প্রথমেই বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই জন্য যে আমার আজকের লেখনী খুবই কঠিন মনে হবে অনেকের কাছে। শব্দচয়ন, ভাষার ব্যাবহার নিয়ে আপত্তি থাকবে। আমি আজ কোনো কিছুই ঢাকবো না। যা সত্য তাই লিখবো।
ফেসবুকের নিউজ ফিড ভরে গেছে আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বুয়েটে অধ্যয়নরত ২১ বছরের একজন তরতাজা দুর্দান্ত মেধাবী যুবক যার পদচারণায় মুখরিত হওয়ার কথা ছিল অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, এমআইটির মতো প্রতিষ্টান; যার সৃষ্টিশীল কাজ, ক্ষুরধার লেখনী আমাদের জন্য হতে পারতো এক বিরাট সম্পদ, তার লাশ আজ কবরে শায়িত হলো। আবরারের বাবা-মা হারালো তাদের কলিজার টুকরা সন্তানকে যাকে এই ২১ টি বছর তিলে তিলে কষ্ট করে মানুষ করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা মেডিক্যাল-বুয়েটে চান্স পাওয়াতে অবর্ণনীয় ত্যাগ শিকার করেছে, এই হতভাগা মাটি হারালো তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহসী সন্তানকে যে জীবনের পরোয়া না করে স্বাধীন-স্বার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কথা তুলে ধরেছে তার লেখায়। ছেলেটার এই অবস্থান সহ্য করতে না পেরে ছাত্রলীগ নামের কতগুলা নিকৃষ্ট পশু, সন্ত্রাসী ৬ ঘন্টা পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে এইটুকুন ছেলেটার। এ ঘটনা সকলের জানা কিন্তু আরো কিছু জানা আছে আমাদের যা সাহস করে বলা হয়না। আসুন সেগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেই আপনাদের।
প্রচন্ড স্বার্থপর, হিপোক্রেট আর ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের এই বাঙালি জাতি কোনো একটা ইস্যু পেলেই কেবল হা-হুতাশ করে। সমস্যার মূলেও যায়না, সমাধানের পথও খোঁজেনা।
১. আবরারের এই হত্যাকান্ড কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম? এই হত্যাকান্ড যারা ঘটায়, অতীতে ঘটিয়েছে, নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে বহু ছাত্রকে হত্যা করেছে, পঙ্গু করেছে, মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছে, বহু স্বপ্নের কবর রচনা করেছে তাদের বিচার হয় এখানে? নিকট অতীতে যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র সাদকে শিবির সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেললো কিছু কুলাঙ্গার তাদের কারো বিচার হয়েছে? আমি যদি বলি, আজকে আবরার হত্যাকান্ড ঘটেছে কেবল মাত্র আগের হত্যাকান্ড এবং নির্যাতনের বিচার না হওয়ার জন্য তবে কি এটা বলা অত্যুক্তি হবে?
২. আমি বুঝিনা এই বালের ছাত্র রাজনীতি এই দেশে করেটা কি? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ত্রাস সৃষ্টি, ভিন্ন মতাবলম্বীদের মারধর, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ বাণিজ্য, সরকারি দলের গুন্ডা বাহিনী হিসেবে কাজ করে নিশি রাতের ভোট পরিচালনা করা, গায়ের জোরে যা ইচ্ছা তাই করা, প্রশ্ন ফাঁস, শিক্ষকদের অপমান করা, মারধর করা ইত্যাদি এমন কোনো অপকর্ম একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় বা হতে পারে যা এরা করেনা? যেই বিশ্ববিদ্যালয় হবে জ্ঞানের চর্চার জায়গা সর্ব ধর্ম-বিশ্বাস আর মতবাদের উন্মুক্ত চিন্তার জায়গা; যেখান থেকে বের হওয়ার কথা বিশ্ব বিখ্যাত সাইন্টিস্ট-প্রশাসক-শিক্ষক-উদ্যোক্তা-মানবিক নেতা-সমাজকর্মী-সাংবাদিক-শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি লালন এবং চর্চাকারী ব্যাক্তি-প্রফেশনাল ঠিক সেখান থেকেই মেধাবী নামের কতগুলো মনুষ্যত্বহীন গরু-ছাগল তৈরী হচ্ছে এই দায় কার?
৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো মিনি ক্যান্টনমেন্ট, মাদকের ছড়াছড়ি, বিরোধী মতের ছাত্রদের জায়গা নেই সেখানে। হল প্রভোস্ট দায়িত্ব পালন করেনা, হলের ডাইনিং-ক্যান্টিন চালায় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। ফ্রি খায়, বাকীতে খায়, টাকা লুটপাট করে। এগুলা কেউ দেখে না?
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ, আপনাদের গুনের কথা কি বলবো! এই দেশের মাটিতে বড় হয়ে, রিকশাওয়ালা-কুলিমজুর-দেহ ব্যাবসায়ী-ফকির-মিসকিনের করের টাকায় পড়াশোনা করে আপনারা শিক্ষক হোন। পাবলিকের টাকায় চাকরি না করেও তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না থেকেও ব্যাংকে টাকা জমা হয়, বিদেশে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করেন আর দেশে ফিরেই গবেষণা জাহান্নামে পাঠিয়ে বালের শিক্ষক রাজনীতি শুরু করেন? সন্তানের সমান ছাত্র নেতাদের পা ধোয়া পানি খাওয়ার জন্য লাফালাফি করেন? এতোই যদি বালের রাজনীতি করার ইচ্ছা তো গ্রামেই রাজনীতি করতেন! জনগণের টাকায় রাজনীতি মারান কেন?
৫. সম্মানিত উপাচার্যবৃন্দ, মানলাম আপনাদের প্রভুরা যোগ্যতার মাপকাঠিতে না বরং দালালি-নোংরা রাজনীতি আর তথাকথিত আনুগত্য এর মাপকাঠিতে আপনাদের নিয়োগ দেন; তো স্যাররা এই নিয়োগের পর একটু মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানো যায়না? লুটপাট, নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্র নেতা ক্যাডারদের ম্যানেজ করে চলা আর কথায় কথায় ভণ্ডামি চেতনার বুলি আওড়ানো ছাড়া কোনো কাজ নেই আপনাদের? একটাবার এই হতভাগা জনপদের কথা ভাবতে ইচ্ছে হয়না? পত্রিকার পাতায় আপনাদের কুকর্ম দেখলে লজ্জায়-ঘৃনায় গা ঘিন ঘিন করে? দায়িত্ব পালন না করতে পারলে পদ ছেড়ে দেন, শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যাবসায় নামেন, প্রয়োজনে বিদেশ পারি দেন। তারপর এগুলা করেন কেন?
৬. আর এইযে সরকার বাহাদুর, বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোনো স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট সরকার নাই যে আপনাদের মতো ভিন্ন মতের ব্যাপারে এতটা অমানবিক! যেভাবেই হোক ক্ষমতায় আছেন, তো ভাই যতদিন আছেন অন্তত কিছু একটাতো করেন যাতে করে ক্ষমতা হারানোর পর আপনাদের আর গণধোলাই খেয়ে মরতে না হয়! আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেন, গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করেন, দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে সচেষ্ট হোন। নইলে সোনার বাংলা অধরায় থেকে যাবে!
মুর্দা কথা,
১. বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য শিক্ষক এবং ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন।
২. দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন, ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধা করেন, জনগণের ভোটার অধিকার ফিরিয়ে দেন, সন্ত্রাস ও লুটপাটের রাজনীতি বন্ধ করেন, ফ্যাসিজম থেকে বের হয়ে আসেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন। আমরা জানি আপনাদের জনগণ নির্বাচিত করেনাই তারপরও দেশ বিক্রির এই পথ থেকে সরে আসেন। জানেন তো, বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের পরিণতি কি হয়েছিল?
৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে সবচেয়ে যোগ্য, জ্ঞানী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ভালো মানুষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে নিয়োগ দেন।
৪. শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধ করেন।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা এবং গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করেন।
এগুলো করতে না পারলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই পতাকার মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হয়েছে, সার্বভৌমত্বতা অন্তত ধূলিসাৎ করে দিবেন না প্লিজ।
লেখক: অনিন্দ্য কাব্য (ছদ্মনাম), শিক্ষক এবং গবেষক, জাপান