শাহ আবদুল করিম ভাটির এলাকায় বসে সেই কবে চিঠি লিখে তাঁর এলাকার মানুষে জীবন-যাপনকে তুলে ধরেছেন, নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতায় ‘রাষ্ট্র’ ও তার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন, নিজের মতো করে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছেন রাষ্ট্রীয় কলকব্জাকে, এবং, অদ্ভুতভাবে হলেও এতো নিখুঁত ও বিস্তৃত দৃষ্টি সাধারণত গবেষকের কাছ থেকেও আশা করা যায় না, অথচ ২০১৯’র শেষ প্রান্তে বসে আমি অবাক হয়ে পড়ছি তার সেই ‘ভাটির চিঠি’।
যাকে সারাজীবন বাউল বলে জেনে এসেছি, বলা যায় আউল-বাউল, তার কাছ থেকে আমাদের রাষ্ট্রের সমস্যাকে চিহ্নিত করা ও সেই সমস্যার সমাধানের ইশারা দেখে এই শীতের রাতে উত্তেজনায় কাঁপছি।
এইতো গতবছর যখন মাশরাফির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে দেশীয় ফেসবুক-সমাজে রীতিমতো তর্ক-বিতর্কের ঢেউ উঠলো। একপক্ষ বললেন, মাশরাফির মতো ‘ভালো’ মানুষদের অংশগ্রহণ ভালো রাজনীতির জন্ম দিবে, আবার অন্যপক্ষ বললেন, যে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো বিদ্যমান সেই কাঠামোর সংস্কার ব্যতীত কোন ভালো ফল আসবে না। এই স্ট্রাকচারে ভালো মানুষ নির্বাচনে দাঁড়ালে তিনি আসলে কিছুই করতে পারবেন না। স্ট্রাকচারের কাছে তার হাত পা বাঁধা। হ্যাঁ,আমার নিজের অবস্থান ছিল এই দ্বিতীয় দলে। কি তুমুল তর্ক-বিতর্ক করেছি।
আজকে যখন শাহ আবদুল করিমকে পাঠ করছি তখন দেখি আমাদের বাউল সেই কবে নির্বাচনের বিষয়ে ফায়সালা করে দিয়ে গেছেন। বাউল দেখাচ্ছেন, এমন নির্বাচনের উছিলায় এক গ্রামের মানুষ পাঁচ দলে বিভক্ত হয়ে দলাদলি, মারামারি, মামলা-মোকদ্দমা করে।
বাউল এখানকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ানোর ও ভালোবাসা-সম্প্রীতি কমানোর হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। ভালো মানুষের নির্বাচনের অংশগ্রহণের ফায়দা কদ্দুর হবে তা নিয়ে আমাদের কতো কঠিন কঠিন আলোচনা, অথচ, ভাটির বাউল কতো সহজ সরল ভাষায় বলছেন,
শোষকের শাসনতন্ত্র বহাল থাকিলে
কী হবে পার্লামেন্টে ভালো লোক দিলে।
শোষকের তৈরি শাসনকাঠামো যে তার
কৃষক-মজুর শোষণের হাতিয়ার।
কাল যা ছিল আজো আছে ভেবে দেখ তাই।
এই তন্ত্রে শোষিতের পক্ষে কিছুই লেখা নাই।
এই লাইনগুলো পড়ে হিসেব মিলাতে আমার কষ্ট হচ্ছিল, এটা কি কোনো ‘তাত্ত্বিকে’র বয়ান, নাকি একজন ‘আউল-বাউলে’র কথা। ভাটির চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে, তার রচনা খুব সম্ভব আরো বহুত পূর্বের। আমাদের মাটির বাউলরা ‘আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা’দের জবানে তাদেরই অন্তরে লুকায়িত বয়ান তুলে ধরেন। সেই কথাগুলো কতো পূর্বে বলা হয়েছে, আর আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এখনো এইসব হয় বুঝেন না, না হয় বুঝেও না বুঝার ভান করেন।
আবদুল করিমের ‘ভাটির চিঠি’ নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে। শুধু ইচ্ছা না, লিখবোই। করিমের এই চিঠি থেকে আরো দুইটা লাইন দিয়ে শেষ করি।
নোয়াম চমস্কিকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি তো এতো সুন্দর সুন্দর বিষয়ে কথা বলেন, সাধারণ মানুষ এইগুলো শুনেনা বা মানেনা কেন? চমস্কি তখন উত্তর দিতে গিয়ে যা বলেছিলেন তা খানিকটা এরূপ, এই নিওলিবারেল জমানায় মানুষকে তো দৌড়ের মধ্যে ফালায়ে দেয়া হয়েছে।
যে দম্পতিকে টেবিলে খাবার জোগাড় করতে দুজনকেই সপ্তাহে ৫০ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়, তিনি কখন ও কীভাবে মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রী হবেন? বা সেই চিন্তা করার মতো সময়ও তার থাকবে না। মানুষজন ক্রমাগত উদ্বিগ্ন ‘আমি কীভাবে খাবার জোগাড় করবো’ অথবা ‘আমার বাচ্চাকাচ্চাকে কীভাবে লালন-পালন করতে হবে। এবং বাচ্চাটা অসুস্থ হলেও আমাকে কাজে যেতে হবে, তখন তাদের কি হবে’, এমন হাজারো চিন্তা সাধারণ-জনগণকে ক্রমাগত পেরেশানির মধ্যে রাখছে। এইসব আসলে শৃঙ্খলা আরোপের অংশ, এবং খুব সুপরিকল্পিত কৌশল। তো, এইসব মোকাবিলা করে একজন মানুষের সময় কোথায় সে মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রী হবে কি হবে না এইটা নিয়া ভাবার।
নোয়াম চমস্কি এতো কঠিন কঠিন ভাষায় যা বলেছেন, আমাদের ঘরের ও মাটির বাউল তার চিঠিতে গানে গানে বলছেন:
নিরপেক্ষ থাকে যারা সাধারণ মানুষ
চারদিকের তাড়নায় হয়ে যায় বেহুঁশ।
যতদিন যাচ্ছে, যত সময় যাচ্ছে, বাউল শাহ আবদুল করিমের প্রতি আমার কেবল মুগ্ধতা বাড়ছে।
এখানে যারা রাজনীতি করেন, তাদের জন্য শাহ আবদুল করিমের ভাটির চিঠি পড়া ফরজ।
করিমের ভাটির চিঠি বইটা পড়ার জন্য হাসিব ভাই আমাকে বারে বারে তাগিদ দিয়েছেন। বইটা জোগাড়েও সাহায্য করেছেন। ভাইয়ের প্রতি শুকরিয়া।
সহুল আহমদ, মুক্তিফোরামের একজন সম্পাদক ও রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য