আমাকে আমার বন্ধুরা প্রায়ই বলে, ভারত তো বাংলাদেশকে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, হয়তো কোনদিন আক্রমণ করে দখলই করে নেবে।
উত্তরে আমি বলি, ভারতের তো বাংলাদেশ দখল করার কোন প্রয়োজন নাই, ভারত তো বাংলাদেশকে এর মাঝেই দখল করে রেখেছে। দখল করে রেখেছে তার নদী, তার সম্পদ, তার সার্বভৌমত্ব, তার বাজার। আলাদা করে মিলিটারী দিয়ে দখল করে বেহুদা এতোগুলা মানুষের ভার নেবার তো কোন প্রয়োজন নাই। তারচেয়ে বরং এখানে একটা পক্ষশক্তিকে ক্ষমতায় রেখে এই দেশটিকে করদ করে রাখাই তার জন্যে সহজতর।
তারা যা চায় সেটা আমরা তারা না চাইতেই দিয়ে দেই। তারা আমাদের কথা কেনো শুনবে ভাই? আমাদের কথা শোনার তাদের কোন দরকার নাই।
ভারত নিয়ে আমাদের দুই প্রধান দলের কূটনৈতিক চালচলনই ভুল। বিএনপির করে ভারতবিমুখীতার, ভারতবিদ্বেষের রাজনীতি–যার ফলে ভারত তাদের সাথে গুড ফেইথেই আলোচনা করেনা আর আমরা আমাদের ন্যয্য হিস্যা পাই না। এদিকে আওয়ামী লীগ করে ভারত তোষনের রাজনীতি। তারা না চাইতেই দিয়ে দেয় সবকিছু। তাহলে তারা আমাদের কিছু কেন দিবে?
এটা বুঝতে কোন বিশেষ বড়ো কূটনীতিবিদ হতে হয় না। যেকোন নেগোসিয়েশনের টেবিলে যখন আপনি বসবেন তখন আপনার দেয়ার কিছু থাকতে হবে যেটা অপর পক্ষ চায়, যেটির লোভ দেখিয়ে আপনি তার কাছে থেকে কিছু নেবেন। এটাকে বলা হয় বার্গেইনিং চিপ। আপনি যদি কিছু আদায় করতে চান, আপনার হাতে কিছু বার্গেইনিং চিপ থাকতে হবে।
অনেকে ভাবেন যে ছোট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের হাতে কোন বার্গেইনিং চিপ নাই। এটা একটা ভুল ভাবনা। আমাদের অনেক কিছুই আছে যার দখল ভারত নিতে চায়। আমাদের বাজারের দখল সে নিতে চায় কেননা আমাদের বিশাল ভোক্তাগোষ্ঠীর কাছে সে তার পণ্য পৌঁছে দিতে চায়। সে আমাদের বাজারে উৎপাদিত পণ্য চায় তার দেশের ভোক্তার চাহিদা মেটানোর জন্য। সে আমাদের পানি চায় তার নিজের দেশের সেচ প্রকল্প পরিচালনা করবার জন্য। সে আমাদের ভূখন্ডে যাতায়াতের সুযোগ চায় তার প্রান্তিক প্রদেশে প্রবেশের সহজ উপায়ের জন্য। সে আমাদের সহযোগিতা চায় বিবিআইএনে অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠার প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করবার জন্য। সে আমাদের আনুগত্য চায় এই অঞ্চলের একচ্ছত্র সুপারপাওয়ার হিসেবে উঠে দাড়ানোর জন্যে।
এই প্রতিটি জিনিসই আমাদের বার্গেইনিং চিপ, যেগুলোকে ব্যবহার করে আমরা আমাদের দাবিগুলো আদায় করে আনতে পারতাম। তবে আমরা তা আনিনাই। আমরা হেসেখেলে তাদের সব চাওয়াকে পূরণ করে এসেছি এই দীর্ঘদিন ধরে। তাদের আমরা ট্রানজিট দিয়েছি, তাদের কাচাবাজারি ও সাংস্কৃতিক পণ্যকে অবাধে আমাদের বাজারে অনুপ্রবেশ করতে দিয়েছি, আমাদের বিশেষায়িত পণ্য তাদের কাছে রপ্তানি করে (কিছুদিন আগে তো ইলিশ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞাও পূজো উপলক্ষ্যে তুলে নেয়া হলো), আমরা তাদেরকে ইচ্ছামতন পানি প্রত্যাহার করতে দিয়েছি। আমরা তাদেরকে ট্রানজিটের সুযোগ দিয়েছি। আমরা তাদের সমস্ত আঞ্চলিক প্রকল্পে পক্ষে মত দিয়েছি।
বিনিময়ে আমরা কি পেয়েছি? আমরা পেয়েছি সিমান্ত হত্যা, আমরা পেয়েছি সিমান্তে আমাদের আইনরক্ষাকারী বাহিনীর ওপরে নির্যাতন, আমরা পেয়েছি বন্যা, আমরা পেয়েছি খরা, আমরা পেয়েছি পানি চুরি, আমরা পেয়েছি সার্ভেইলেন্স। তবু আমার বারংবার তাদেরকে গুডউইল দেখিয়ে তাদের চাহিদাটুকু সোনার পাত্রে সাজিয়ে তাদের সামনে রেখেছি।
কই, তারা তো গুডউইল দেখিয়ে আমাদের জন্য খরার মৌসুমে পানির ভাগ দিলো না। তারা তো গুডউইল দেখিয়ে ফেলানী হত্যার বিচার করলো না। এমন একপাক্ষিক গুডউইলকে কি আমরা আসলেই গুডউইল বলতে পারি, নাকি আমাদের গোলামি বলতে হয়?
আজ ফেনী নদীর থেকে এক দশমিক আট দুই কিউসেক পানি প্রত্যাহারের চুক্তি করা হলো। কিন্তু এর আগে থেকেই তারা তিরিশেরও বেশি পাম্প বসিয়ে আমাদের ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে আসছে। এই পানি প্রত্যাহারের কারণে ফেনী নদীর পানি প্রবাহ হয়ে গিয়েছে অর্ধেক। আজ চুক্তি করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে আরো পানি প্রত্যাহারের লাইসেন্স দিয়ে আসলেন। তবে এই চুক্তির সীমায় তারা থামবে না। তারা আরও বেশি পানি প্রত্যাহার করবে। তাদের লাগামহীন পানি প্রত্যাহারের শিকার আমরা আগে হয়েছি। গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের কথা আমরা জানি। একই ভাবে আমাদের ফেনী নদীকেও চুপসে মারা হবে, এটা জানতে আমাদের আর বাকি নাই।
আজ আমরা এই কথাগুলো বলি আমাদের বলা হয় আমরা শিবির, আমরা স্বাধীনতার বিরোধী। বলা হয় আমাদের পিটায়ে মেরে ফেলা যায়। আপনারা যারা এই কথা বলেন, আপনাদের উদ্দেশ্যে বলে দিতে চাই–যে পথে আমরা হাঁটছি, সেটা সার্বভৌমত্বের পথ, স্বায়ত্বশাসনের পথ। শেখ মুজিব আর মাওলানা ভাসানীর পথে হাঁটছি আমরা। ভাসানীর পথে হাটলে যদি আমাদের নিন্দামন্দ শুনতে হয়, তবে সেই নিন্দামন্দ শুনতে আমাদের দ্বিধা নাই।
শুধু মনে রাখবেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে দেশের পাশে যারা থাকে, মানুষ তাদের মনে রাখে। দেশের জন্যে কারা কথা বলেছিল, কারা কাজ করেছিল–জনতা তা মনে রাখে। আজ আপনারা ভারতপন্থী আর পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি করছেন, করতে থাকেন। মানুষ মনে রাখবে, ইতিহাস মনে রাখবে, আজ আমরা এখানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশপন্থী পরিচয়ে কথা বলেছি। এতোটুকু ছাড়া আমাদের আর কিছু চাওয়ার নাই।
ভারতের গোলামী ছাড়ো। বাংলার জনতার রাজনীতি করো।
মুক্তিফোরামের পক্ষ থেকে ঢাকাস্থ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই বক্তৃতাটি দেন অনুপম দেবাশীষ রায়। এটিকে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত করে প্রকাশ করা হলো।
Subscribe to Updates
Get the latest creative news from FooBar about art, design and business.
Trending
- Whose language is rumour?
- Can you ‘mastermind’ an uprising?
- শিক্ষাক্রমের পুনর্গঠন: বাস্তবতা, সংকট ও সমাধানের পথ
- অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস: সুযোগ, চ্যালেঞ্জ ও আমাদের প্রত্যাশা
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরাজনীতিকরণঃ শিক্ষার্থীরা কেন রাজনীতি করবে না?
- ফ্যাসিবাদের লৌহপর্দা ঢাকা যাপিত জীবন
- লেঃ জেঃ সাইফুল আলম কন্যা জারিফা ও সাবেক এম পি পুত্র সামি এর অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে BUP এর আন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও ক্লাস বর্জনের সিন্ধান্ত গ্রহন!
- The precarious precipice of minority politics in Bangladesh
Muktiforum
মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।
1 Comment
Keep up we are with you