ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আমাদের চিরপরিচিত ঘুরতে যাওয়া জিয়া উদ্যান হয়ে গিয়েছিলো চন্দ্রিমা উদ্যান, মাওলানা ভাসানী নভোথিয়েটারের নাম হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার। স্বৈরাচার পতনের পরপর খুনী হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ভরপুর স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তন করে শিক্ষার্থী-জনতা, কিছু কিছু জায়গায় প্রশাসন নিজেই। কিন্তু এই নাম পরিবর্তনের আড়ালের রাজনীতিটা বোঝাও জরুরি।
সম্প্রতি খুনী হাসিনার ভাষণের পর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে সুপরিচিত। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাঈদের বিশ্ববিদ্যালয় এটি। সম্প্রতি দেখা গেলো, একদল শিক্ষার্থী কোনো যৌক্তিকতা ছাড়াই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় রাখতে চাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেরোবি’র শিক্ষার্থীরা অনেকেই এই দাবীর বিরোধিতা করেছেন। বেরোবি’র সকল সংগঠন সগৌরবে বেগম রোকেয়ার নাম নিয়েই আজ অবধি পুরো দেশে তাদের কার্যক্রমের জানান দিয়ে এসেছে।
এর পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেব্রুয়ারির পাঁচ তারিখ রাতেই ছাত্ররা মুজিব পরিবারের নাম মুছে দিতে পরিবর্তিত নাম সম্বলিত ব্যানার নিয়ে ছাত্রী হলে যাওয়ার পর, ছাত্রীরা তাদের সাথে কোনোপ্রকার আলাপ না করে জোরপূর্বক ব্যানার সাঁটানোসহ হট্টগোলের প্রতিবাদ করলে; সেখানে ছাত্রীদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ, স্লাটশেমিং করা এমনকি গায়ের কাপড় খুলে একজন ছাত্রীর দিকে ছোঁড়াসহ আক্রমণ করার ঘটনা ঘটেছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওসহ প্রচার হয়েছে।
এদিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ নিয়ে হয়েছে আরেক রাজনীতি। প্রশাসনের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, খুনী হাসিনা ও তার পরিবারের পাশাপাশি অধ্যাপক জিসি দেব, লালন সাঁই, ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ডা. আলীম চৌধুরী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দারদের নামধারী স্থাপনাগুলোর নামও পরিবর্তন করা হয়।
যদিও এক বরাতে প্রশাসনের এই কাজের পেছনের কারণ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। সেখানে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে কেউই বুদ্ধিজীবিদের নামানুযায়ী স্থাপনাগুলোকে চিনতো না; তাছাড়া প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, অধ্যাপকদের বাসভবন (২ ফ্ল্যাটের ৪ তলা ছোট্ট ভবন) এর নাম বুদ্ধিজীবিদের নামে করে বরং তাদের সম্মানিত স্থান থেকে নিচেই নামানো হয়েছিলো। এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নাকি না, সে আলাপে যাবো না। কিন্তু এই নামকরণ পরিবর্তনের ফলে যে বয়ান সকলের সামনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, পরবর্তীতে পত্র-পত্রিকায় স্থাপিত হলো; সেটি অভ্যুত্থান পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আরও ভয়াবহ। সেখানে ছাত্রী হলের নৌকা প্রতীক ভাঙা নিয়ে শিক্ষক-সাংবাদিক-ছাত্রীদের মধ্যে বাকবিতন্ডা, গালাগালি এমনকি হাতাহাতিও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর/সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ছাত্রীদের “স্বৈরাচারের দালাল, হাসিনার দালাল, মাগী, তুই-তোকারী” করে গালি দেওয়ার, এক ছাত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার।
গতকাল তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই ঘটনায় ১১ জন ছাত্রীকে বহিষ্কার করেছে। স্পষ্ট অভিযোগ উঠেছে- অন্তত ৯ জন ছাত্রীর ক্ষেত্রে সুষ্ঠু তদন্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় নি, বহিষ্কৃত অনেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও পায়নি, এমনকি ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকে শুধুমাত্র ফেসবুকে ঘটনা নিয়ে লিখার কারণে বহিস্কৃত হয়েছেন- এমন ছাত্রীও আছেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপগুলোতে ছাত্রীদের গালিগালাজ ও বেশ্যাকরণ করা হয়েছে। স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছাত্রীদের ইঙ্গিত করে “হানিট্র্যাপ” এ ফেলার ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইঙ্গিত করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তার করা একাধিক মোরাল পুলিশিং পোস্টও সকলের নজরে এসেছে।
গণঅভ্যুত্থান কোনো লিঙ্গ-সম্প্রদায়-ধর্ম-বর্ণ কেউ একা করে নি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান একা পুরুষদের করা না, অগণিত নারী শিক্ষার্থী-শিক্ষক-শিল্পী-শ্রমিক-পেশাজীবীর অংশগ্রহণ ছাড়া এই অভ্যুত্থান কোনোদিনও সফলতার মুখ দেখতো না। একইসাথে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আন্দোলন ছিলোনা কখনোই; বরং আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করেই রাজপথে ছিলাম, একাত্তরই আমাদের আঠারোতে আর চব্বিশে পথ দেখিয়েছে।
গণঅভ্যুত্থান কোনো লিঙ্গ-সম্প্রদায়-ধর্ম-বর্ণ কেউ একা করে নি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান একা পুরুষদের করা না, অগণিত নারী শিক্ষার্থী-শিক্ষক-শিল্পী-শ্রমিক-পেশাজীবীর অংশগ্রহণ ছাড়া এই অভ্যুত্থান কোনোদিনও সফলতার মুখ দেখতো না। একইসাথে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আন্দোলন ছিলোনা কখনোই; বরং আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করেই রাজপথে ছিলাম, একাত্তরই আমাদের আঠারোতে আর চব্বিশে পথ দেখিয়েছে।
তাহলে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো তাদের আচরণের মধ্য দিয়ে কাদের এজেন্ডা সার্ভ করতে চায়? গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নারীবিদ্বেষী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, হিন্দুবিদ্বেষী দেখালে কার রাজনীতি চরিতার্থ হয়?
বুদ্ধিমানের কাজ মাত্রই এই বয়ানের ফাঁদে পা না দেওয়া, কাজেই প্রশাসনের পদ বাগিয়ে বসে থাকা ব্যক্তিরা এতোটাও অবুঝ সেটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। তারা কি অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে একটি ব্যাটাতান্ত্রিক পরিবেশ কায়েমের মধ্য দিয়ে আদৌ পতিত স্বৈরাচারের “মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, নারীবিদ্বেষী, হিন্দুবিদ্বেষী” বয়ানকেই প্রতিষ্ঠা করতে চান কি না- এবার এই প্রমাণটা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসকদেরই দিতে হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না; যখন খুনী হাসিনা ক্ষমতায়, অনবরত গুলি করছে, আটক করছে, মামলা দিচ্ছে; সেই ৩৪শে জুলাই (৩ অগাস্ট) প্রথম খুনী হাসিনার নাম পরিবর্তন করার দুঃসাহস দেখায় আমাদের মেয়েরাই; জাহাঙ্গীরনগরে, বুটেক্সে, কুমিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই মেয়েদের সরিয়ে দেওয়ার রাজনীতি যদি করতে চান, করেন। কিন্তু এই ব্যাটাগিরি করে খুব বেশিদূর আগাতে পারবেন বলে মনে হয় না।
প্রাপ্তি তাপসী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী
Leave A Reply