খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের (অনেকে যাদেরকে শিবির বলে সন্দেহ করছেন) মধ্যে যে সহিংস সংঘর্ষ হয়েছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এই ঘটনায় স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে ছাত্রদলের কর্মীরা সেখানে অস্ত্র ব্যবহার করেছেন এবং এতে অনেকে আহত হয়েছেন। ক্যাম্পাসে যে কোনো সশস্ত্র হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হামলায় যাদের ছবি ও ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। বিএনপি ইতিমধ্যে যুবদলের একজন কর্মীকে বরখাস্ত করেছে। রাষ্ট্রের এখন দায়িত্ব তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা।
ছাত্রদলের একজনের স্ট্যাটাস দেখলাম। তিনি লিখেছেন, “শিবির কো… জায়েজ ছিল, আছে, থাকবে।ইনশাআল্লাহ।” সে এই ঘৃণ্য অপরাধকে ইসলাম দিয়ে ন্যায্যতা দিচ্ছেন। এই ছেলেটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মী নন। তার আহ্বানে কেউ সাড়াও দেবে না। কিন্তু এই মানসিকতা আমাকে হতভম্ব করেছে। আপনারা কি পাগল হয়ে গেছেন?
এই ঘটনার নিন্দা ও বিচার চেয়ে থেমে গেলে হবে না। ৫ আগস্ট পরবর্তী ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে আমাদের সমাজবিজ্ঞানের ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিতে দেখতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’, ‘তৌহিদি জনতা’ কিংবা অরাজনৈতিক ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে পরিচিত বিভিন্ন গোষ্ঠী স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে। তারা শাসন কাঠামোর সুবিধা পাচ্ছে। এই সংগঠনগুলোর উচিত তাদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করা। অন্যথায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ বনাম ‘ছাত্রদল’- এই ফ্রেমিং আলোচনায় ঝড় তুললেও সমস্যার প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পাবে না।
আমি কয়েকদিন আগে আমার পডকাস্টে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে শিবিরের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি রেখেই আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম— শিবির কি ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তাদের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ্য করবে কি না? শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন যে “শিবির কোনো গোপন রাজনীতি করছে না”, এবং শিবিরের সদস্যরা “সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত থাকলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে”।
শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির সদিচ্ছার ওপর আমার সন্দেহ নেই। তবে আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত যে ৫ আগস্টের পর শিবির যেমন প্রকাশ্যে রাজনীতি করছে, তেমনি তারা গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত রয়েছে। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের অবশ্যই এই ব্যাপারে ক্রিটিক্যাল হতে হবে এবং শিবিরকে সকল গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাদ দিতে দাবি জানাতে হবে। অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের মতো শিবিরের রাজনীতি করার অধিকার আছে। তবে তা অবশ্যই প্রকাশ্য হতে হবে। কোনোভাবেই তা গোপন হতে পারবে না।
অন্যদিকে, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এখন আর কোনো নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক সংগঠন নয়। তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত এবং বর্তমান ক্ষমতা কাঠামোর কাছ থেকে সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের প্রতিনিধি সরকারে আছেন। তারা নিয়মিত রাজনৈতিক সংলাপে অংশগ্রহণ করছেন। রাজনীতি বিজ্ঞানের কোনো সংজ্ঞাতেই তাদের অরাজনৈতিক সংগঠন বলা যায় না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যদি প্রকৃত অরাজনৈতিক আন্দোলন হতো, তাহলে তারা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষ নিত না। কিন্তু আমরা দেখছি, তারা নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রমের অনুমোদন দিচ্ছে, আর কিছুতে বাধা দিচ্ছে।
আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারে কিছু মানুষ ক্যাম্পাসে নানা কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে, নৈতিক পুলিশিং করছে। বিভিন্ন শিক্ষকদের ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে ক্লাসে আসতে বাধা দিচ্ছে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘তৌহিদি জনতা’ মাজার ভাঙচুর, মেয়েদের খেলা বন্ধ করা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার মতো কাজ করছে। ‘তৌহিদি জনতা’র কার্যক্রম স্পষ্টতই কৌশলগত। এই গোষ্ঠীগুলো নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বিষয়কে সঠিক বা বেঠিক বলে প্রচার করছে, যা আদতে একটি বিশেষ রাজনৈতিক পক্ষের উপকার করছে। রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীন পক্ষ এই গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমকে হয় উপেক্ষা করছে, নয়তো পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। এতে বিরোধী গোষ্ঠীগুলো কোণঠাসা হয়ে যায়। যারা এই বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা জানতে চান, তাদের অনুরোধ করব কোহেনের Folk Devils and Moral Panics (1972) বইটি পড়ার জন্য।
এবার আসি মূল প্রশ্নে— ক্যাম্পাসে নিয়ম প্রয়োগের দায়িত্ব কার? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই একমাত্র কর্তৃপক্ষ, যারা নিয়ম বাস্তবায়ন করবে। নতুন সময়ের রাজনীতিতে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে কোনো ছাত্র সংগঠন অন্য সংগঠনের কার্যক্রমে বাধা দেবে না। যদি কোনো ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকে, তবে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সাধারণ শিক্ষার্থীদের নয়— এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ। অভিযোগ থাকলে তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জানাতে হবে, এবং প্রশাসন যদি দায়িত্ব পালন না করে, তবে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
ছাত্রদলকে ঘোষণা দিতে হবে তারা কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ কিংবা সহিংসতার আশ্রয় নেবে না ক্যাম্পাসে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। শিবিরকে ঘোষণা করতে হবে তারা সকল ধরনের গোপন ছাত্র রাজনীতি থেকে সরে আসবে ও প্রকাশ্য রাজনীতি করবে। শিবিরের কেউ যদি এই ধরনের গোপন রাজনীতি কৌশলগত কারণে করে থাকেন, তাহলে তাকে সাংগঠনিক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে নিজেদের রাজনীতি স্পষ্ট করতে হবে। তারা আর কোনোভাবেই সাধারণ ছাত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন না, বরং তারা এখন একটি রাজনৈতিক শক্তি। এতে কোনো অন্যায় নেই। একটি স্বাধীন রাজনৈতিক পরিবেশে শিবির বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যদি কৌশলের দোহাই দিয়ে অপ্রকাশ্য রাজনীতি করে, তবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধরনের অপকৌশলের রাজনীতি ক্যাম্পাসের পরিবেশ দূষিত করবে।
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাজনীতি পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তিত রাজনীতিতে পূর্বের কৌশলের রাজনীতি করলে আপনারা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করবেন। রাজনীতি যা হবে, তা প্রকাশ্যে হবে; ছাত্র রাজনীতি কোনোভাবেই সহিংসতার আশ্রয় নিতে পারবে না। সহিংস রাজনীতি বা গোপন রাজনীতি করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিন। মনে রাখবেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার জায়গা। রাজনীতিতে অংশ নিতে পারেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ আপনাকে রাজনীতি শেখানো নয়, আপনাকে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং শেখানো।
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাজনীতি পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তিত রাজনীতিতে পূর্বের কৌশলের রাজনীতি করলে আপনারা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করবেন। রাজনীতি যা হবে, তা প্রকাশ্যে হবে; ছাত্র রাজনীতি কোনোভাবেই সহিংসতার আশ্রয় নিতে পারবে না। সহিংস রাজনীতি বা গোপন রাজনীতি করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিন। মনে রাখবেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার জায়গা। রাজনীতিতে অংশ নিতে পারেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ আপনাকে রাজনীতি শেখানো নয়, আপনাকে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং শেখানো।
আসিফ বিন আলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যনরত একজন পিএইচডি গবেষক
Leave A Reply