তিন ধরণের মানুষকে এই ২০১৯ সালে পাকিস্তান নামক দেশটির নাম মুহুর্মুহু নিতে দেখা যায়। একটি মাত্র শ্রেণিই এর মধ্যে নিরীহ, এবং এই পোস্টটি কেবলমাত্র তাদের জন্য লেখা।

পূর্বকথা :পাকিস্তানের সাথে আমাদের কনফ্লিক্টটা কি নিয়ে?

এই ভূখণ্ডের সাথে পাকিস্তানের কোনও দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। তারা হাজার মাইল দূরের একটি ভূখন্ড। তাদের সাথে আমাদের কনফ্লিক্ট ১৯৪৮-১৯৭১ নিয়ে। এর রেশ ধরে আগে এবং পরেও যেতে পারে টাইমলাইনের কিছু খুচরো ডেট, তবে তারা রিলেটেড টু ৪৮-৭১।

 “পাকিস্তানের প্রতি” ঘৃণার কথা বলে একটি গোষ্ঠী ও তাদের অনুসারীরা আমাদের একেবারে মোরালি ডিফ্লেক্টেড করে ফেলেছে গত বিশ-পঁচিশটি বছর ধরে। খুবই দুঃখ হয়, কারণ দলটির নাম আওয়ামী লীগ এবং তাদের অন্যতম কর্ণধার বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত অন্তত পাকিস্তান চিন্তায় আমার চিন্তাধারাই ধারণ করতেন। এই বর্তমান পাকি-ছাগু ট্যাগার জঙ্গিদের চিন্তা তিনি ধারণ করতেন না। 

কারা পাকিস্তান নিয়ে মাতামাতি করে : 

১। পাকিস্তানকে যারা ধর্মের ভিত্তিতে কাছে টানেন এবং মনে করেন মুসলমানিত্বের দিকে এই ভূখণ্ডের রাজনীতি শিফট করতে হলে কাছে থাকা একমাত্র মুসলিম সুপারপাওয়ার (!) পাকিস্তানের সাপোর্ট প্রয়োজন। এদের দলটির প্রতিষ্ঠাতাও পাকিস্তানের এবং দলটিও পাকিস্তানের। কাজেই পাকিস্তানের প্রতি তাদের এক জন্মগত আনুগত্য আছে। দলটির নাম জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ(১)। রাজনৈতিক ভিত্তি যেহেতু মানুষের আইডেন্টিটির একটা অংশ, এরা ১৯৭১ সালের লাখো শহীদ নিয়েও সব সময় ডিনায়ালে থাকেন। পাকিস্তানের দোষ যতখানি কমিয়ে বলা যায়।

এই শ্রেণিকে আমি খোলা বইয়ের মত পড়তে পারি, কারণ তাদের মতাদর্শ অনুসারে তারা ঠিক তা-ই করছে যা তাদের করার কথা। এরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসীও না। কাজেই ওদের আমি গণতান্ত্রিক লেকচার দিতে পারবো না। তারা চাপাতি বের করবে, আমি বের করবো পিস্তল। এটাই হলো এই শ্রেণির সাথে আমার একমাত্র আলোচনার জায়গা।এরা প্রথম শ্রেণি, যারা দিবারাত্রি পাকিস্তানের জিকির করেন।

২। দ্বিতীয় শ্রেণি ক্ষমতালোভী ও ধুরন্ধর। বর্তমান আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বৃহদাংশ। মুসলিম আর মেক্সিকান না থাকলে ট্রাম্প যেমন ভোট পেতেন না, তেমনই পাকিস্তান শব্দটা এই ভূখণ্ডে জারি না থাকলে তারাও ভোট পাবেন না। (এমনিতেও পাবেন না। একটি নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন হলে দরকার হলে মানুষ গাধাকে ভোট দেবে। তাদের নয়)

ব্যবসায়ীরা বা স্টার্ট-আপ (বাচ্চা ব্যবসায়ীরা) কীভাবে আইডিয়া জেনারেট করেন, তা হয়ত আপনারা জানেন। তারা একটি বর্তমান সমস্যার সলিউশন দেন। ধরা যাক খাবার নিয়ে শহরে অনেক ক্রাইসিস, তো নিয়ে আসো ফুড অর্ডার। যাতায়াত নিয়ে অনেক ক্রাইসিস এই শহরে, ঘণ্টায় গতি ৪ কিলোমিটার, নিয়ে এসো পাঠাও। ক্লিক করে এই ব্যাপারগুলো। মানুষকে একটা সমস্যার সমাধান করে দিলে সবাই সার্ভিস নিবে।

আওয়ামী লীগের একধরণের উগ্রপন্থী সমর্থক আছেন, তাদের কাছে সমস্যা হলো “পাকিস্তান” এবং এ থেকে তারা দিবারাত্রি বাঙালিকে রক্ষা করে যাচ্ছেন। খারাপ লাগে যখন বুঝি এঁরা সবটুকু বুঝেই কাজটা করেন। জনতাকে নাচাতে।

পাকিস্তান আমাদের জন্য এখন সমস্যা নয়, এমনকী মাথাব্যথার কারণ পর্যন্ত নয়। পাকিস্তান এই পৃথিবীতে থাকুক বা না থাকুক আমাদের কিছুই আসে যায় না। পাকিস্তান নিয়ে একটা মাত্র আলোচনার জায়গা আছে, তা হলো ১৯৪৮-১৯৭১। এই বিশেষ গোষ্ঠীটি তাতে সন্তুষ্ট নয়। এরা পাকিস্তানকে ২০১৯ সালেও জিইয়ে রেখেছে।

কে আফ্রিদিকে জড়িয়ে ধরলো তা নিয়ে এরা ফেসবুক কাঁপায়। বিষয়গুলো একেবারেই তুচ্ছ বিষয়ের মত ইগনোর করে গেলে পাকিস্তান কোনই ভাত পায় না। অথচ এই মাথামোটা ব্যবসায়ীদের অতি-আদিখ্যেতায় দল নম্বর ১ পালে প্রচুর হাওয়া পাচ্ছে। বিনে পয়সার বিজ্ঞাপন তাদের হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মাটিতে আজও ‘পাকিস্তান’ শব্দটার একটা ওজন আছে। এই ওজন আছে আওয়ামী এই আহাম্মক সমর্থকগুলোর আদিখ্যেতার জন্য। এরা ১৯৪৮-১৯৭১ এর বাইরেও পাকিস্তানের জিকির করে। পাকিস্তানের বর্তমান ব্যাটসম্যান নিয়ে যতটা খবর তারা রাখে, অতটা জামায়াতে ইসলামীর লোকজনও রাখে বলে আমার মনে হয় না।

কে কোথায় খারাপ খেললো তা এদের জানা চাই। পাকিস্তানের অর্থনীতির ডেইটা তাদের জানা চাই। ছোটলোকি চিন্তাভাবনা। বঙ্গবন্ধুর মানসিকতাও এমন ছিলো না। তিনি পরিষ্কার বলেই দিয়েছিলেন, “তোমরা তোমাদের মত থাকো। আমরা আমাদের মত থাকি।” (বঙ্গবন্ধুকে আমি যে যুগপৎ সম্মান করি, ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে তিনি আপনাদের মত পাকি-হেটার তিনি হলে তার কিছুটাও করতাম না। তিনি উইটি ছিলেন এবং পাকিস্তান বিদেয় হওয়ার সাথে সাথে বর্তমান কর্তব্য নিয়ে ব্যস্ত হয়েছেন।

এই প্রজন্মের নিম্নবুদ্ধিমত্তার কিছু মানুষ সেখানে টাইম ট্রাভেল করে ৪৮-৭১এ পড়ে আছেন।) এই পাকিস্তান-হেটারগুলো নিজেদের মত থাকবে না। সব সময় তাদের চোখ পাকিস্তানের দিকে। সপ্তাহে অন্তত একদিন ইনাদের কল্যাণে আমাকে হোমপেজে দেখতে হয় পাকিস্তানের কোনও খবর। গাধাগুলো মহা উৎসাহে শেয়ার করে পাকিস্তানের ব্র্যান্ডিং করে চলেছে।

আমি পাকিস্তানের খবর জানতে চাই না। পাকিস্তান নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নাই। তারা উন্নত হয়ে চীন হয়ে গেলেও আমার সমস্যা নাই। তারা ফকির হয়ে সোমালিয়া হয়ে গেলেও আমার কিছু এসে যায় না। এইসব নিয়ে দয়া করে পড়ে থাকবেন না। নিজের ও অন্যদের সময় পাকিস্তানের জিকির করে নষ্ট করবেন না, আওয়ামী সমর্থক ভ্রাতাগণ।

৩. এরা হলেন মুরিদান। ইনাদের কারও কারও চোখে আমার গতিবিধি সন্দেহজনক। পাকিস্তান নিয়ে এখন আর মাতামাতি না করতে বলার কারণে আমিও দেশের শত্রু। ইনাদের এখনও পথ খোলা আছে। সঠিক উপলব্ধি হলেই তাঁরা বুঝতে পারবেন, এটা একটা রাজনৈতিক মূর্খামি।

আপনারা বাঙালির রক্ত নিয়ে শোকাহত, আর আপনাদের শোক কাজে লাগিয়ে ওরা আপনাকে এই ২০১৯ সালেও পাকিস্তান নিয়ে পড়ে থাকতে বাধ্য করছে। পাকিস্তান নামটা শুনলে আপনার ভেতরে ঘৃণার পাহাড় উথলে উঠলে আপনি দেশপ্রেমিক নন। আপনি গোরু। আপনি ব্যবসায়ীদের কাস্টোমার। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হলে পাকিস্তান বা তাইওয়ানের নাম শুনলে আপনার মনে খুশির হিল্লোলও দেখা দেবে না, ঘৃণার বিস্ফোরণও ঘটবে না।

আপনারা ২০০৩ সালেও ৭১ নিয়েই পড়ে ছিলেন। পাকিস্তানিদের গালি দিতে দিতে কখনও লক্ষ্য করেননি, পাকিস্তানিদের মতই আমরাও করেছি, করছি। বাঙালিও ধোয়া তুলসিপাতা না। রাজনীতির মাঠে অনেক বছর সক্রিয় থেকেও আমার থেকে রিটার্ডেড রাজনীতি বোঝা মানুষ দেখেছি। তারা অন্ধের মত ২ নম্বর দলের দিকে ছুটেছেন। অথচ পাকিস্তানি বা বাঙালি নয়, সমস্যা ক্ষমতাধরের।

আপনি যদি মানুষকে ভালোবাসতে চান তাহলে ট্যাগ লাইন থেকে বের হতে হবে। পাকিস্তান মানেই খারাপ না। বাঙালি মানেই খারাপ না। পাকি বা ছাগু ট্যাগলাইন যারা ব্যবহার করেন তাদের থেকে সতর্ক দূরত্ব অবলম্বন করুন। আপনার ব্রেইনওয়াশ যদি দ্বিতীয় দলটি করে থাকে, এখনও হয়ত বেরিয়ে আসতে পারবেন। সতর্কভাবে দেখুন। নিজের মাথাটা খাটান।

১৯৭১ নিয়ে প্রচুর ব্যবসা হচ্ছে। আপনি যে কোনও শহীদের বর্ননা পড়েই আবেগে ক্ষেপে উঠবেন না। আপনার শহীদদের প্রতি ভালোবাসা কাজে লাগিয়ে ২ নং দলটি কিছু নিজস্ব ব্যবসায়ী চেতনা ইঞ্জেক্ট করতে চাইছে। আমি লেখক হিসেবে এটা স্পষ্ট দেখতে পাই। অনেক পাঠক না বুঝে টোপটা গিলে ফেলেন।

১৯৭১ সাল নিয়ে আমিও লিখি, শহীদদের প্রতি ভালোবাসা থেকে। নিজের খেয়ে জানার চেষ্টা করি, গবেষণা করার চেষ্টা করি। লিখবোও। কারণ, ১৯৭১ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেসব বেকুব ১৯৭১ সালের পর অদরকারে পাকিস্তান পাকিস্তান করবে, তাদের মত নিম্ন আইকিউধারীদের সাথে আমার অন্তত কোনও সম্পর্ক নেই। 

১৯৭১-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আমার দেখা দ্বিতীয় বাংলাদেশ হচ্ছে পাহাড়ি সম্প্রদায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের সাথে ঠিক যা যা করেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের সাথে ঠিক তা-ই করেছে

রেপ, চাইল্ড কিলিং, চাইল্ড অ্যাবিউজ, জেনোসাইড। আপাতত এই নিয়ে পড়াশোনা করছি। বুঝতে শিখেছি পাকিস্তান নামটা নিয়ে নয়, সমস্যা অন্যখানে। পাকি-ছাগু যেমন গালি, একই তত্ত্বে বাঙালিও গালি। অথচ আমি এত সহজে জাজ করে রায় দিবো না। আমার মনে হয় দোষটা ক্ষমতাসীনদের। আর আপনারা ৩ নম্বর ক্যাটাগরির মানুষ যারা – তারা দয়া করে ক্ষমতাসীনদের ফাঁদে আটকে যাবেন না। চোখ মেলতে শিখুন।

(১) গুগল করে দেখে ইসলামী নামটা ঠিক করেছি। পাকি-ছাগু জঙ্গিরা আবার আমাকেই সঠিকভাবে দলটির নাম লেখার জন্য জামাত ট্যাগ দেবেন না। উল্লেখ্য, জামাত-শিবিরের এজেন্টরা বিশুদ্ধভাবে দলটির নাম লিখে, বাকিরা লিখেন জামাত – এই থিওরিস্ট ব্লগার অনেক ছিলো আগে।

কিশোর পাশা ইমন একজন লেখক ও অনুবাদক

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply