বৈশ্বিক সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশ এবার ১০৫তম হয়েছে, যেখানে গতবছর ছিল ১০৩, এবং এর আগের বছর ছিল ১০২তে। প্রতিবেদনে স্থান পাওয়া ১২টি খাতের মধ্যে ৯টিতেই বাংলাদেশের ক্রমাবনতি ঘটেছে। কিন্তু প্রতিবেদনে প্রকাশিত বাস্তবতা আর উন্নয়নী সরকারের এ সংক্রান্ত দাবিদাওয়া পাশাপাশি রাখা হলে যে দৃশ্যের অবতারণা ঘটে সেটা হচ্ছে-
১। নিরাপত্তা, দুর্নীতি ও বাক্ স্বাধীনতা তলানিতেঃ
প্রতিবেদন বলছে এই খাতগুলোতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিন্ম অবস্থানে রয়েছে, এবং বৈশ্বিকভাবে একেবারে তলানিতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু সরকারের দাবিমতে, ‘সরকার দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার নিরলসভাবে কাজ করছে’; ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে’। ‘দুর্নীতি শতভাগ নির্মূলে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে’। ‘সরকার জনগণের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে না’; এমনকি ‘যুক্তরাজ্যের চেয়েও বাংলাদেশের গণমাধ্যম বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে’।
২। সেবাখাত নিম্নমুখীঃ
সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন যোগাযোগ অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির মতো সেবাখাতগুলোতে বাংলাদেশে অবনতির কথা উল্লেখ করেছে। অথচ সরকার যোগাযোগ অবকাঠামোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও বাজেট বরাদ্দ রেখে উপর্যুপুরি প্রকল্প পাশ করছে। যদিও সড়ক নিয়ে দুনিয়া কাঁপানো আন্দোলনের পরেও সরকার এ বিষয়ে আগের মতোই উদাসীনতা জারি রেখেছে, এমনকি এ বিষয়ে পিএম অফিসের প্রেসক্রিপশনও ময়লার ঝুড়িতে ফেলে রেখেছে। বিদ্যুৎখাতের উন্নয়নে ত্রিশগুণ ভর্তুকি এবং উচ্চব্যয়ের উদারতা দিয়ে দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানীকে বিশ্বসেরা ধনী হবার সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড়া গ্যাস ও পানি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পন্ন আছে বলেই সম্প্রতি ভারতকে এগুলো সরবরাহের ব্যাপারে সমঝোতা করতে পেরেছে।
৩। তথ্য-প্রযুক্তির গ্রহণে সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছেঃ
এ সংক্রান্ত সূচকে প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে বাংলাদেশ গতবছরের চাইতে ৬ ধাপ পিছিয়ে ১০৮তম হয়েছে। যদিও সরকারের দাবিমতে, তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক ডিজিটাল সেবায় সাফল্যের কারণে ‘সারাবিশ্বের মন্ত্রীরা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে’, এমনকি এই সেবায় উন্নতরাষ্ট্র বিট্রেনও ‘বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে’।
৪। সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতাঃ
প্রতিবেদন যদিও এ সূচকে বাংলাদেশ ৮৮তম থেকে ৯৫ তে নেমে এসেছে বলছে, কিন্তু এটা সত্য হলে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ কীভাবে প্রতিবছর তার আগের বছরের চাইতে স্ফীত হচ্ছে! এছাড়া টাকাপয়সার সংকুলান কোনও সমস্যা না বলেই তো বিশ্বের যেকোন দেশের তুলনায় যেকোন প্রকল্পে রেকর্ড পরিমাণ ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে।
৫। গ্রাজুয়েটদের মান, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে অবনতিঃ
প্রতিবেদনমতে, এ সংক্রান্ত সূচকে বাংলাদেশ ১৪০টি দেশের মধ্যে ১২৩ ও ১১৫ নম্বরে আছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু নয়, বৈশ্বিকভাবে তলানিতে। অথচ, প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় লাখে লাখে জিপিএ ফাইভ কি অন্যকোন দেশের শিক্ষার্থীরা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে?
৬। নিয়োগ-বরখাস্ত ও শ্রমিক অধিকারে অবনতিঃ
এ দুটো সূচকে যদিও প্রতিবেদন ৪ ও ১৭ ধাপ পেছানোর কথা বলছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ‘বর্তমান সরকারের মতো কোনও দেশের সরকার শ্রমিকদের বেতন এত বাড়াতে পারেনি’, এবং ‘শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক’ এমন দাবি হরহামেশা উচ্চারিত হচ্ছে।
৭। নাজুক ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাঃ
যদিও এ খাতে বাংলাদেশ গতবছরের চাইতে ৩ ধাপ পিছিয়ে ১২৯ তম হয়েছে, যা আফ্রিকান দরিদ্র দেশগুলোর অনেকের চাইতে নিচে। কিন্তু এটা সত্য হলে সরকার নতুন নতুন ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ানোর সাহস করছে কীভাবে?
৮। ব্যবসায় বৈচিত্রের অভাবঃ
ব্যবসা শুরু করার সূচকেই যেখানে বাংলাদেশ বিশ্বের তলানিতে আছে, সেখানে বৈচিত্র্যের প্রসঙ্গ উত্থাপন একেবারেই অমূলক মনে হতে পারে।
৯। উদ্ভাবনী সক্ষমতা হ্রাসঃ
গবেষণা খাতে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম টাকা ব্যয় করে। এজন্য গবেষণায় কোন দেশ কী পরিমাণ ব্যয় করে সে সংক্রান্ত গ্রাফে সুদান ও উগান্ডার মতো দেশের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নাম অনুপস্থিত আছে। কিছুদিন আগে ঢাবি অধ্যাপক ফারুক জনস্বার্থে গবেষণা করতে গিয়ে যে পরিমাণ সরকারি রোষানলে পড়েছেন, এ ঘটনায় বাকি যারা গবেষণায় ইচ্ছুক আছেন তারাও ইচ্ছের অব্যাহতি দিয়ে সরকারি টাকা সাশ্রয়ে ভূমিকা রাখতে পারেন।
চারু হক, লেখক. charuhaque@gmail.com
1 Comment
ধন্যবাদ