আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটে এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এই এক মাসে সরকারের উপদেষ্ঠামন্ডলী অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন – বড় বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন এসেছে, অর্থনীতি স্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই সরকারের কাছে জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশার নিরিখে সরকার স্বচ্ছ দিকনির্দেশনা এবং আশানুরূপ অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে এ দাবী করা কঠিন।
১৫ বছরের নিপীড়ন এবং গনতন্ত্রহীনতার পর দেশের মানুষ যে পরিমাণ আশা নিয়ে এই সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে, তা পূরণ করা সত্যিই কষ্টসাধ্য। কারণ শুধু যে জনগণের অশেষ চাহিদা ও দাবী পূরণ করতে হবে তা নয়, বরং পুরো দেশটাকেই নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। হাসিনার অপশ্বাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, অর্থনীতি বিপর্যস্ত, আইনশৃঙ্খলা অবনতির চরমে। বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন – সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নিয়োগ ও হস্তক্ষেপের ফলে স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্ব নষ্ট হয়ে গেছে।
ড. ইউনূস এ কারণেই ২৫ আগস্টে দেওয়া দেশের উদ্দেশ্যে ভাষণে অনেক ধরনের সংস্কারের কথা বলেছেন – দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক সংস্কার, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যাবস্থার সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থা পুনর্গঠন, ইত্যাদি। কিন্তু তার সরকারের হাতে সময় কম, আর করার কাজ অসংখ্য। তাই এই সরকারের এক মাস পূর্তিতে সময় এসেছে রণকৌশল পূনর্নির্ধারন করার – এখন সবচেয়ে বেশি দরকার অগ্রাধিকার ঠিক করা এবং একটা সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা। নইলে অচিরেই জনগণের সমর্থন ও ধৈর্য্য হারানোর ঝুঁকি আছে, এবং সে সুযোগ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের মতো দলগুলো আশু নির্বাচনের জন্য চাপ দিতে শুরু করবে অবশ্যম্ভাবীভাবেই।
আমরা মনে করি, যে কাজগুলো একটি নির্বাচিত দলীয় সরকার নিরপেক্ষভাবে করতে পারবে না, সেগুলোই এখন অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এই হিসেবে নিচের তিনটি কাজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদায়ের আগে সম্পন্ন করা সবচেয়ে জরুরি:
১. জুলাই গণহত্যার বিচার: জনগণের পক্ষ থেকে এটাই এই সরকারের কাছে প্রধান দাবি। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ এখনো স্পষ্ট নয়। বরং দেখা যাচ্ছে, সুযোগসন্ধানীরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দুর্বল মামলা দিচ্ছে, যা আদালতে না টেকার সম্ভাবনাই বেশি। এই বিশৃঙ্খলতার বদলে একটি কেন্দ্রীয় বিচার কমিশন গঠন করা অতি জরুরী। এই কমিশন শুধু জুলাই-আগস্টের গণহত্যা নয়, বরং গত ১৫ বছরে সংঘটিত সব বড় অপরাধের তদন্ত করবে – পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সাগর-রুনি হত্যা, আয়নাঘর, বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক রিজার্ভ চুরি, হেফাজতে ইসলামের ওপর নির্যাতন – সবকিছুর। এই কমিশনের কাজ হবে সত্যিকারের অপরাধীদের চিহ্নিত করা, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা এবং কেন্দ্রীয়ভাবে মামলা দায়ের করার মাধ্যমে বিচার সুনিশ্চিত করা। এটা করতে হবে দ্রুত, কিন্তু ন্যায়বিচারের নীতি মেনে।
২. সত্যদ্ঘাটন ও সামাজিক পুনর্বাসন: এই পদক্ষেপটি আপাদদৃষ্টিতে জনপ্রিয় না হলেও দূরদৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করলে খুবই প্রয়োজনীয়। গত সরকারের সময় বিভিন্নভাবে সুবিধাভোগী, গনঅভ্যুথ্যানের সময়ে বিভিন্ন কারণে সরকারের সমর্থনে থাকা বা এমনকি নির্যাতনের আতঙ্কে নীরব থাকা অনেকেই বর্তমানে সঙ্গত কারণেই জনরোষের মুখোমুখি হচ্ছেন, এবং তাদেরকে ‘দালাল’ ট্যাগ দিয়ে বয়কট করার একটি প্রবল সামাজিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক বা কোন ভাবে গত সরকারের সুবিধাভোগী ছিল, এবং তারা আমাদের দেশেরই নাগরিক। তাদেরকে সাথে না নিয়ে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং ভবিষ্যতের দিকে দৃঢ়ভাবে পা বাড়ানো আদতে সম্ভব নয়। এখানে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা ও আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারি। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসানের পর “সত্য ও পুনর্বাসন কমিশন” গঠন করা হয়েছিল। সেখানে অপরাধীরা তাদের অপরাধ স্বীকার করলে ক্ষমা পেত, আর ভুক্তভোগীরা তাদের কষ্টের কথা বলার সুযোগ পেত। আর্জেন্টিনায় সামরিক শাসনের অধীনে গুম হওয়া অসংখ্য নাগরিকদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৮৪ সালে “নানকা মাস” বা “আর কখনো নয়” নীতি গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হলেও সেটা প্রতিহিংসার চেয়ে বেশি ন্যায়বিচারকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছিল।
আমাদের দেশেও এরকম একটা প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। যারা সরাসরি অপরাধে জড়িত নন, কিন্তু বিভিন্ন কারণে সরকারের পক্ষ নিয়েছিলেন বা নীরব ছিলেন, তাদের জন্য একটা “ক্ষমা ও পুনর্বাসন” কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে তারা তাদের ভুল স্বীকার করে সমাজে ফিরে আসার সুযোগ পাবে। যারা বিভিন্ন ভাবে অর্থনৈতিক ফায়দা নিয়েছে তারা তাদের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ সরকারী কোষাগারে ফেরত দিয়ে মুচলেকা দিয়ে সমাজে পুনর্বাসিত হতে পারবে। একই সঙ্গে, যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের কথা শোনার একটি প্লাটফর্ম তৈরি হবে। এভাবে আমরা আমাদের গভীরভাবে ফাটল ধরা সমাজকে পুনরায় জোড়া লাগাতে পারি। তবে সরকারকে এই উদ্যোগটি অসীম প্রজ্ঞা নিয়ে কৌশলী ভাবে করতে হবে, যেন এটি তাদেরকে অহেতুক অজনপ্রিয় করে না তোলে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগগুলিকে ঝুঁকির মুখে না ফেলে দেয়।
৩. নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও কাঠামোগত সংস্কার: জনগণের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তি তৈরি করতে হবে, যা দল, মত, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং বাংলাদেশ ২.০ নামক নতুন নাগরিকতন্ত্রের (রিপাবলিক) ভিত্তি রচনা করবে । এই সংবিধানে থাকতে হবে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং বিকেন্দ্রীকরণ, স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ইত্যাদির গ্যারান্টি। এছাড়া সকল নাগরিকের সমান অধিকার, রাষ্ট্রের উদারনৈতিকতা, বাক স্বাধীনতা – এসব বিষয়েও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় সকল শ্রেণী-পেশা-ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এবং এই নতুন সংবিধানের ভিত্তিতে গঠিত নতুন নির্বাচন কমিশন-এর অধীনেই নতুন বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে, নাহলে এই রক্তের মূল্যে কেনা বিপ্লব বৃথা যাবার সম্ভাবনা প্রবল।
এই তিনটি কাজ একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং পরস্পর-নির্ভরশীল । জুলাই গণহত্যার বিচার না হলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ কমবে না, ফলে তাদের সাধারণ সমর্থক-গোষ্ঠী এবং সুবিধাপ্রাপ্তদের সামাজিক পুনর্বাসন সম্ভব হবে না। আবার আওয়ামী-পন্থি এই বিশাল জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ব্যাতিরেকে তৈরি নতুন সংবিধান সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই এই তিনটি কাজ একসাথে এগোনো প্রয়োজন।
অবশ্যই এর পাশাপাশি জরুরি কিছু কাজও করতে হবে – যেমন অর্থনীতি স্থিতিশীল করা, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করা, ইত্যাদি। কিন্তু উপরের তিনটি কাজ যদি সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায়, তাহলেই কেবল এই সরকারকে সম্পুর্ন সফল বলা যাবে, নতুবা নয়।
সময় কম, তাই অনতিবিলম্বে অগ্রাধিকার ঠিক করা জরুরি। এগুলো সফলভাবে করতে পারলেই আগামী ৫০ বছরের জন্য আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ, গণতান্ত্রিক, ন্যায়বিচারভিত্তিক, বৈষম্যহীন, ও সবার জন্য সমান সুযোগের দেশ পেতে পারি। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া, যেখান থেকে আমাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
লেখক: রুবাইয়াত খান, মুক্তিপত্রের একজন সম্পাদক