ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, তাই প্রতিটিবার যখন নূরের মতো কোনো ছাত্রকর্মীর ওপর হামলা হয়, তখন ইতিহাসের অনেক ঘটনা খেয়ালে আসে, কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা এতটাই সম্প্রতি যে সেই ঘটনাগুলোকে ইতিহাস ডাকতে দ্বিধাবোধ করি | সম্ভবত চক্ষুলজ্জা যখন চলে যায় তখন প্রতি মাসে ইতিহাস একবার করে পুনরাবৃত্তি হয় |
নুরুল হক ঢাকা উনিভার্সিটির Central Student Union ডাকসুর ভাইস প্রেসিডেন্ট, এবং তিনি কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নূরের বিএনপি এবং জামাতের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই, তাই তার বিরুদ্ধে হামলা করে ‘উনি স্বাধীনতা বিরোধী/টেরোরিস্ট’ বলে সেই হামলা বৈধ করা দুষ্কর। একটা টেরোরিস্ট/আতঙ্কবাদী দলের সংজ্ঞা হচ্ছে তারা হিংস্রতা ব্যবহার করে, আতঙ্ক ছড়িয়ে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় । ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে এখন এমনই একটি আতঙ্কবাদী দল হচ্ছে ছাত্রলীগ । গত বিশ বছরে ‘টেরোরিস্ট’ শব্দটার সাথে ধর্ম ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে, কিন্তু আতঙ্কবাদীতার উৎস শুধু ধর্মই হয় না, রাজনীতিও হয় । নূরের ওপর, আবরার ফাহাদের ওপর যে ধরণের হামলা করা হচ্ছে সেটা ছাত্রলীগ নামে একটি সন্ত্রাসবাদী দলের করা । বাংলাদেশী বামপন্থীরা শিবিরকে আতঙ্কবাদী আখ্যা দিতে দ্বিধা করে না, কিন্তু ছাত্রলীগকে এহেন নাম দিতে সংকোচ বোধ করে । এটা এক ধরণের সেলফ-সেন্সরশিপ – we want to speak truth to power, but only after the concerned party has left the position of power – অর্থাৎ আমরা প্রকৃত অর্থেই শক্তের ভক্ত এবং নরমের যম ।
এবং সেলফ-সেন্সরশিপের আরেকটি নমুনা উল্লেখ করি । গত অক্টোবরে আবরার ফাহাদের মৃত্যুর পরে যখন দেশজুড়ে ক্যাম্পাসগুলোতে অস্যংখ্য টর্চারের ঘটনা বেরিয়ে আসে, একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমীহ ভরে প্রশ্ন করা হয় “একটা ছোট দুঃখের কথা বলি, আপনাকে আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি, আপনাকে সবাই আশার প্রতীক, ইত্যাদি বলেন – এটি আমাদের জন্যে আনন্দের, সাথে দুঃখেরও । কারণ যখনিই যে ঘটনা ঘটে, আপনার পুলিশকে নির্দেশ দিতে হয়, আপনার ফায়ার ব্রিগেডকে নির্দেশ দিতে হয়, আপনাকে ছাত্রলীগকে নির্দেশ দিতে হয়…” – এখানে প্রশ্নটা ছিল একটা ছোট ক্রিটিসিজম, এবং ক্রিটিসিজমটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ না । এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এতটুকু সমালোচনা করতে কতটুকু তোষামোদ দিয়ে শুরু করতে হয়েছে। আর এই ব্যাপারটি হয়েছে আওয়ামী শাসনের নিপীড়ণের বহু ঘৃণ্য মুহূর্তের একটিতে । এমন একটি সময়েও আমাদের প্রধানমন্ত্রী – যিনি এগারো বছর ধরে একচেটিয়া ক্ষমতা দখল করে আছেন, এবং যার রাজনৈতিক দল সাধারণ ছাত্রদের পিটিয়ে খুন করে ফেলছে – তিনি কিন্তু একজন আশার প্রতীক।
এখন ফিরে আসি নূরের ব্যাপারে । নুর বিএনপি/জামাতের সাথে রাজনৈতিক ভাবে অসম্পৃক্ত, কিন্তু সে আওয়ামী লীগের সমর্থনকারীও না । সে রাস্তায় নেমে লড়েছে, সে হামলার স্বীকার হয়েছে । আবরার ফাহাদকে শিবির সন্দেহে মারা হলেও সে রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় ছিল এমন কোনো নজির নেই – তার মৃত্যুর কারণ পরিশেষে এটাই যে সে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছিল । এখানে খুব গভীর ভাবে চিন্তা না করলেও এই হামলা এবং মৃত্যুগুলোর মূল ব্যক্তবটি পরিষ্কার – আওয়ামী লীগের সমালোচনার পরিনাম ভয়াবহ ।
ধর্মান্ধ টেরোরিস্ট-রা যখন ব্লগারদেরকে খুন করে, তখন যথার্থ ভাবেই আমরা আতংকিত হই – আমাদের সমাজ কোথায় যাচ্ছে চিন্তা করে বিচলিত হই । আমাদের রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা কিন্তু শুধু আবরার ফাহাদকেই খুন করেনি – সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশ আবরারের পরিবারকেও নাজেহাল করেছে । আবরারের ছোট ভাই তার পরিবারকে নিপীড়ন করা হচ্ছে এটা লিখে স্টেটাস দেয় – যা কিছুক্ষন পরে সরিয়ে ফেলা হয় । বুয়েট-এর যে পেজ অত্যাচারের গল্পগুলোকে সংগ্রহ করছিলো সেটাও বন্ধ করে দেয়া হয় । ব্লগারদের যেসব আতঙ্কবাদীরা খুন করেছে এরা কিন্তু ফের গিয়ে ব্লগারদের পুরো পরিবারকে নাজেহাল করেনি । কিন্তু আওয়ামী লীগের সেটা করার ক্ষমতা আছে, এবং তারা করেও যাচ্ছে । আমাদের সমাজ কোথায় যাচ্ছে এটা ভাববার সময় এখন নেই – ধর্মান্ধ আতঙ্কবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করতে গিয়ে এদিকে এতো জোরালো একটি আতঙ্কবাদী শক্তি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়ে গেলো কিভাবে এখন সেটা ভাববার সময় ।
নূর বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগ নয় । সে হচ্ছে তৃতীয় শক্তি । সে কোনো ভীরু, ‘অরাজনৈতিক’ তৃতীয় শক্তি নয় – যেখানে সরকারের আচরণ একটা আতঙ্কবাদী প্রতিষ্ঠানের মতো, সেখানে অরাজনৈতিক ‘শক্তি’ কোনো শক্তিই না, সেটা মৌনভাবে ক্ষমতাসীনদের দালাল । এখন ‘অরাজনৈতিক’ ভাবে ক্ষমতাসীনদের দালালী কিভাবে করতে হয় সেটার প্রধান উদাহরণ পরিবেশন করেছেন ঢাকা উনিভার্সিটি উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান । ছাত্রলীগের মারমুখী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন ‘আশা করি আমরা সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করব, যে যেখানেই থাকি ৷ কোনো সংগঠন বা ব্যক্তিকে দায়ী না করি ৷ আমরা যেন নিয়ম-নীতি ও মূল্যবোধের মধ্যে থাকি ৷’ আক্রমণকারী এবং আক্রমণে আক্রান্ত দুই পক্ষকেই ‘ভালো হয়ে যাও’ এমন নীতিকথা বলা ভাড়ামী – এটা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিশ্চয়ই বোঝেন । তাকে নিয়ে হাসাহাসি করা যায়, কিন্তু মুখফুটে কিছু বলার ক্ষমতা তার নেই । ক্ষমতা যার হাতে আছে, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করার সাহস আমাদের নেই ।
পার্শবর্তী দেশ ভারতে বামপন্থীরা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সোচ্চার । তাকে নিয়ে একটি পোস্টার দেখলাম, যেখানে লেখা
“মোদী সাপোর্টাররা বলে থাকেন:
তিনি সেটা বলেননি, আর বলে থাকলেও
তিনি এটা বোঝাতে চাননি, আর যদি বোঝাতে চেয়েও থাকেন,
তুমি সেটা বোঝোনি ।
আর যদি বুঝেও থাকো, এটা তেমন কোনো বড় ব্যাপার নয় ।
আর যদি বড় ব্যাপার হয়েও থাকে, তাহলে অন্যরা আরো খারাপ করেছে ।”
ক্ষমতা আছে শেখ হাসিনার হাতে, এবং তাকে নিয়ে কারো কিছু বলার সাহসটা আমাদের আর নেই । তাকে নিয়ে এখনো কেউ কেউ জোর গলায় অজুহাত দিয়ে যাচ্ছেন । এখানে মোদির জন্যে বলা প্রত্যেকটি লাইন শেখ হাসিনার জন্যেও প্রযোজ্য । অনেকে এখনো ছাত্রলীগ, পুলিশ, আওয়ামী লীগের বিভীন্ন কুকর্মের জন্য শেখ হাসিনার ‘হস্তক্ষেপ কামনা’ করেন । ‘তিনি নিশ্চয়ই এটা বোঝাতে চাননি’ – এটা ভেবে হাস্যকর ভাবে আশায় বুক বাঁধেন । এগারো বছর ক্ষমতায় থাকার পরে ‘বিএনপি আরো খারাপ করেছিল’ এইসব বেশ একঘেয়ে হয়ে গেছে – নতুন অজুহাত লাগবে । বিএনপি পনেরো বছর আগে কি করেছিল সেজন্য নিশ্চয়ই বাধ্য হয়ে আবরারকে মারতে হয়নি, নুরুলকে হামলা করতে হয়নি?
“Surely, comrades, you do not want Jones back?” এই মন্ত্র আর কতদিন?
মুক্তিফোরামের পক্ষে সম্পাদকীয়টি রচনা করেছেন তনিমা