বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ লেখায় যতোবার ছাত্র শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, ততোবারই ছাত্র ও ছাত্রী উভয়কেই বোঝানো হয়েছে, যদি না কোথাও ভিন্ন কোনো অর্থে শব্দটি প্রয়োগের কথা উল্লেখ করা না থাকে।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় উচ্চবিচারালয় পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছেন। রায়ে ছাত্রনেতাদের ছাত্রাবাসের প্রশাসন চালানো বা জোর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে যুক্ত করার প্রবণতার সমালোচনা করা হয়েছে। কিছু রাজনীতিবিদ নিজেদের স্বার্থে এসবে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন রায়ে এই বক্তব্যও প্রদান করা হয়েছে। অর্থ আর ক্ষমতা আছে এমন ব্যক্তিরা যে দায়মুক্তি পান, এবং পুলিশ-চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞরা অপরাধীদের সাহায্য করেন এই কথাও এসেছে (দৈনিক প্রথম আলো, ২ নভেম্বর ২০১৭)। দৈনিক প্রথম আলোর এই প্রতিবেদনে আরো দ্যাখা যায়, ইউজিসির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতারা পর্যন্ত এই সংকট থেকে পরিত্রানের একটাই উপায় দেখছেন, সেটা হচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এটা ঠিক নব্বইয়ের দশকে দ্বিদলীয় ‘গণতন্ত্র’ এলো আর অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেশ থেকে উঠে গেলো। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিটি অত্যন্ত যৌক্তিক হলেও, এবং প্রাথমিক স্তরের দাবি হলেও, শুধুমাত্র তাতেই আটকে থাকার প্রবণতার মাঝে কিছু সমস্যা দেখতে পাই।
‘৫২র ভাষা আন্দোলন থেকে ‘৭১এর মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ‘৯০এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন পর্যন্ত আমাদের যা কিছু গৌরবোজ্জ্বল ইতিবাচক অর্জন তাতে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। আবার ছাত্ররাজনীতির নামে জাতীয় রাজনীতিক দলগুলোর ফুটসোলজার তৈরি করার যে-সহিংস রাজনীতি তাও অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই! এমতাবস্থায় করণীয় কী?
ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক একটি পরিবেশ তৈরি হবে, ছাত্রদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকবেন, যারা বিভিন্ন শিক্ষাবিষয়ক দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করতে পারবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের দখলদারিত্ব অনেকটাই কমে আসবে। তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিটি সম্পূর্ণ সঠিক।
কিন্তু ছাত্ররাজনীতির নামে যে-সহিংসতার চর্চা আমরা দেখি তার শেকড় এতোটাই গভীর যে নিছক ছাত্র সংসদ নির্বাচন তা দূর করতে পারবে না।
এ-সহিংসতার শেকড় লুকিয়ে আছে ছাত্ররাজনীতির প্রচলিত ধরণে। মুখে যাই বলুক, বাস্তবে এই দেশে এমন একটিও ছাত্রসংগঠন নেই, যা প্রকৃতই স্বাধীনভাবে ছাত্রদের স্বার্থে কাজ করে। প্রতিটি ছাত্রসংগঠন কোনো-না-কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন। কাগজেকলমে যাই থাকুক না কেনো, বাস্তব এটাই। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো প্যারেন্ট পার্টি হিসেবে কাজ করে আর ছাত্রসংগঠনগুলো কাজ করে তাদের আজ্ঞাবহ চাইল্ড অর্গানাইজেশন হিসেবে। সম্পর্কটা সম্পূর্ণরূপে পিতৃতান্ত্রিক। ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে।
যে-সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বলয়ের বাইরে আছে, যেমন প্রগতিশীল দলগুলো, তারা হয়তো ক্ষমতাহীনতার কারণেই সহিংসতা নিরুৎসাহিত করেন। তাই তাঁদের অধীনস্ত ছাত্রসংগঠনগুলোও সহিংসতার চর্চায় অনাগ্রহী। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে প্রগতিশীলরাও কী চেহারা ধারণ করতে পারে, তা পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট এবং তাঁদের অধীনস্ত এসএফআই’এর সহিংস রাজনীতি থেকে খুব ভালো দ্যাখা গেছে, বিশেষত বামফ্রন্ট জামানার শেষদিকে। এটা বিশেষ ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠীর সমস্যা নয়। এটা ক্ষমতার সমস্যা। ক্ষমতার মধ্যেই মানুষকে বিমানবিকীকৃত করার প্রবণতা আছে। যেখানে ক্ষমতার ক্ষেত্রে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আছে, সেখানে এটাকে কিছুটা সীমাবদ্ধ করা সম্ভব, যেখানে নেই সেখানে ক্ষমতা বোধশক্তিহীন দানব তৈরি করে।
তাহলে কি ছাত্ররা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে না?
বাংলাদেশে অনেকেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলেন। এটা ভুল চিন্তা। ছাত্ররাও আর দশজনের মানুষের মতো রাষ্ট্রের নাগরিক, তাই রাজনীতি করার অধিকার তাঁদের আছে।
সমস্যাটা ছাত্ররাজনীতিতে না, ছাত্ররাজনীতির প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক ধরণে।
পরিবর্তন জগতের নিয়ম। যা চলে এসেছে তাই অনন্তকাল ধরে চলবে, এমন কোনো কথা কোথাও লেখা নেই। মানুষই নিয়ম বানায় এবং মানুষই তা ভাঙে।
আজকে আমরা ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল ব্যবহার করি। ’৫২, ’৭১, ‘৯০এ এসবের অস্তিত্বই ছিল না। তখনকার মানুষরা তাঁদের সময়ের প্রয়োজনকে ভাষা দিয়েছেন। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার কোনো ঘাটতি আমাদের নেই। সেটা অটুট রেখেই আমাদেরকে অগ্রসর হতে হবে। ছাত্ররাজনীতির পুরাতন নিয়মের সময় তাই ফুরিয়ে আসছে। বিরাজনীতিকরণ সমাধান নয়, প্রয়োজন নতুন নিয়মের প্রতিষ্ঠা।
মত ও পথের পার্থক্য ছিল, আছে, থাকবে। ছাত্রদের কেউ জাতীয়তাবাদী, কেউ কমিউনিস্ট, কেউ ইসলামিস্ট। আবার একই মতের মধ্যেও বহু পথ আছে। এক পথের সাথে আরেক পথের দ্বন্দ্ব আছে। আবার নানান ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধতাও আছে। এভাবেই বিকাশ ঘটে। স্বাভাবিকভাবে।
ছাত্ররাজনীতির নতুন নিয়মের একটি অতি সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবঃ
১. কৃষক বা শিল্পকারখানার শ্রমিকরা শোষণনিপীড়ণের শিকার হওয়ায় তাঁদের রাজনৈতিক সংগঠন থাকার প্রয়োজন আছে। আবার শিল্পকারখানার শ্রমিক নন, কিন্তু শ্রমজীবী (যেমন রিকশাওয়ালা বা হকার), এমন পেশাজীবিদেরও রাজনৈতিক সংগঠন থাকার প্রয়োজন আছে। পিতৃতন্ত্রে নারীরা জৈবিক উৎপাদনে নিয়োজিত বলে এবং লৈঙ্গিক শোষণনিপীড়ণের শিকার বলে তাঁদেরও রাজনৈতিক সংগঠন থাকার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশে পাহাড়িরা যেহেতু বিশেষ জাতিগত নিপীড়ণের শিকার, তাঁদেরও রাজনৈতিক সংগঠন থাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু ছাত্রদের আলাদা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজন নেই, কারণ কৃষক-শ্রমিক-নারী-পাহাড়িরা যেই অর্থে শোষিতনিপীড়িত, ছাত্ররা সেই অর্থে শোষিতনিপীড়িত না। ছাত্ররা যখন শোষণনিপীড়ণের শিকার হন, তখন সেটা শ্রমজীবী বা নারী বা পাহাড়ি বলেই হন, আলাদা করে ছাত্র হওয়ার কারণে কেউ শোষিতনিপীড়িত হন না। তাই রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কোনো প্রয়োজন নাই।
২. সব ছাত্র সক্রিয় রাজনীতি করায় আগ্রহী নন। কেউ কেউ আগ্রহী। যারা আগ্রহী তারা কী-করে রাজনীতিতে যুক্ত হবেন? আমার মতে, সরাসরি। তবে তার জন্য কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আবশ্যক। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। ১৬ বছর বয়স পেরিয়েছেন এমন যে-কেউ চাইলে যাতে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন সে-ব্যবস্থা করতে হবে। যে-ছাত্র ন্যাশনালিস্ট তিনি সরাসরি ন্যাশনালিস্ট পার্টি করবেন। যে-ছাত্র কমিউনিস্ট তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টি করবেন। যে-ছাত্র ইসলামিস্ট তিনি সরাসরি ইসলামিস্ট পার্টি করবেন। আলাদা করে কোনো ছাত্র সংগঠন থাকবে না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বা সেবামূলক সংগঠন থাকতে পারে; যেমনটা এখন আছে; যারা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সেবামূলক কাজ করেন। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন থাকবে না।
৩. এই সামান্য পরিবর্তনেই একটা অসামান্য লাভ হবে। একদিকে ছাত্ররা তাঁদের পছন্দসই রাজনীতি করার সুযোগ পাবেন, অর্থাৎ, ছাত্ররাজনীতির অধিকার নিশ্চিত থাকবে। অন্যদিকে প্যারেন্ট রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ চাইল্ড ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্বই না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক দখলদারিত্ব ও সহিংসতার অবসান ঘটবে। তাহলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কারা প্রার্থী হবেন? কেনো, ছাত্ররাই হবেন! যারা প্রার্থী হবেন, তাঁরা জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত থাকতে পারেন, আবার নাও থাকতে পারেন। জাতীয় রাজনীতির কোনো প্রভাব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়বে না। সেখানে যিনি যোগ্যতম প্রার্থী, তিনিই নির্বাচিত হবেন। ছাত্র সংসদ শুধুই ছাত্রঅধিকার নিয়ে মাথা ঘামাবে। এবং কাজ করবে। জাতীয় রাজনীতির সাথে কোনোভাবেই যুক্ত হবে না। আর আগেই বলেছি, যেসব ছাত্র রাজনীতিতে আগ্রহী, তাঁরা সরাসরি পছন্দমাফিক রাজনৈতিক দল করবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু ছাত্রঅধিকার নিয়ে কাজ করা ছাত্র সংসদ থাকবে, আর রাজনীতিতে আগ্রহী ছাত্ররা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরের জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নেবেন।
শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও কিন্তু এই পরিবর্তন কল্যাণকর হবে। ছাত্রদের মতো শিক্ষকদেরও রাজনীতি করার অধিকার আছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক দলের শিক্ষক শাখা খোলা যে মারাত্মক ক্ষতিকর তা অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে, শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও উল্লিখিত নতুন নিয়ম প্রযোজ্য। শিক্ষকরা যাতে সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন সে-জন্য জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু আলাদা করে শিক্ষক সংগঠন থাকবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা রাজনীতি করতে পারবেন না। আমার এই প্রস্তাবটি একটু অপ্রথাগত হওয়ায় অদ্ভূত লাগতে পারে পাঠকদের, কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ গণতান্ত্রিক-সুস্থ-মানবিক করে তোলার আর কোনো উপায় আমি দেখি না।
লেখকঃ ইরফানুর রহমান রাফিন মুক্তিফোরামের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য