বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক রায় মূলত হিন্দুত্ববাদীদের উগ্র ডানপন্থি রাজনীতিরই আইনি বৈধতা। যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল, সেখানে মন্দির স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হিন্দুত্ববাদীদের রাজনীতিকেই এন্ডোর্স করা।

সুপ্রীম কোর্টের আর কিছু করার ছিল না, এরকম রায় না দিলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যেত ইত্যাদি বলা প্রকারান্তরে হিন্দুত্ববাদীদের দাবিকেই প্রতিষ্ঠা করা।

বাবরি মসজিদ বা অন্য কোন নামে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দিলে সব ঠিক হতো? বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরি হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না? ছিল নিশ্চই।

এটা মাথায় রেখেই আপনাকে ভাবতে হবে তাহলে কী রায় দেয়া যায়। আপনি তো সুপ্রিম কোর্ট তাইনা? বাবরি মসজিদের আগে তো সেখানে কোন রাম মন্দির ছিল এমন প্রমাণ আপনি পাননি। তাহলে বাবরি মসজিদের স্থলে মন্দির স্থাপনের অনুমতি দিয়ে কী ইংগিত দেয়া হলো?

ওইখানে মসজিদ না হলে মুসলমানদের ধর্ম-কর্ম কি সব শিকেয় উঠবে? না। কিন্তু মসজিদের জায়গায় মন্দির স্থাপন করার অনুমতি দেয়ার অর্থ হচ্ছে ‘রাম জন্মভূমি’র আন্দোলনকে আইনি বৈধতা দেয়া এবং হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয়া যে, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ভিত্তি না থাকলেও কেবলমাত্র ডানপন্থি ‘জিহাদি’ জোসে একটা মারাত্মক অনাকাঙ্ক্ষিত সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারলে, ‘সেক্যুলার’ ইন্ডিয়ার আইন-আদালত পরবর্তীতে এমন রায় দিবে যাতে আদতে আক্রান্ত-ক্ষতিগ্রস্তরা একটা আপাত স্বান্তনা পুরস্কার পেলেও, সংঘবদ্ধ মতাদর্শিক সন্ত্রাস করতে পারার সক্ষমতা স্বীকৃতি পায়।

দাঙ্গার মাধ্যমে নিজেদের মতাদর্শকে চরিতার্থ করা যায়। এই রায়কে তাই কোনভাবেই ‘ব্যালেন্সড’ রায় বলা যায়না।

তাজমহলের বিরুদ্ধেও হিন্দুত্ববাদীদের নানা রকম প্রপাগান্ডা আছে। কালকে থেকে তারা যদি বলতে শুরু করে, তাজমহলের স্থলে তাদের অমুক মিথিক ক্যারেক্টারের কিছু একটা ছিল, এবং বাবরি মসজিদের মত অনুরূপ একটা ঘটনা ঘটানোর বিশ/ত্রিশ বছর পর যদি ভারতের আদালত এমন রায় দেয় যাতে হিন্দুত্ববাদীদের দাবি ও রাজনীতিই প্রতিষ্ঠিত হলো, অপরদিকে আক্রান্তদেরকে অন্যত্র তাহমহলের ন্যায় কিছু একটা বানানোর অনুমতি দেয়া হলো, সেক্ষেত্রে কি সেই রায়কে ‘ব্যালেন্সড’ রায় বলার কোন সুযোগ থাকবে?

সুতরাং, মসজিদ-মন্দির কিছু না, মানবতাই মূল কথা এই টাইপের কথার রাজনীতিটাও বোঝা দরকার। ‘মসজিদ-মন্দির কিছু না, মানবতাই মূল মানবধর্ম’ এই সেক্যুলার বাণীর আবেদন অন্য সময়ে থাকলে থাকতে পারে, কিন্তু একটা এথনিক-রেলিজিয়াস-ন্যাশনালিস্টিক পলিটিকাল ইডিওলজির উপর ভর করে অন্য একটা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চিহ্ন ধ্বংস করার পর এহেন বাণী প্রচার করা হয় নির্বুদ্ধিতা অথবা মারাত্মক শয়তানি।

বাংলাদেশের রামুতে বৌদ্ধ মন্দির ভেঙ্গে ফেলার পর এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটতে পারার পেছনে সংঘবদ্ধ রাষ্ট্রীয়-মতাদর্শিক-রাজনৈতিক ক্ষমতাকে এক্সপোজ না করে, মসজিদ-মন্দিরের ঊর্ধে মানবতাকে স্থাপন করতে চাওয়া একরকমের সন্ত্রাস-অনুকূল মনস্তত্ত্ব।

বাবরি মসজিদকে ঘিরে, পুরো ঘটনাকে আমলে না নিয়ে ; এর মাধ্যমে ভারতে সম্প্রদায়গত সহাবস্থানের সংস্কৃতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, ভারতের মুসলমানরা আরো কতটা ভালনারেবল হলো, হিন্দুত্ববাদীরা আরো কতটা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেল, সেসব চিন্তা-আলাপ-আলোচনা দূরে সরিয়ে রেখে ‘মানবতার জয়গান’ এক প্রকারের এস্কেপিস্ট ও রাজনৈতিক-মতাদর্শিক দুর্বৃত্তদের পক্ষেই অবস্থান নেয়া।

আবার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক-ডানপন্থি শক্তি যেন কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটানোর লাইসেন্স না পেয়ে যায়, রাষ্ট্রীয়-সামাজিক পরিসরে সেই খেয়ালও রাখতে হবে।

সারোয়ার তুষার মুক্তিফোরামের একজন সম্পাদক

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply