পূর্ববর্তী এক পোস্টে কথা হয়েছিল ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে। এই পোস্টে এই ব্যবস্থাই যে বাংলাদেশী রাজনৈতিক অবনতির অন্যতম কারণ তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি:
১৯৯১: গনত্রন্ত্রের উত্থান ও বহুদলীয় রাজনীতি
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে হয় শ্বৈরশাসনের পতন ও অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন, ১৯৯১ এর নির্বাচন। আমরা যদি সেই ১৯৯১ সাল থেকে, প্রত্যেকটা নির্বাচন পর্যবেক্ষন করি, আমরা দেখতে পারবো যে যদিও প্রথম দিকে বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতি বিরাজমান ছিল, আস্তে আস্তে আমাদের “ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট“ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে তা প্রতি নির্বাচনে পরিণত হয় দ্বিদলীয় রাজনীতিতে। ১৯৯১ এর নির্বাচনই যদি আমরা দেখি, সারা দেশে আওয়ামীলীগের সমর্থন ছিল ৩০ শতাংশ, বিএনপির সমর্থন ছিল ৩০ শতাংশ আর জাতীয় পার্টির সমর্থন ছিল ১২ শতাংশ। এছাড়া অন্য কোন দল অথবা স্বতন্ত্র প্রাথীদের সমর্থন ছিল ২৮ শতাংশ। এইখানে লক্ষনীয় এই যে আওয়ামীলীগ অথবা বিএনপির চেয়ে কোন না কোন তৃতীয় পক্ষের সমর্থনই বেশি ছিল (৪০ শতাংশ)। আমরা যদি ১৯৯১ তে ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট সিস্টেম অনুসরণ না করে কোন দল কত ভোট পেয়েছে সেই অনুসারে সংসদে আসন বন্টন করতাম, তাহলে বিএনপি পেত ৯০ টি আসন, আওয়ামীলীগ পেত ৯০ টি আসন, জাতীয় পার্টি পেত ৩৬ টি আসন আর অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেত ৮৪ টি আসন। এইরকম একটি একটি সংসদে কি পরিমানে বহুদলীয় রাজনীতির চর্চা হত বুঝতেই তো পারছেন। বিরোধীদল থাকতো অত্যন্ত শক্তিশালী আর সরকারি দলের জবাবদিহিতাও বেশি হত। কিন্তু আমাদের ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে বাস্তবে বিএনপি পেল ১৪০ টি আসন, আওয়ামীলীগ পেল ৮৮ টি আসন, জাতীয় পার্টি পেল ৩৫ টি আসন এবং অন্যান্য দল ও সন্তন্ত্র প্রার্থীরা পেল বাকি ৩৭ টি আসন।
১৯৯৬: দ্বিদলীয় রাজনীতির দিকে অগ্রসন
এই ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট নির্বাচনী ব্যাবস্থার কারনে প্রধান দুই দল ৯৬ তে হয়ে ওঠে আর একটু শক্তিশালী অন্যান্য দল গুলি হারায় আর একটু সমর্থন। প্রধান দুই দল মিলে গত নির্বাচনে যেখানে পেয়েছিলো ৬০ শতাংশ সমর্থন, এই নির্বাচনে তারা পায় ৭০ শতাংশ সমর্থন। আসন পায় আওয়ামীলীগ ১৪৬ টি, বিএনপি ১১৬ টি। তারা দুই দল মিলে গত নির্বাচনে পেয়েছিলো ২২৮ টি আসন, এই নির্বাচনে পেলো ২৬২ টি আসন।
২০০১: সরকারি দলের শ্বৈরশাসন
২০০১ এর নির্বাচনে এই ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট নির্বাচন ব্যবস্থার পরিনতি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ভাবে ভয়ংকর, ধারণ করে চূরান্ত এক রুপ। ২০০১ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির এক ধরনের সমতা ছিল, ছিল বহুদলীয় ও স্বতন্ত্র রাজনীতি বিরাজমান। ২০০১ এ হ্রাস পায় বহুদলীয় রাজনীতি, ক্ষমতা হয়ে ওঠে কেন্দ্রীভূত, উত্থান হয় দ্বিদলীয় রাজনীতির। ২০০১ এ আওয়ামীলীগ ও বিএনপি উভয় মিলে পায় ৮১ শতাংশ সমর্থন। এর মধ্যে আওয়ামীলীগ পায় ৪০ শতাংশ সমর্থন ও বিএনপি পায় ৪১ শংতাংশ সমর্থন। বিএনপির সাথে রাজনৈতিক জোটে ছিল জামাতি ইসলাম। তারা পায় ৪ শতাংশ সমর্থন। সমর্থন অনুযায়ী যদি আসন বন্টন হত তাহলে বিএনপি পেত ১২৩ টি আসন, জামাতি ইসলাম পেত ১২টি আসন, ও আওয়ামীলীগ পেত ১২০টি আসন। অথচ এই ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে বিএনপি জামাত জোট পায় ২১০ টি আসন। আওয়ামীলীগ পায় মাত্র ৬২ টি আসন। প্রথমবারে মতন দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।
বর্তমান পরিস্থিতি ও পরিশেষ
একটু চিন্তা করে দেখেন ১৯৯১-২০০১ এর রাজনীতিটা কেমন ছিল? বিরোধীদলগুলি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী, বিরাজমান ছিল বহুদলীয় ও স্বতন্ত্র রাজনীতি। এখন একটু চিন্তা করে দেখেন ২০০১ এর পরের রাজনীতি ঠিক কেমন হয়ে উঠলো? ক্ষমতাশীল দল হয়ে উঠলো স্বৈরাচারী আর বিরোধীদলগুলো হলো নির্যাতিত ও নিপীড়িত। ২০০১ এর আগ পর্যন্ত তো বিএনপি ও আওয়ামীলীগ উভয়ই একবার করে ক্ষমতায় ছিল। তখন কেন এমনটা হয় নাই? আশা করি বুঝতেই পারছেন যে আমাদের দেশে রাজনৈতিক অবনতির অন্যতম কারণ হচ্ছে এই ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট নির্বাচনী ব্যবস্থা।এই কারণেই যারা আসলেই দেশের ভাল চায় তারা স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসাবেও রাজনীতিতে অংশগ্রহনে ইচ্ছুক না। অথচ, ১৯৯১ এর নির্বাচনে কিন্তু প্রচুর পরিমানে স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদরা অংশগ্রহন করে। বিকল্প নির্বাচনী ব্যবস্থা ও একক হস্তান্তরযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হবে এর পরবর্তী পোস্টে।
শামস রহমান – মুক্তিফোরামের একজন নিয়মিত কলামিস্ট