এমন এক প্রেক্ষাপটে আজ বাংলাদেশ রায়েরবাজারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছে যখন রাষ্ট্রীয় স্বার্থ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্ন উত্থাপন ও মতপ্রকাশের দায়ে সর্বশেষ শহীদের নাম আবরার ফাহাদ। তাকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে মেরে ফেলেছিল যারা সেই ক্ষমতাকাঠামোই ভিড় করে আছে শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধে।

আবার ঠিক এই সময়েই দুইটি ঘটনা ঘটে চলেছে, যা আমাদের তিনদিকের সীমান্ত ও রাষ্ট্রের ভালনারেবিলিটির সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্পর্কিত-আইসিজে তে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যার শুনানি ও ভারতের নাগরিকত্ব আইন। অথচ আমাদের সিভিল সোসাইটি ও আরবান সচেতন নাগরিক সমাজ এই দুই ব্যাপারেই মোটামুটি চুপচাপ……

এইখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যন্তরীণ ‘ভালনারেবিলিটির’ একটা ইংগিত পাওয়া যায়। এই রাষ্ট্র ও তার স্বার্থকে যেন ‘ওউন’ করছে কেবল শেখ হাসিনা ও তার দল। অবশ্য ওউনারশিপের এই হস্তান্তরের মুখ্য দায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের নয়, কারণ ক্ষমতাকাঠামো থেকে বলে দেয়া হয়েছে- হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বুদ্ধিজীবি হয়ে আমাদের মঞ্চে গান গাও, কবিতা পড়ো, আর শহীদুল আলমের মত মার খেতে চাইলে প্রশ্ন উত্থাপন করার দুঃসাহস দেখাও।

তাই মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তাদের সবচেয়ে বড় গ্লোবাল ইন্টেলেকচুয়াল ও পলিটিক্যাল আইকন যখন লিড দিচ্ছেন গণহত্যা ধামাচাপার ডিফেন্স তখন বাংলাদেশের কোন আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাসম্পন্ন মানবাধিকারকর্মী কিংবা একাডিমিশিয়ানকে আমরা দাঁড়াতে দেখছি না কোথাও, লন্ডন, নিউইয়র্ক, ব্রাসেলস বা বিবিসি সিএনএন এ।

কারণ গদগদ লোকাল মিডিয়ায় গাম্বিয়ার প্রশংসার বাইরে আমরা জানি না রোহিংগাদের নিয়ে আমরা আসলে কী করতে চাইছি, কি ভাবছি। দেশি-বিদেশি মিডিয়া, একাডেমিয়ায়, আন্তর্জাতিক পরিসরে ‘Concerted effort’ অবশ্য বহু পরের ব্যাপার, আপনি যদি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে জিজ্ঞেস করেন যে রোহিংগাদের নিয়ে দেশের স্ট্র্যাটেজি কী, উনি বলবেন ভাই দাঁড়ান, একটু গণভবন থেকে জেনে আসি! এই লুকোচুরি খেলা চলছে শুরু থেকেই, প্রথমে ইউএন ও আমেরিকান লবি এড়িয়ে চীনা ভাইদের দিয়ে মিয়ানমারের সাথে সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা থেকেই।

শুধু শেখ হাসিনাই সব জানেন, পুরো আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বেরও সব জানার দরকার নাই, আর বাকি আমজনতা নিজের কাজে মন দাও- এই নির্দেশ নাগরিকগণ বোধহয় মেনে নিয়েছেন, সর্বোপরি জবাবদিহিতা চাওয়ার এজেন্ট মিডিয়া এবং সিভিল সোসাইটিও, তাই এখন দেশের ডিসাইসিভ সংকটের ব্যাপারে আমাদের এটিচ্যুড বোধহয়- যা খুশি হোক, আওয়ামী লীগ সামলাক, আমাদের কী! এই সেটেলমেন্টে আওয়ামী লীগ যে বেজায় খুশি বলা বাহুল্য।

এরই মধ্যে পূর্ববংগের বদ্বীপকে প্রতিবেশীদের ‘ডাম্পিং জোন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সদয় সম্মতি দিয়েছেন পরম মিত্র ভারত। এতদিন রিলায়েন্সের বাতিল বিদ্যুৎ কেন্দ্র অথবা অবিক্রিত কয়লা ইত্যাদি ডাম্পিং চললেও এবার তারা মিত্র বাংলাদেশকে দিতে চাইছেন অত্যন্ত প্রিয় জিনিস-লক্ষ লক্ষ মুসলমান ভাই-বোন! এইবার আওয়ামী লীগ কিছুটা বিপদে, ট্রানজিট দিয়ে বিশাল লাভের বিজনেস কেইস নিয়ে যে ত্রিশ বছর বিতর্ক হয়েছে তা আর আর্গুমেন্ট করা যাচ্ছে না গত নির্বাচনের বন্ধক হিসেবে ট্যারিফ তুলে দেয়ায়, এর মধ্যে আবার লাখ লাখ রিফিউজি এলে সামাল দেয়া অসম্ভব।

কিন্ত মোদী-অমিত শাহ বাংলাদেশের ভালনারেবিলিটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন, সেইসাথে এইদিকের সীমান্তের রাজ্যগুলোতে ধর্মীয়-জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি ছাড়া বিজেপির পুরো ভারতের সিটের ভারসাম্য ধরে রাখা সামনে অসম্ভব হবে। বিজেপি দাঙ্গা ও মসজিদ ভাংচুরের রাজনীতি থেকে থেকে ফায়দা তোলা দল, এমন খোলা গোলপোস্ট পেয়েও তারা গোল দেয়ার চেষ্টা করবেন না প্রতিবেশীর সাথে সহাবস্থানের স্বার্থে এমনটা শেখ হাসিনাও ভাবেন না।

সামনের অস্থিরতা অবশ্যম্ভাবী, এবং যেহেতু আমরা আমাদের নক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত নিয়তি শেখ হাসিনার হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে আছি- তাই আমাদের কিচ্ছু করার নেই। আমাদের সিভিল সোসাইটিরও, যেহেতু এটা ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’!

শক্তিশালী শাসকেরা দুর্বল ও ভালনারেবল রাষ্ট্র রেখে বিদায় নেন। নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনা উভয়েই শক্তিশালী শাসক, এবং মজার ব্যাপার হল দুইজনেরই মঞ্চ ত্যাগের পর বিজেপি ও আওয়ামী লীগ উভয়েরই দল হিসেবে দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যত বলে আর কিছু নেই, সবটুকু পলিটিক্যাল ক্যাপিটাল উনারা নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই এনক্যাশ করছেন । কিন্ত উনারা যে ভালনারেবিলিটি রেখে যাচ্ছেন রাষ্ট্রের জন্য, সেই ভবিষ্যত আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।

তখন প্রায় সমাধানঅযোগ্য সংকটের ইতিহাস আমাদের আজকের বুদ্ধিবৃত্তিক নির্লিপ্ততা ও প্রতিরোধহীনতাকেই দায়ী করবে

গালিব ইবনে আনওয়ারুল আজিম মুক্তিফোরামের সম্পাদকমন্ডলীর একজন সদস্য

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply