ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালী কার্যক্রমকেন্দ্রিক নয়, বরং আমরা প্রচন্ডরকম ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ফলে আমাদের পছন্দের ব্যক্তিটি যদি বলেন সূর্য পশ্চিমদিকে উঠেছে, আমরাও নিষ্ক্রিয় মস্তিস্কে পরিপূর্ণ আবেগের সহিত সমস্বরে বলি, “জ্বি যাহাপনা, সূর্য পশ্চিমদিকেই উঠেছে!”
ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় প্রচলিত এই কথাটির বিন্দুমাত্র প্রয়োগ আমাদের সমাজে নেই, বরং উল্টো বাক্যটিই আমাদের চর্চার মূল বিষয়বস্তু। জনপ্রিয়তার পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা ভুলেই যাই যে সব সত্য জনপ্রিয় নয়, জনপ্রিয়ও সর্বদা সত্য নয়। লোক দেখানো আয়োজন, নিয়ম রক্ষার আনুষ্ঠানিকতা আর অর্থহীন কর্মকান্ডের ভীড়ে আমরা ভুলে যাই আমাদের আসল উদ্দেশ্যটা কী! এভাবেই একটি দেশ পরিণত হয় অনিশ্চয়তার পথে অবিরাম ছুটে চলা নিরুদ্দেশ এক জনপদে।
গণতন্ত্রের তীর্থভূমি না হলেও গতানুগতিকভাবেই এদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুর প্রভাব বিদ্যমান। দুর্ভাগ্যবশত এদেশে নিরপেক্ষ এবং উদারমনা মানুষই সংখ্যালঘু। পক্ষান্তরে, সংখ্যাগুরুর কাতারে রয়েছে নিজেকে সর্বদাই ঠিক ভাবা অনমনীয়, একগুঁয়ে কিছু মানুষ যারা সমালোচনাকে বরন করতে জানেনা। অথচ সমালোচনা কোনো মতবাদ নয়, এটি স্রেফ মতামত! সব সমালোচনা ধ্বংসাত্মক হয়না। মহৎ উদ্দেশ্যে কিংবা পরিবর্তন ও পরিশোধনের আশায়ও সমালোচনার অবতারণা হয়। একগুয়েমি এবং অনমনীয়তার কারণেই গঠনমূলক সমালোচনার স্থলে যায়গা করে নিয়েছে কাদা ছোড়াছুড়ির মতো নোংড়া অপসংস্কৃতি।
বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেবার ক্ষমতা বাংলাদেশের কোনো সরকারের ছিলোনা এবং নেই। বিভিন্ন সময়ে আমরাই চুপ থেকেছি একজোট হয়ে। ফলে যখনই কেউ আওয়াজ তুলেছে এবং আশপাশে কাউকে পায়নি, স্বাভাবিকভাবেই সে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। তখন দলবেঁধে আমরাই বলেছি-‘বাক স্বাধীনতা নাই!’
অথচ এই পরিস্থিতি আমরাই সৃষ্টি করেছি। একজোট হয়ে চুপ না থেকে যদি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে একসাথে আওয়াজ তোলা যায় তাহলেই তো সংখ্যাগুরু হয়ে গেলো! কিন্তু সেটাই আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ আমরা সবাই সত্যে বিশ্বাসী, তবে সেই সত্য হওয়া চাই আমাদের পক্ষে। সত্য পক্ষে না হলে সেই সত্য আমরা মানিনা।
আর শর্তের এই যাতাকলে পিষ্ট হয়ে নৈতিকতা আজ বিপন্ন আর বিসর্জিত আমাদের বাকস্বাধীনতা।
লেখকঃ মুস্তাফিজ রিদম, নর্থ সাউথবিশ্ববিদ্যালয় ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী।