আজ জাতীয় সংসদে জেলে বন্দী শরিয়ত বয়াতি সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “নিশ্চয়ই কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রীর এই কথা শুনে আমি মোটেও অবাক হইনি, কেন হয়নি জানেন? ঢাকা শহরে একসাথে ঘোরার জায়গার খুবই অভাব, তাই চলুন একটু ইতিহাস ঘুরে আসি।
১৯৯৮ সালের কথা, প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছে শেখ হাসিনার আওয়ামিলীগ সরকার। কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় ফকির লালনের আখড়া, সেখানে সাধু-সন্যাসী বাউলগণ ব্যস্ত আছেন যার যার গান, প্রকৃতি-পরিবেশ আর নিসর্গের ভাবনা নিয়ে। হটাত’ই সরকার সমন জারি করলো লালনের আখড়া উচ্ছেদের। এবং উচ্ছেদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো। ক্ষেপে উঠলো বাউল সমাজ, ক্ষেপে উঠলো বাংলার প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী এবং লালন সাঁই এর আখড়া স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে গড়ে উঠলো আন্দোলন। সেই লালন আখড়া রক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন কবি শামসুর রাহমান, এমিরেটস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য সহ আরো অনেকে।
১৯৯৮ সালের ৮ জানুয়ারি প্রেসক্লাবে একটি সমাবেশও আয়োজন করে লালন আখড়া রক্ষা আন্দোলনের নেতারা। সে যাত্রায় আওয়ামীলীগের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিল বাংলার বাউল সমাজ। কিন্তু তাঁদের উৎখাতের চেষ্টা থামেনি।
১৯৯৮ তো ২২ বছর আগের ইতিহাস, এবার চলুন সমসাময়িক কিছু ঘটনা দেখি।
২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল, সকালে রাজশাহী নগরের শালবাগান এলাকায় নিজের বাড়ি থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। রেজাউল করিম বাউল ঘরানার মানুষ ছিলেন, সেতারা বাজাতেন, ‘কোমলগান্ধার’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ‘সুন্দরম’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। দক্ষ সেতার বাদক রেজাউল শালবাগানে একটি গানের স্কুল খোলার জন্যও কাজ করছিলেন।
তো তাকে হত্যার পর সরকারের প্রথম প্রতিক্রিয়া কি ছিল জানেন?
“সে ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে’
তার মাত্র কিছুদিন আগের কথা, ডিসেম্বরের ১১ তারিখ, ব্লগার হত্যার বছর ২০১৫।
চুয়াডাঙ্গায় বাউল উৎসব চলাকালে উৎসবস্থলের কাছেই অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজককে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে জঙ্গিবাহিনী। এতেও কোনো সৎ প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেনি আওয়ামী সরকার।
এগুলো তো খণ্ড খণ্ড ঘটনা বলছি, শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ সরকারের গত আমলেই ১৫ থেকে ২০ টি বাউল হত্যাকাণ্ডের খবর দেখানো যাবে, দেখানো যাবে অজস্র বাউল’কে উচ্ছেদের ঘটনা, মাথা নেড়া করে দিয়ে লাঞ্চিত করার ঘটনা। যার প্রত্যেকটি’ই ঘটেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নীরব মদদে, নিস্ক্রিয়তায়।
তো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিস্ক্রিয় কেন ছিল?
চলুন দেখি এ বিষয়ে আমাদের নয়নমণি মুজিবকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি বলেন!
১৪ এপ্রিল ২০১৬- ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন- “মুক্তচিন্তার নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া বিকৃত রুচি ও নোংরা রুচির পরিচয়৷” পাশাপাশি তিনি এ ধরনের লেখালেখির কারণে হামলার শিকার হলে তার দায় সরকার নেবে না”
বলুন! আর কি প্রয়োজন আছে মুক্তচিন্তকদের হত্যায় নীরব মদদ-দাতা হতে?
আওয়ামিলীগ উপরের একটা খুন’ও নিজ হাতে করেনি, করিয়েছে? তাও রেফারেন্সের অভাবে বলতে পারছি না।
কিন্তু এইসব হত্যাকাণ্ডে নীরব ভূমিকা ও কখনো সহায়ক ভূমিকার বিষয়ে ইতিহাস কি বলে তাও একবার দেখা দরকার।
“১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ ম্যানিলার এক আদালতে জেনারেল তময়উকি ইয়ামাশিতার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো ম্যানিলা গনহত্যা সংগঠনে ভূমিকা, সিংগাপুর এবং ফিলিপাইনে নিরীহ মানুষদের হত্যার অভিযোগ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে জেনারেল ইয়ামাশিতার বিরুদ্ধে আনিত সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিলো যে জাপানি সেনাবাহিনীর একজন কম্যান্ডার হিসেবে সে তার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেনি। জাপানি সৈন্যরা যখন গনহত্যা চালাচ্ছিলো তখন জেনারেল ইয়ামাশিতা নৈতিকতার জায়গা থেকে তাদের এরকম কর্মকাণ্ড করতে বাধা দেননি কিংবা দিতে পারেননি। জেনারেল ইয়ামাশিতার আইনজীবীরা জাপানি বাহিনীর হাতে গনহত্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে যুক্তি দেখায় যে যুদ্ধের ভেতর যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো এবং জাপানি সেনাদের ভেতর চেইন অফ কম্যান্ড পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আর তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও জেনারেল ইয়ামাশিতা তার সৈন্যদের হত্যা, ধর্ষণ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।
সেই বিচারে কেবল মাত্র সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ব্যর্থতার কারণে জেনারেল ইয়ামাশিতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত, সেই রায় সুপ্রিম কোর্ট এবং আপিল কোর্টের পর রাষ্ট্রপতির ক্ষমা বঞ্চিত হয়ে ১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয়।”
ফিলিপাইনের আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দণ্ডিত করে শুধুমাত্র সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি অথবা গুরু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য।
আর আমাদের দেশের প্রত্যেকটা জনগণ যেখানে জীবনের নিরাপত্তার জন্য ট্যাক্স দিচ্ছে সরকারকে, নিজেদের পয়সায় পালছে পুলিশ বাহিনী, যেই ট্যাক্স প্রদানকারীদের ভেতর আছেন বাউলগণ ও মুক্তচিন্তক, সেখানে সরকার বাধ্য তাঁদের প্রত্যেকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এবং সেই জনগণের পয়সায় বেঁচে থাকা আওয়ামিলীগ সরকারের গুরুদায়িত্বে থাকা মানুষটি যখন বরং “হত্যার দায় নেয়া হবে না” বলে তখন বুঝতেই পারছেন এইসকল হত্যায় তাঁর এবং দলের দায় কতটুকু।
আর শরিয়ত বয়াতির তো ভাগ্য ভালো যে উনি কেবল জেলেই গেছেন, এখনো মরে যান নাই।
তো এই বাউল- মুক্তচিন্তকদের সাথে আওয়ামীলীগের কিসের এতো দুষমনি? যে গ্রেফতারে, হত্যায়, উচ্ছেদে মদদ দিয়ে যাচ্ছে নানান ভাবে?
যদি একটু নিজেকে প্রশ্ন করেন, বুঝতে পারবেন আমাদের অঞ্চলের প্রধান বিদ্যালয় কারা? চিন্তক আর দার্শনিক কারা? কারা হাজার বছর ধরে আমাদের পথ দেখিয়ে গেছে সামনের পৃথিবীর? মজার বিষয় হচ্ছে তারা কেউ এথেন্সের লাইসিয়ামে বসে থাকা দার্শনিক নন।
তাঁরা এই অঞ্চলের বাউল-ফকির-সন্ন্যাসী-গাতক ইত্যাদি।
যারা মানুষের মাঝে থেকে চিরকাল অস্ত্রের বিপরীতে মানুষের ভাষায় ভালোবাসতে শিখিয়েছেন মানুষকে। ফরাসি বিল্পবের’ও আগে আমাদের বুকে বুনে দিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বীজ। আর ঘৃণা করতে বলেছে স্বয়ং ‘ঘৃণা’কেই।
তাই শুধু আওয়ামিলীগের নয়, ক্ষমতায় যারা এসেছে আজপর্যন্ত, তাঁদের সকলেরই শত্রুতে পরিনত হয়েছেন বাংলার সাধক-গণ। আর হত্যার শিকার প্রত্যেক ব্লগার’ই ছিলেন আমাদের ভূখণ্ডের সাধকদের উত্তরসূরী। যারা প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছিলেন আমাদের গোটা একটা প্রজন্মকে।
এই জায়গাটাতেই আওয়ামীলীগের সবচেয়ে বড় ভয়। প্রশ্নে।
আওয়ামিলীগ বরাবরই ক্ষমতায় এসেছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলার মানুষের আবেগকে কেন্দ্র করে। যদিও আজকাল সরাসরি অস্ত্রের জোরেই আসছে। কিন্তু কখনোই আওয়ামিলীগ নূন্যতম চেষ্টাও করেনি মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুত বাংলাদেশের নির্মানের। প্রতিবার ক্ষমতায় এসে চালিয়েছে সীমাহীন লুটপাট আর তার সামনে দাঁড়া করিয়ে দিয়েছে কখনো মুক্তিযুদ্ধ আর কখনো মৌলবাদ।
কিন্তু আওয়ামিলীগ জানে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে বেশিদিন টিকতে পারবে না। তাই মাঝেমধ্যেই তারা উস্কে দিতে চেষ্টা করে এদেশের মৌলবাদী শক্তিকে। গোপনে ও প্রকাশ্যে শক্তি জোগায় তাদের।
আপনাদের নিশ্চই মনে আছে, ৫ মে ২০১৩ তে সারাদেশে রাস্তা ফাকা করে পুলিশি প্রটোকল দিয়ে বিনাবাধায় কিভাবে হেফাজতকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের সাথে বিবাদ মেটাতে কারা মাদ্রাসার শিক্ষার ভেতর উগ্রবাদী ধারা কওমী’কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছিল, কওমী পাস’কে দিয়েছিল মাস্টার্স এর সম্মান। জনগণের রেলের শতশত একর জমি দান করে দিয়েছিল হাটহাজারী মাদ্রাসায়। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন উগ্রবাদী সকল ওয়াজ মহফিল আয়োজিত হয় আওয়ামিলীগ এর স্থানীয় সংসদ, স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায়। এভাবেই উত্থান ঘটানো হয় মৌলবাদের।
আর এই মৌলবাদী শক্তির উত্থানে প্রধান বাধা এই অঞ্চের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাউলগণ, মৌলবাদ বিরোধী ব্লগারগণ। যারা নানান ভাবে মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করে সাম্প্রদায়িকতা থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে, অবদান রাখে সাংস্কৃতিক মনন গড়ে তুলতে, তাই এই ধরণের মানুষ অনেক আগে থেকেই গলার কাটা আওয়ামিলীগ এর।
শুধুমাত্র এদের এবং ভিন্নমত দমন করতেই আওয়ামী আশ্রয় নিয়েছে আজপর্যন্ত নানান কিছুর।
২০০৮ এ নির্বাচনের আগে খেলাফত মজলিসের সাথে আওয়ামী লীগ চুক্তি করে ধর্মের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবার।
দেশ থেকে বারবার বন্ধ করে দেয় মুক্তিচিন্তার পক্ষে সরব ইস্টিশন ব্লগ।
সর্বসাধারণের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিতে করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
এবং পরিশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন –
“দেশ চলবে নবীজীর দেখানো পথে”
একসময় আওয়ামিলীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে ক্ষমতায় থাকতে মৌলবাদের ভয় দেখাতো।
এখন মৌলবাদী কায়দায় দেশ চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নষ্ট হবার ভয় দেখায়। ভয় দেখায় আরো ভয়াবহ মৌলবাদের। আর যারা এই মৌলবাদ’কে প্রশ্নবিদ্ধ করে জনমানসের মাঝে, জেলে পুরে নানান কায়দায় চেষ্টা করা হয় তাদের অপরাধী প্রমাণ করার।
শরিয়ত বয়াতির গ্রেফতার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা আওয়ামিলীগ সরকারের মহাপরিকল্পনার একটা অংশ মাত্র। তাই এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে অবাক হইনি খুব একটা।
আপনি যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলবেন, তখন আপনাকে দেখানো হবে মৌলবাদীদের ভয়।
আর যখন আপনি মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন,
তখন আপনাকে দেখানো হবে জেলে ভরার ভয়।
প্রশ্ন করুন, সম্মিলিত আওয়াজ তুলুন এই ভয়ের রাজত্বের বিরুদ্ধে।
“I know you are tired but come, this is the way”
মুক্ত হোক শরিয়ত বয়াতি।
মুক্ত হোক বাউলের হাত।
সৈকত আমিন একজন কবি ও লেখক