অসুর নামে একটা আদিবাসী ট্রাইব আছে। এরা মূলত ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিমবঙ্গে বাস করে। এরা সংখ্যায় কম, ২০,০০০-৩০,০০০এর বেশি হবে না।
অসুরদের একটা ছোট অংশ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। কিন্তু এদের বড়ো অংশই প্রকৃতিবাদে বিশ্বাস করে, পূর্বপুরুষের পূজা করা যেই বিশ্বাসের অংশ। এই বিশ্বাস হিন্দুদের সাকার একেশ্বরবাদ আর মুসলমানদের নিরাকার একেশ্বরবাদের চেয়ে অনেক পুরনো, যার শেকড় কৃষি বিপ্লব পূর্ববর্তী শিকারী-সংগ্রাহক জীবনে লুকিয়ে আছে।
কৌতূহল উদ্দীপক বিষয় হলো, অসুররা সময়ের সাথে কৃষিজীবী হয়ে উঠলেও, কৃষি বিপ্লবের ফলে দেখা দেয়া একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো তারা গ্রহণ করে নি। আধুনিককালে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়াদেরকে বাদ দিয়ে বলছি। অসুররা হিন্দু বা মুসলমান হতে চায় নি, এখনো চায় না, তারা তাদের অতিপ্রাচীন বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে।
তেমন একটি বিশ্বাস হলো, তারা মহিষাসুরের বংশধর। হিন্দু পুরাণে মহিষাসুরকে দেখা হয় রাক্ষস হিসেবে, অশুভের প্রতীক হিসেবে, শুভের প্রতীক দেবী দুর্গা যাকে বধ করেন। অসুররা পুরো ঘটনাটাকে পুরোপুরি উল্টো করে দেখে, তারা দেবী দুর্গাকে দেখে বহিরাগত আগ্রাসনকারী হিসেবে, যার হাতে তাদের পূর্বপুরুষ মহিষাসুর খুন হয়েছেন। ভারতে হিন্দুদের তুলনায় অসুরদের সংখ্যা অনেক কম, রাজনীতি থেকে গণমাধ্যম সবই সেখানে হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে, শুদ্র-দলিতবহুজন-আদিবাসীদের ভাগ সামান্যই। বোধগম্য কারণেই হিন্দু পুরাণের বিশ্বাসটাই ঐতিহাসিকভাবে প্রাধান্যশীল, রাজনীতিও এই বিশ্বাসের অনুরাগী, গণমাধ্যমেও মূলত প্রচারিত হয় এই বিশ্বাসই। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মূলত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) শূদ্র-দলিতবহুজন-আদিবাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল কিছু শিক্ষার্থীর উদ্যোগে প্রতি বছর আশ্বিন পূর্নিমার দিনটি মহিষাসুর শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ‘এন্টি-ন্যাশনালদের’ আখড়া হিসেবে দেখে, বলাই বাহুল্য, এ-উদযাপন তীব্র বিতর্কও সৃষ্টি করেছে।
সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষা ব্যবহার করলে, হিন্দুদের বিশ্বাসটা যদি ন্যারেটিভ হয়, তাহলে অসুরদের বিশ্বাসটা কাউন্টারন্যারেটিভ। দুইটা দৃষ্টিভঙ্গিই পৌরানিক, ফ্যাকচুয়ালি প্রমাণ করা অসম্ভব। কিন্তু পুরাণ সবসময় হাওয়া থেকে আসে না, অনেক পুরাণেই পেছনেই বাস্তব ঘটনার সমর্থন থাকে।
আর্যভাষীরা ভারতবর্ষে বহিরাগত, তুর্কি বা ব্রিটিশদের মতোই। যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, দুর্গার হাতে মহিষাসুর বধ বহিরাগত আর্যভাষীদের হাতে স্থানীয় কোনো রাজার পরাজিত হওয়ার প্রতীক মাত্র। এই সম্ভাবনার সমর্থন ঐতিহাসিক কিছু সূত্রে মেলে, তবে সেটা ভারতের ভিন্ন রাজ্য থেকে।
ঈশা দাশগুপ্ত লিখেছেন,
“‘অসুর’ শব্দটি দাক্ষিণাত্যের পৌরাণিক সাহিত্যে কোনও নঞর্থক অর্থে ব্যবহৃত হয় না। মহিষমণ্ডলা বা মহিষমতী রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায় সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে। তাতে জানা যায় যে শূদ্র অর্থাৎ আধুনিক ভাষায় দলিত ছিলেন মহিষাসুর। পরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্রাট অশোকের কথায় নিয়োজিত হন বৌদ্ধধর্মের প্রচারে। মহিষাসুরের শাসনাধীন মহিষমণ্ডলায় বহু উন্নয়ন প্রকল্পের ঐতিহাসিক নথি খুঁজে পান গবেষকরা। ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় সেই সময়ের আর এক ব্রাহ্মণ রানি চামুণ্ডারও। মহিষাসুরের উত্থানে শঙ্কিত হয়ে অন্য হিন্দু রাজারা রানি চামুণ্ডাকে অনুরোধ করেন মহিষাসুরকে হত্যা করতে। মহিষমণ্ডলা আক্রমণ করেন চামুণ্ডা, হত্যা করেন বৌদ্ধ শান্তিপ্রিয় রাজা মহিষাসুরকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয় বহু পৌরাণিক কাহিনি, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহাসিক তথ্যের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয় ওঠে। […] মহিষাসুরের এই ভিলেনায়ন অসংখ্য পৌরাণিক আর্য আগ্রাসনের চিহ্নের মধ্যে অন্যতম। অন্য দিকে, দেবী চামুণ্ডেশ্বরীর মিথায়নও আর্য ব্রাহ্মণ রানি চামুণ্ডার ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্র ধরে। রানি চামুণ্ডার গল্পই হয়ে ওঠে দেবী চামুণ্ডেশ্বরীর, তাঁর জন্য কর্নাটকে তৈরি হয় বহু মন্দিরও। […] কর্নাটকের চিন্তাশীল মানুষ এই আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা জোগান। তাঁদের উদ্যোগে শুরু হয় মহিষাসুর দশেরা, চামুণ্ডা পাহাড়েই। জনজাতির ঐতিহ্য, স্থানীয় ইতিহাসকে আর্য তথা হিন্দি বলয়ের আগ্রাসন থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম কে ভগবান। গৌরী লঙ্কেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মী। গৌরীর মৃত্যুর পর সরকার তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সঙ্কটে গৌরী লঙ্কেশ, কে ভগবানদের মহিষাসুর দশেরার প্রয়াস। মাইসুরুর বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহা ফরমান দিয়েছেন, এই উৎসব হিন্দুত্বের বিরোধী। আসলে বলতে চেয়েছেন হিন্দি বলয়ের বিরোধী, আর্য আগ্রাসনের বিরোধী। হিন্দুত্বের ধুয়ো তুলে আসলে এই বিরোধিতা বৈচিত্রের, অসাম্প্রদায়িক ইতিহাসের। মহিষাসুর দশেরাকে ঠিক পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেননি ওঁরা, বি আর অম্বেডকর পার্ক নামক ছোট একটি জায়গায় ঠেলে দিয়েছেন। জনজাতি/দলিত ধরনের ব্যাপার অম্বেডকর পার্কেই বেশি ভাল মানায় বোধ হয়। এ বার তাই আরও এক বার আর্যাবর্তের জয় উদ্যাপিত হবে কর্নাটকে, যা পালিত হচ্ছে রোজ সারা ভারতে। কখনও হিন্দি ভাষা, কখনও সাহিত্য, কখনও চলচ্চিত্রের আড়ালে। গৌরী লঙ্কেশ, কে ভগবানরা তাও লড়ে যাবেন মৃত্যুর আগে-পরে। মহিষাসুর দশেরার জন্য।”
(‘বিপন্ন মহিষাসুর দশেরা’, আনন্দবাজার, ৪ অক্টোবর ২০১৯)
দেবী দুর্গাকে হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাসের বাইরে টেনে আনার একটি মেধাবী প্রয়াস প্রয়াত কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের কন্যা শ্লোক। সেনগুপ্ত তাঁর কবিতায় মেধা পাটেকর আর তিস্তা সেতলাবাদের মতো মানুষ ও প্রাণপ্রকৃতির পক্ষে লড়ে চলা অ্যাকটিভিস্টদেরকে তাঁর দুর্গা বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেনগুপ্তের সৃষ্টিশীলতা প্রশংসার দাবিদার, বিশেষত সেতলাবাদের সাথে গুজরাত গণহত্যা প্রশ্নে হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্টদের বিরোধের বিষয়টা যদি মাথায় রাখি।
কিন্তু, তবু একটা একটা খটকা থেকেই যায়। ক্ষমতার ভাষায় কি ক্ষমতার প্রাসাদ ভাঙা যায়? সেনগুপ্তের দুর্গা আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দুর্গা বাহিনী কোনোভাবেই একই অর্থ বহন করে না, তাদের অবস্থান রাজনৈতিকভাবে খুব স্পষ্টতই বিপরীত মেরুতে, কিন্তু প্রগতিশীল আর প্রতিক্রিয়াশীল উভয়ই তো এখানে আটকে থাকছে হিন্দু পুরাণের পরিসরে।
আজকে কোনো অসুর যদি কন্যা শ্লোক পড়েন, তাঁকে কি স্পর্শ করবে সেনগুপ্তের আবেগ? দুঃখের সাথেই বলি, মনে হয় করবে না। করার কথা না।
দুর্গা-মহিষাসুর দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে এই যে সম্পূর্ণরূপে বিপরীত দুই বয়ান, তার মধ্যকার বিরোধের খুব সরল কোনো নিরসনসূত্র নেই।
হিন্দু আর মুসলমানের বিশ্বাস মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ নয়। তাই নিতান্তই গাড়ল না হলে, হিন্দুরা মুসলমানদেরকে ঈদের শুভেচ্ছা এবং মুসলমানরা হিন্দুদেরকে পূজার শুভেচ্ছা জানাতে পারে, সমমর্যাদার সাথে সহাবস্থান করতে পারে। যদিও ভারত ও বাংলাদেশে গাড়লের সংখ্যা বাড়ছে, এর একটা কারণ, রাষ্ট্র উপমহাদেশের দেশগুলোতে নিজেই কমিউনিটিগুলোর সমমর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থানের বিরুদ্ধে কার্যরত প্রবলতম প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু হিন্দু আর অসুরের বিশ্বাস মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ। হিন্দুর চোখে দুর্গা হিরো আর মহিষাসুর ভিলেন। অসুরের চোখে মহিষাসুর হিরো আর দুর্গা ভিলেন।
তারা কীভাবে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাবে? আর সমমর্যাদার সাথে সহাবস্থানই বা করবে কীভাবে? যেখানে দৃশ্যতই ভারত রাষ্ট্র দুর্গা পূজাকে সার্বজনীনতার নামে উৎসাহিত করতে আর অসুরদের মহিষাসুর বন্দনা সম্ভাব্য সকল উপায়ে দাবিয়ে রাখতে চাচ্ছে?
এখানেই এসে যাচ্ছে সহিষ্ণুতার সীমা বিষয়ক প্রশ্ন। সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে সমাধান বাতলানো হয়, মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ না এমন বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সমমর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভবও বটে, কিন্তু যেখানে বিশ্বাস মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ এবং রাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্টতই পক্ষপাতমূলক সেখানে সমমর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থান কি আদৌ সম্ভব? কঠিন প্রশ্ন, এবং আমার ধারণা, এই প্রশ্নের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর খুঁজে পেতে আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে!
লেখকঃ ইরফানুর রহমান রাফিন, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, মুক্তিফোরাম