কথা গুলো একটু গোড়া থেকে শুরু করি–

১। চীনে যখন প্রথম করোনার কথা শোনা গেলো অনেকেই ‘খুব ভাল হইসে’ টাইপের একটা এক্সপ্রেশন দিয়ে ভেবে নিলো ‘মুসলিমদের অত্যাচার করে দেখে চীনের উপর গজব পরসে’।

২। এরপর শুরু হোল মাস্ক পরা নিয়ে, ‘মুসলিমরা যখন নেকাব পরে তখন পছন্দ হয় না, এখন আল্লাহ্ এমন ব্যবস্থা করলো মুখ ঢাকতে বাধ্য’।

৩। ইতিমধ্যে কেউ কেউ করোনার এব্রিভিয়েশন বের করে ফেলেছে, ‘ক- কুরআন, রো- রোজা, না- নামাজ’!

৪। এবং সর্বশেষ, মসজিদে জামায়াত-বদ্ধ হয়ে করোনা মুক্তির দোয়া।

আমারা কি আসলেই বিবেক সহকারে সঠিক ইসলামিক জ্ঞান রাখি?

এই জাতীয় সস্তা চিন্তা গুলো দেখলে মনে হয়, আমাদের ইসলামিক জ্ঞানের দৌড় ‘পেঁপের উপর আল্লাহু লেখা পাওয়া গ্যাসে’ পর্যন্তই। কুরআন, হাদিসের রেফারেন্সে সহ এই যুক্তি গুলোকে খণ্ডন করতে পারবেন? চীনে মহামারী আকার ধারণ করার পর যখন হাত তালি দিয়েছেন, এখন কি সেই হাত তালি দিতে পারছেন যখন কিনা এই ‘গজব’ আমাদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে? যেখানে আরও অসংখ্য মুসলিম দেশে এই ‘গজব’ এতো ব্যাপক আঁকারে ছড়িয়ে পড়েছে, যে গোসল এবং কাফন ছাড়াই লাশ কবর দেওয়া হচ্ছে। মহামারী হতে পারে আল্লাহর তরফ থেকে গজব, কিন্তু এতে খুশি হওয়ার মতো কিছু নাই, কারণ এই মহামারীতে আপনার, আমার এবং আরও অসংখ্য সাধারণ মানুষের প্রাণ চলে যেতে পারে। তাই আমরা আল্লাহর কাছে মাফ এবং সাহায্য চাইতে পারি, ‘দেখো আল্লাহর কি খেল’বলে হাতে তালি দিয়ে হাসার কোন কারণ আছে কি?

মাস্ক আর নেকাব নিয়ে যারা খুব মাতামাতি করলেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন, ইসলামে নারীদের ক্ষেত্রে নেকাবকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে নয়, তাহলে কি শুধু নারীরা মাস্ক পরবেন, পুরুষরা পরবেন না? চীনের, করোনায় আক্রান্ত লাশ পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্তে তাহলে হিন্দুধর্মাবলম্বীরাও বলবে, ‘দেখস, এই জন্যে লাশ পুড়ায় ফেলতে হয়, এটাই সাইন্টিফিক!!!’ নেকাব নারীদের পর্দার একটি ঐচ্ছিক বিধান, আর মাস্ক নারী পুরুষ নির্বিশেষে রোগ জীবাণু থেকে সুরক্ষার ঢাল। অতএব, নেকাবের উদ্দেশ্য এবং মাস্কের উদ্দেশ্য পুরাই ভিন্ন।

আর করোনার এব্রিভিয়েশন দেখে আমি পুরাই টাস্কিফাইড!!! করোনা মানুষের জন্য মারাত্মক খারাপ, আর আপনি যখন করোনার অক্ষর গুলো ভেঙে কুরআন, রোজা, নামাজের পাযেল বানান, সেই অর্থে আপনি আসলে কি বোঝাতে চান? হাদিস অথবা কুরআনের কোন আয়াতে আছে একটু দেখাবেন? এই মাথাটাই যদি অন্তত ব্যাখ্যা সহ কুরআন বোঝার কাজে লাগাতেন তাহলে মানুষ আরও উপকৃত হত।

ভিন্ন একটি ধর্মের কিছু সংখ্যক লোক করোনা থেকে মুক্তির জন্য যখন গোমূত্র পান করে আমাদের হাসির খোঁড়াক হচ্ছে, আমারা ইসলামের নামে এই ধরণের সস্তা ব্যাখ্যা দিয়ে কতটুকু সুস্থ জ্ঞানগর্ভা চিন্তার পরিচয় দিচ্ছি?

এই মুহূর্তের সবচে হট টপিক, ‘মসজিদে জামায়াত বদ্ধ হওয়া’। যেখানে হাদিস-এ স্পষ্ট আছে, ঝড়বৃষ্টির সময় ঘরে নামাজ আদায় করতে, সেখানে আপনাদের কাছে কি মনে হয় করোনার তুলনায় ঝড়বৃষ্টি একটা বিশাল বড় বিপদ? যেখানে পশুর ক্ষেত্রে আমাদের রাসূল (সঃ) বলেছেন, অসুস্থ উটের সংস্পর্শে যেন সুস্থ উট না আসে, সেখানে মানুষ যেন সংক্রমিত না হয়, সেটা কতটা গুরুত্ব সহকারে আমাদের বিবেচনা করা উচিৎ সেটা কি ভেবে দেখেছি? আজকে, আপনি আমি জামায়াত-বদ্ধ হওয়ার কারণে আমাদের দ্বারা যদি কেউ আক্রান্ত হয়, সেই দায় কি আপনি আমি কেয়ামতের দিন এড়াতে পারবো? এবং এই আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে আরও যারা আক্রান্ত হবে, সেই সমস্ত দায়ও কিন্তু আপনার আমার ঘাড়েই চাপবে। এই সংকটের সময়, যেখানে স্পষ্টত বোঝাই যাচ্ছে যেকোনো গণ জামায়াত পরিত্যাগই একমাত্র সুরক্ষার উপায়, সেখানে গলার রগ ফুলিয়ে যদি জামায়াতে নামাজের কথা বলেন, তাহলে হিন্দুধর্মাবলম্বীরাও বলবে ‘আমরাও মন্দিরে একসাথে প্রার্থনা করবো, একই ভাবে খ্রিস্টীয় এবং বদ্ধধর্মাবলম্বীরাও বলবে, ‘আমরাও গির্জায়, প্যাগোডায় একত্রিত হব’, তখন অবস্থাটা কি দাঁড়াবে সেটা একটা পাগলেও বুঝবে!!!
আপনার যুক্তি যদি হয়, ‘আমরা জামায়াত-বদ্ধ হয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাব, আমরা মুসলমান ইনশাল্লাহ আমাদের কিসু হবে না’, ভাই, করোনা ভাইরাসের মাথায় কি আল্লাহ্ বুদ্ধি দিয়া দিসে, যে সে হিন্দু মুসলিম বুইজ্ঝা তার শরীরে প্রবেশ করবে। আর আপনি নিজে সতর্ক না থাকলে এবং অন্যকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা না করলে, আল্লাহ্ আপনাকে সেঁধে সেঁধে সুরক্ষিত রাখবে না, কারণ রাসূল (সঃ) বলেছেন, ঘোড়া বেঁধে রেখে আল্লাহ্র উপর তাওয়াককুল(ভরসা) কর। যেমন, আপনি রিজিকের চেষ্টা না করে ঘরে বসে, ‘আল্লাহ্ আমাকে রিজিক দাও-এর’ দোয়া করলেই আল্লাহ্ আপনার ঘরে মান্না ও সালওয়া পাঠায় দিবে না!!!

মুসলিম হিসাবে মানুষ হিসাবে এই সংকটের সময় আমাদের অনেক দায়িত্ব আছে। কুরআন এবং হাদিসের আলোকে, আমরা কি প্রচার করতে পারি না, এই মুহূর্তে আমরা যারা সামর্থ্যবান, যে যতটুকু পারি দিনমজুর গায়ে খেটে খাওয়া মানুষ অথবা অর্থকষ্টে থাকা আমাদেরই আত্মীয়, প্রতিবেশীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে। অতিরিক্ত খাবার মজুত করা কতো বড় গুনাহ, আসুন সেটা ব্যাখ্যা করি, মানুষ যেন এই গুনাহ থেকে বিরত থাকে সেই ব্যাপার সতর্ক করি। ইসলামে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার তাৎপর্য কতখানি যা কি না এই মুহূর্তে খুব বেশী দরকার সেটা মানুষকে বিস্তারিত জানাই। মহামারীতে আল্লাহর কাছে কীভাবে সাহায্য চাইতে হয়, কি কি ইবাদত করতে হয়, আসুন নিজেরাও জানি অন্যদের জানাই।
আর হ্যাঁ শুধু মসজিদের জামায়াত কেন, দুই সপ্তাহর জরুরী অবস্থাকে যারা ছুটি পাইসি ভেবে, সমুদ্রে গা ভাসাতে গিয়েছেন অথবা বান্দরবানে মনের আনন্দে বান্দরের মতো ঝুলতে গেসেন, তারা দয়া করে দায়িত্বশীল হন, এটা আমাদের সকলের নাগরিক হিসাবে নৈতিক দায়িত্ব। পুরো জাতির এই সংকটে যদি আপনি দায়িত্বশীল না হন, তাহলে আল্লাহর কাছে কঠিন জবাবদিহিতার জন্য তৈরি থাকুন।

লেখকঃ Nuren Nirvana Brishti, Guest Lecturer, Independent University Bangladesh.

Share.
Leave A Reply