ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে বলা হলে আমাদের কিছুটা শব্দার্থকভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। তবে, ফ্যাসিবাদের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার উপর রাজনৈতিক ইতিহাস এবং দর্শনের পণ্ডিতদের মধ্যে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক আছে। এই সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে নাগরিকদের নিজেদের পরিচিত হওয়া এবং বোঝাপড়াটা জরুরি।
আমার অল্প বোঝাপড়া এবং বিগত পড়ালেখা জানান দেয়, ফ্যাসিবাদী আখ্যানটি সর্বদা একটি পৌরাণিক, সোনালী অতীত, জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতার একটি কল্পিত সময়ের উপর নির্মিত মিথ। যা বহিরাগত আক্রমণকারীদের বা অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিবাজদের হাতে একটি করুণ পরিণতি। ফ্যাসিবাদী সরকারগুলো সর্বদা ক্ষমতায় আসে, তাদের অতীতের গৌরবময় সমাজগুলোকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনরুত্থিত করার প্রতিশ্রুতিতে। যা ঘটনাক্রমে, শ্রেণীবদ্ধ এবং পিতৃতান্ত্রিক ছিলো। যেগুলোতে শক্তিশালী ও সাহসী পুরুষরা কঠোর পরিশ্রম আর যুদ্ধ করেছিল এবং কর্তব্যপরায়ণ ও বাধ্য নারীরা বাড়িতেই থেকেছেন। আর পরবর্তী প্রজন্মকে বড় করেছেন।
এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, বর্তমান সরকার যে পৌরাণিক কাহিনী এবং প্রচারের পিছনে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে আক্রমণ করবে, যারা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার প্রচার করেন। যেগুলো ভিন্নমতের স্বাধীন এবং মুক্তচিন্তামূলক কণ্ঠস্বরকে আশ্রয় করে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে এবং তাদের প্রতিস্থাপন করে নিজেদের প্রিন্ট মিডিয়া এবং নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাশালী করে। যারা স্বাধীন এবং গণমানুষের কণ্ঠকে প্রত্যাখ্যান করে।
গত চার-পাঁচ মাসে নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে… আগেই শুরু হয়েছে মনে হয়, বুঝতে বা নজর দিতে পারিনি, কিন্তু ভুক্তভোগী মনে হয় আমরা অনেক আগে থেকেই হয়েছি। ফ্যাসিজম চলছে। তা হটানোর উপায় নিজ বন্ধুদের মাঝে আলাপচারিতা এবং কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে বন্ধুরা নিজেরা নিজেদের মাঝে গ্যাঞ্জাম করছে। যাকে পরিচিত লাগত, ভালোবাসা আসতো… সেই হঠাৎ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। কে কি প্রথমে করছে জীবনে তা নিয়ে উচ্চবাচ্চ বা লাফালাফি করছেন। লাফালাফির মধ্যে একে অপরের সাথে তর্ক, বিতর্ক আর বিতর্কিত সম্পর্ক ও ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতি এবং পরিবেশের সম্মুখীন হতে হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্যান্য নাগরিকদের। সবাই আমরা কখনো কোন না কোন উপায়ে মধ্যস্থতাকারী। কখনও অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত। এর মূল কারণ, প্রায় ১৭/১৮ বছর গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি। ফ্যাসিজমের উত্থান; গণতান্ত্রিক ব্যবস্থপনার চর্চার অভাব এবং বর্তমান আর্থিক সংকট।
বাংলাদেশে বর্তমানে ফ্যাসিবাদের ধারণা এবং প্রতীকগুলো নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনের শারীরিক ও মানসিক অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে উঠেছে। এই এনকাউন্টারগুলো তাদের পরিবেশ এবং একে অপরের সাথে কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করে নিজেকে পরিবর্তন করেছে, তা অনেক সময় আমাদের বোধগম্য হয় না। সেইক্ষেত্রে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত উভয়পক্ষ অভিযুক্ত হয়ে উঠেন দর্শক নাগরিকদের নিকট। অন্যদিকে, জনপরিসরে শাসক দলগুলোর পতাকা এবং স্লোগান, পার্টির নেতাদের ছবি, স্থানীয় ক্লাব আর অ্যাসোসিয়েশনগুলো এবং অন্যান্য তথাকথিত “শত্রু” নিষিদ্ধ করার চিহ্ন প্রকাশ করতে থাকে। যারা নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ম লঙ্ঘন করেছে, তাদের হয়রানির সাথে পুরো সমাজ জড়িত হয়ে পড়ে।
ফ্যাসিস্টরা ভয়কে উৎসাহিত করে সহিংসতা প্রচার করে। বিদেশী শক্তিকে হুমকি দিয়ে জনসমর্থন চেয়ে সাময়িক সফলতা পাচ্ছে। সঙ্কটের অনুভূতিকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু তারা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় গৌরবের আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও সমানতালে দিয়ে যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা বৈষম্য, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর-বিরোধীতা এবং ‘সংখ্যালঘুদের’ নিপীড়নকেও প্রচার করে। যাতে চিহ্নিত করা হয় কারা ছিল এবং কাকে তথাকথিত “জাতীয় ইতিহাস” থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্র দ্বারা “অপতন” বলে বিবেচিত শিল্প সম্পর্কে নাগরিকদের শেখানোর জন্য জাদুঘরগুলোতে প্রদর্শনীও করা হয়। দলীয় কার্যালয় এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এমন জায়গায় এবং আশেপাশে গড়ে ওঠে যেন সেগুলো তাদের বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তির জন্য পরিচিত ছিল কোন এক ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে।
ফ্যাসিবাদের সময় আমরা কী করি এবং কী বলি তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কোন প্রকার সহজ এবং সত্য অভিযোগ, অভিযোগের জবান, বা বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে স্বাভাবিক অভিযোগ হতে দিতে পারি না, ভয়ে বলতে থাকি নিজের কাজ করেন, কি দরকার, পাত্তা দিলে অভিযুক্ত বড় হয়ে যাবেন, মাফ করে দেন, তখন যিনি অভিযোগ করে তিনি কেবল দেখতে পান সমাজে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের প্রেক্ষাপটে ‘ক্ষমার সাংস্কৃতায়ন বা সংস্কৃতিকরণ’ কীভাবে তৈরী হয় তা দেখতে পারি, ক্ষমার সাংস্কৃতায়ন বা সংস্কৃতিকরণ’ অনেক সময় সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের বিশেষাধিকার পর্যন্ত বিস্তৃত (যা আসলে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের ২৬, ২৭, ৩১, ৩৫, ১১১ ও ১১২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক) এবং একে অপরকে আশ্বস্ত করতে পারি, যে জনগণ আসলে এটি মানে না, তারা এতদূর যাবে না এবং একদিন প্রতিরোধ হবে।
প্রতিরোধে বিপ্লব আসবে সেই আশায় আমরা হয়ে উঠি বৈপ্লবিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক বা সভাপতি এবং কবি, সাহিত্যিক, লেখক হয়ে উঠছেন তিক্তকর টিকটকার এবং ইমেইলের বিবৃতির স্বাক্ষরকারী। ফ্যাসিবাদ উপহাস করে এবং দক্ষতার অবমূল্যায়ন করে। উদার গণতন্ত্রে, রাজনৈতিক নেতারা কেবল তাদের প্রতিনিধিত্বকারী লোকদের সাথে নয়, ডোমেন বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীদের সাথেও পরামর্শ করছেন। কিন্তু ফ্যাসিস্ট নেতারা সর্বদাই নিজেদেরকে “কর্মপরায়ণ” বলে গর্বিত করে, যাদের পরামর্শ বা আলোচনার জন্য খুব কম বা কোন লাভ নেই। অন্যদিকে ফ্যাসিস্টরা আমাদের ইমেল এবং ফোন কলগুলিকে ততটা হ্যাক করে না যতটা তারা আমাদের ভয়, ঘৃণা এবং অসারতার অনুভূতি হ্যাক করে। তারা তখন এই অনুভূতিগুলোকে ব্যবহার করে, যেগুলো তাদের হাতে অস্ত্রে পরিণত হয় মেরুকরণ এবং ভেতর থেকে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য। ফ্যাসিবাদে আক্রান্ত সমাজের জন্য এটা জানা এবং বোঝাই সম্ভবত একমাত্র পরিত্রাণ। যদি সমাজে যথেষ্ট লোক একত্রিত হয় যারা শিক্ষা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে মূল্য দেয় এবং গ্রহণযোগ্যতা, অন্তর্ভুক্তি এবং নম্রতাকে (ভয়, ঘৃণা এবং অসারতার বিপরীত) সমর্থন করে, তবে ফ্যাসিবাদের বিস্তার এখনও বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অনেকের জন্য সত্যি পুরাণ প্রবাদ সত্যি হয়, ফ্যাসিবাদ আমাদের বন্ধু হিসাবে আসে, বলতে থাকে এটি আমাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করবে, আপনাকে গর্বিত করবে, আপনার ঘর রক্ষা করবে, আপনাকে একটা চাকরি দিবে বা চাকরি বাঁচাবে, চাকরিকে গর্বিত করবে, আশেপাশে উন্নয়ন করবার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে, আপনাকে মনে করিয়ে দিবে যে আপনি মহান এবং বার বার মনে করিয়ে দিবে আপনি একসময় কত মহান ছিলে, এবং দুর্নীতিবাজদেরকে পরিষ্কার করবে কিন্তু নিজে করবে, আপনি নিজেদের মাঝে যা ভিন্ন মনে করেন তা সরিয়ে ফেলতে উস্কানী দিবে… এবং আপনি মনে করেন যে সমস্ত কিছুর জন্য আপনাকে সংগ্রাম করতে হবে। আর বাড়িতে ফিরে সন্ধ্যা থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত চিন্তা করবেন:
আজ রাতে …
আমরা আরেকটি ইতিহাস বর্ণনা করব
সেই দীর্ঘ বিশ বছরের ছোট দৈনন্দিন ইতিহাস:
স্বপ্ন, আশা, মায়া, সংগ্রাম, অভ্যাস,
কাজ, পরিবার, স্কুল, খাওয়া দাওয়া, বিবাগী হওয়া
কিন্তু ছুটির দিন, খেলাধুলা, ফ্যাশন এবং বিনোদন।
কিন্তু শাসন চিত্রের উপস্থিতি,
নিজেদের বিচারে নিজেদের সাক্ষ্য
এই সাক্ষী ও সাক্ষ্য দেওয়া যেন অফিসিয়াল দুঃস্বপ্ন।
লেখক: রেজাউর রহমান লেনিন
সমাজ-রাজনৈতিক গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী