গায়ে ইস্ত্রি করা কোট-স্যুট, কারো আবার দামী শাড়ী! চলেন বিলাসী গাড়িতে, সাথে সব সময় নেতা কর্মীদের ভিড় তো আছেই। সহজে অনুমেয় বলছিলাম সরকারী দলের এমপি, মন্ত্রী, নেতা-নেত্রীদের কথা।
বছর দুই ধরে জাতী দেখছে কিভাবে তাঁরা কিভাবে তারা এয়ার কন্ডিশন গাড়ী থেকে সোজা ধানক্ষেতে নেমে পড়েন। কাঁচা হোক পাকা হোক তাতে কোন সমস্যা নাই দু আঁটি ধান কেটে তার একটি ভিডিও, কিছু ছবি তুলে সাংবাদিক আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশকরে কি পৈশাচিক সূখ তারা পান তার রহস্য বুঝি না।
তার পরেও সমস্যা ছিল না যদি এতে কৃষকের উপকার হত। তবে বাস্তবতা হল ধানকাটার নামে কখনো কাঁচা ধান কেটে ফেলা হচ্ছে, কখনো ফটো সেশন করতে গিয়ে মাড়িয়ে ধান নষ্ট হচ্ছে, কখনো তাদের এই ফটো সেশানের জন্য কৃষকের ঘন্টার পর ঘন্টা মূল্যবান সময় নষ্ট করা হচ্ছে। এটা কি আসলেই কৃষকের পাশে দাঁড়ানো?
সত্য বলতে একজন এমপি মন্ত্রীর কাজ মাঠে নেমে ধান কাটা বা কোট পড়ে ধান কাটার ছবি তুলে পোষ্ট করা নয়।
গত কয়েক বছর ধরে ধানকাটার মৌসুমে ধানচাষীদের ফসল তোলার খরচ যোগানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। একদিকে ফসলের দাম নেই অন্যদিকে উচ্চ মজুরী। ধানচাষীরা যেন ধানচাষ করে অপরাধ করে ফেলেছেন এই দেশে। পাকা ধানের ক্ষেতে ক্ষেভে দূঃখে আগুন দিয়েছেন এমনও দেখা গেছে। আর তাদের এই দূঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর নামে চলছে ধানকাটার সেলফি তোলার সার্কাস।
এবছর এমনিতেই করোনা মহামারি ইতমধ্যে সারাদেশে প্রকট আকার ধারন করেছে। শুধু ধান নয়। শাক-সবজি্, ফল-মূল সহ নানা মৌসুমী তরিতরকারি মাঠে পঁচে নষ্ট হচ্ছে। শ্রমিক, পরিবহন ও পাইকার ক্রেতার সংকটে মাঠ হতে ফসল তোলাই বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক চাষী। কেউ বা আবার ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ক্ষোভে দূঃখে সেই ফসল রাস্তায় ঢেলে নষ্ট করছেন অন্যদিকে বড় বড় শহরগুলোতে চাল-ডাল সহ খাদ্য পণ্যের সংকট, যেটুকু তরিতরকারি পাওয়া যাচ্ছে তাও উচ্চ মূল্য!
সত্য বলতে এর সবকিছু হল রাষ্ট্রিয় অব্যবস্থাপনা এবং অযোগ্য ব্যাক্তিদের শাসকের আসনে বসে থেকে দেশ পরিচালনার ফল।
উৎপাদক স্তরে চাষীদের ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া আর মধ্যস্বত্বভোগী মুনাফাখোরদের হাত ধরে ভোক্তা স্তরে পৌছাতে উচ্চ দ্রব্যমূল্যের যে বিশাল সিন্ডিকেট দিনের পর দিন গড়ে উঠেছে সেটা এদেশে ওপেন সিক্রেট। আর এটা নিয়ন্ত্রনে নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপও। কারন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখাযায় মধ্যস্বত্বভোগী পাইকারের ভুমিকায় রয়েছে স্বয়ং রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। শুধু যে ধান-চাল, তরি-তরকারি, শাক-সবজি্তে এই অবস্থা তা নয়। ডিম-দুধ, মাংস উৎপাদনেও খামারীদের একই চিত্র। আর এসব কিছুর উন্নয়নে কার্যকর ভুমিকা আজ পর্যন্ত নিতে পারেনি সরকারে থাকা কোন রাজনৈতীক দলই।
অথচ একটু মনযোগী হয়ে চাষী হতে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য প্রাপ্তির বিষয়গুলো একটু সুব্যবস্থা করা গেলে একদিকে উৎপাদক স্তরে চাষী যেমন ফসলের ন্যায্যমূল্য পেত, সেই সাথে ভোক্তা পর্যায়ে কমে আসত দ্রব্যমূল্যের দাম। সাধারন মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচত।
গত কয়েক সপ্তাহের চিত্র দেখুন। সারাদেশে করোনা পরিস্থতিতে একদিকে যেমন ত্রানের দাবিতে হাহাকার চলছে তার বিপরীতে ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে ফষল আর চুরি হচ্ছে বস্তায় বস্তায় সরকরি বরাদ্দকৃত চাল। বলা হয় আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমি নিজেও তাই মনে করি। তবে তারপরেও কেন মানুষ না খেয়ে আছে? কেন ত্রানের জন্য ট্রাক লুট হচ্ছে? উত্তর একটাই কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্তেও আমাদের কৃষিতে নেই যুগ উপযোগী উন্নয়ন। মোটামুটি প্রায় সকল ধান উৎপাদনকারী দেশ যখন ধান সংগ্রহে উন্নত প্রযুক্তির হার্ভেস্টার (ধান কাটা ও চাল সংগ্রহের আধুুুুনিক যন্ত্র) ব্যবহার করছে সেখানে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের সাংসদরা ক্ষেতে নেমে কাঁচাপাকা ধান কাটছেন! ছবি তুলছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু করছেন না। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাংসদদের কাজ হল তার নির্বাচনী আসনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সময় উপযোগি প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সংকটের সমাধান করা, জনসেবার অভিনয় করা নয়। অথচ এমন কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকান্ডে রয়েছে করোনা সংক্রমনের ঝুঁকিও! আর করোনা পরিস্থতিতে খাদ্য পরিবহন সংরক্ষনে তো কোন প্রকার বাঁধা সৃষ্টি করা হচ্ছে না তবু কেন দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি হবে? ৮% প্রবৃদ্ধির দেশে কেন মানুষকে না খেতে পেয়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে হবে ত্রানের দাবিতে? এই সব প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যায় না। উল্টো এসব নিয়ে প্রশ্নো তোলাই যেন অপরাধ!
উন্নয়নের নামে এদেশের অর্থনীতিতে যা করা হয় তাকে ড. আকবর আলী খান একদা বলেছিলেন “শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি”। আর ধানকেটে কৃষক-চাষীদের পাশে দাঁড়ানোর নামে যে সার্কাস শুরু হয়েছে বছর দুই ধরে তাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি “শুয়োরোর বাচ্চাদের ধানকাটা”।
একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে চাইলে বিষয়গুলা সহজে সমাধান করা যায় না তা নয়। আবার সব জনপ্রতিনিধিও এক নয়। যেমন ধরুন নড়াইল-২ আসনের মাশরাফি বিন মর্তুজা। তার রাজনীতে আগমন ও দল বাছাই নিয়ে আলোচনা সমালোচনা পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে। তবে তিনি আর বাকী সাংসদদের মত ধানকাটার সার্কাসে নেই। তিনি তার এলাকার জন্য নিয়ে এসেছেন ধানকাটার মেশিন, যা দিয়ে সহজেই অল্প সময়ে অধিক পরিমান জমির ধানকাটা সম্ভব সহজেই। অন্যদিকে করোনা সংকট মোকাবেলায় নিজের এলাকায় নিয়েছেন চিকিৎসা সেবায় প্রশংসনীয় বেশ কিছু ব্যবস্থা। সরকারি ত্রানের পাশাপাশি নিজে ব্যাক্তিগত ভাবেও দায়িত্ব নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন নিজ এলাকার মানুষের। অন্তত তাকে দেখেও বাকীরা কিছু শিখতে পারে। অন্তত এই সময়ের জন্য হলেও শেখা উচিত।
ধানকাটার নামে সার্কাস বন্ধ হোক,
ত্রান বিতরেনের নামে চাল চুরি বন্ধ হোক।
দেশের মানুষকে বাঁচতে দিন,
মানুষই যদি না বাঁচে তবে কাদের নিয়ে করবেন রাজনীতি?
আবু রাইহান, মুক্তিফোরামের একজন সম্পাদক।