাজতে ছেড়ে দিলাম।”
নুর জাহান বেগমের তার ওড়না দিয়ে চোখের পানি আড়াল করে নিল।
নাফির দেয়া সাদা পাঞ্জাবি পরে প্রেম, নাফি এবং আইরিন সাধারণ ছাত্র–জনতার সাথে রাজপথে বসে আছে। মেয়েদের নিয়ে দূরে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে এলাকার মধ্যেই রইল। নাফি মাঝে মাঝে প্রেমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবছে প্রেমের এমন সাহস দেখে যে প্রেমও পারে দেশের জন্য এভাবে রাস্তায় সবার সাথে বসতে।
নাফি প্রেমের হাত ধরে সবার সাথে স্লোগান দিচ্ছে।
“কোটা না মেধা,
মেধা মেধা।”
“তুমি কে, আমি কে,
রাজাকার, রাজাকার।
কে বলেছে, কে বলছে।
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।
“চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।”
“আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম।”
“দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ।”
“তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে।”
“লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে।”
“আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই”
“যে হাত গুলি করে, সে হাত ভেঙে দাও।”
“চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই ফাগুনেই হবে দ্বিগুণ।”
স্লোগান দিতে দিতে হঠাৎ প্রেমের মনে পড়ল নাফির দেয়া সেই চিঠির কথা। প্রেম ভাবলো সে কি উত্তর আজকেই দিবে যে সেও নাফিকে ভালোবাসে। কিন্তু পরিবার এর ভয়ে কখনো বলতে পারে নাই। এসব ভাবতে ভাবতে দেখল রাস্তার ওপর পাশ দিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছে। সেখানে থাকা সকল ছাত্র জনতা সেই মিছিলে যোগ দিল। সাথে তারা তিন জনও যোগ দিল। মিছিলটি যাত্রাবাড়ির দিকে যাবে। একসাথে স্লোগান দিতে দিতে তারা প্রায় সামনের দিকে চলে গেলো মিছিলের।
মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এমন সময় কোথা থেকে একটা টিয়ার সেল মারা হলো মিছিলকে লক্ষ্য করে। টিয়ার সেলের ফলে সবাই ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেলো। প্রেম নাফি ও আইরিন এর হাত ধরে পিছনে চেপে গেলো। এমন করে যতবার সবাই এক হয়ে আগাতে চায় টিয়ার শেল মারা হয়।
শেষ পর্যন্ত ছাত্র জনতাকে আটকাতে পুলিশ আর লীগ বাহিনী একত্রে সামনে আসে। আর এলোপাথারী গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু তাতেও ছাত্র জনতা দমে যায় নি। একটা সময় প্রেম, নাফি ও আইরিন পুলিশ ও পেটোয়া বাহিনীর সামনে পড়ে যায়। তখন নাফি লক্ষ্য করে পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্ব আর কেউ না ইমরান নিজে দিচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত ছাত্র জনতাকে আটকাতে পুলিশ আর লীগ বাহিনী একত্রে সামনে আসে। আর এলোপাথারী গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু তাতেও ছাত্র জনতা দমে যায় নি। একটা সময় প্রেম, নাফি ও আইরিন পুলিশ ও পেটোয়া বাহিনীর সামনে পড়ে যায়। তখন নাফি লক্ষ্য করে পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্ব আর কেউ না ইমরান নিজে দিচ্ছে। পরে আশপাশ তাকিয়ে দেখে তেমন কেউ নেই, সামনে শুধু তারা তিন জন আর হাতে গোনা কিছু লোক। তাদের গুলি থেকে বাঁচতে নাফি প্রেম ও আইরিন এর হাত ধরে জোরে উলটো দিকে দৌড় দেয় । এতে করে প্রেম পিছনে এসে দুই হাত প্রসারিত করে নাফি ও আইরিনকে শেল্টার দেয় এবং দৌড়াতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ করে কোথা থেকে একটা গুলি এসে প্রেমের পায়ে লাগে। প্রেম সেই পা নিয়ে তাদের দুই জনকে নিয়ে এক গলিতে নিয়ে ঢুকে পরে। আর বলে তারা যেন এখান থেকে বের না হয়। এই বলে প্রেম তার কাছে থাকা রিভলবারটা বের করে আর বলে গুলি যেহেতু খেয়েছি সাথে দুইটাকে মেরে তারপর খান্ত হবো। নাফি প্রেমকে বাধা দিতে গেলে আইরিন নাফির হাত চেপে ধরে।
প্রেম রিভলবার নিয়ে পেটোয়া বাহিনীর নেতার দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে,এতে করে একটা গুলি ঠিক ইমরানের মাথায় লাগে, এতে ইমরান সাথে সাথে জমিনে পরে যায়। পরে পেটোয়া বাহিনীর আরেক নেতা সাগর প্রেমকে টার্গেট করে গুলি করে, প্রথম গুলি না লাগলেও পরের গুলি ঠিক প্রেমের বুক চিরে বের হয়ে যায় আর সাথে সাথে প্রেমের সাদা পাঞ্জাবি লাল রক্তে মেখে যায় আর তার দেহ মাটিতে পরে যায়।
নুর জাহান বেগমের সামনে দুই ছেলের লাশ। নুর জাহান বেগমের মনে ইমরানের জন্য দুঃখ না হলেও প্রেমের জন্য খুব আনন্দ হচ্ছে। তার ছেলের শহীদ হয়েছে। আজ থেকে নুর জাহান বেগম শহীদ প্রেমের এর মা। আইরিন এর মনেও একই অবস্থা, আজ থেকে সে শহীদ প্রেমের বোন।
রাতে নাফি প্রেমের দেয়া নীল রঙের শাড়ি পরে টেবিলে বসে তার ডায়েরি লিখছেঃ
“আমার অপেক্ষার অবসান হলো। চাঁদের সাথে আর কথা হবে না, রাত জেগে তোমায় নিয়ে ভাবা হবে না। তোমায় নিয়ে বুনা হবে না আর কোনো স্বপ্ন। ওপারে ভালো থেকো প্রেম আমার।”
ইয়ানুর রহমান শুভ হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী
Leave A Reply