সদ্য নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিত ব্যানার্জি জানাচ্ছেন যে, বাংলাদেশেরও উচিত নতুন টাকা ছাপিয়ে আসন্ন অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবেলা করা। আরেক নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও দেখিয়েছেন যে, সংকটের মুহুর্তে জনগণের কাছে টাকা থাকাটাই সম্পদ। এটা সত্য কথা তবে এটা নির্ভর করবে ওই দেশের অর্থের মূল্য, মূল্যস্ফীতি কেমন সেটার উপর। ধরুন, এক পরিবার টাকা পেলো ১০ হাজার কিন্তু ওই দেশে মুদ্রাস্ফীতি এমন বাড় বাড়লো যে ওই ১০ হাজার টাকার মূল্য নিতান্তই কম উপরন্তু বাজারে খাদ্য ঘাটতি এবং মূল্যস্ফীতি! তাহলে সেই টাকা দিয়ে ওই পরিবার করবে কি? তাহলে কি উপরের দুই বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কি ভুল কিছু বলেছেন? প্রাসঙ্গিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বুঝায় যায় যে উনারা যে প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন সেটা ঠিক হতে পারতো যদি আমাদের দেশে আর কোন ফ্যাক্টরই কাজ না করে। ফ্যাক্টরগুলো হলো, সরকারের ব্যাংক থেকে লোন নেয়া, রিজার্ভ থেকে এডজাস্ট করা অথবা বাইরের ঋণদাতা দেশসমূহ/সংস্থাগুলো থেকে ঋণ না পাওয়া। কিন্তু আমাদের এখনো এইসব ফ্যাক্টর টিকে আছে, অর্থাৎ ব্যাংক থেকে সরকার লোন নিতেই পারে এবং এর বড় যুক্তি হলো বড় বড় ঋণখেলাপীদের ঋণ এডযাস্ট করা হয় ব্যাংক লোন নিয়েই তাহলে দেশের ক্রাইসিসে ঋণ নেয়া যাবে না? যদি তাও না পারা যায় তাহলে তো আমাদের রিজার্ভ আছেই, এবং যথেষ্ট ভালো পরিমাণেই আছে। এরপর না হয় বৈশ্বিক ঋণ। আইএমএফ সহ দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের হার কমিয়েছে এবং পূর্বের ঋণপরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়েছে ও সুদের হারও কমিয়েছে যা আমাদের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। তারমানে এই ফ্যাক্টরটিও আমাদের জন্য লাভবান হতে পারে। তাহলে আর টাকা ছাপানোর প্রশ্নই আসবে কেন?
বরং, দরিদ্র ব্যক্তিদের অর্থ সহায়তা দিতে হবে সরকারের বাকি খরচ থেকে কাটছাঁট করে। নতুন টাকা ছাপিয়ে নয়। লকডাউনের সময়ে যেহেতু সম্পদের উৎপাদন প্রায় থেমে গেছে, তাই এ সময়ের হেলিকপ্টার মানি প্রদান খাদ্যশস্যের পেছনে ব্যয় হবে এবং তার ফলে খাদ্যশস্যের মূল্যস্ফীতি ঘটতে পারে। তাই আমার মত, দরিদ্রদের জন্য সহায়তা দুই ভাগে ভাগ করে দেয়া উচিত। এক ভাগে থাকবে রেশনের মাধ্যমে খাদ্যপণ্য সহায়তা এবং অন্য ভাগে থাকবে হেলিকপ্টার মানি। এই অর্থ সহায়তাটি অর্থ না ছাপিয়ে এবং এডিপি ও সরকারের ব্যয় সংকোচন করে করা উচিত।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ব্যাপক খাদ্য সংকট আসন্ন। এ খাদ্য সংকট মেটাতে সরকার দরিদ্রদের যদি অর্থ দেয়, তবে খুব কম সময়ের মধ্যে খাদ্যশস্যের একটি মূল্যস্ফীতি হবে। কারণ হেলিকপ্টার মানির বড় একটা অংশ খাদ্যশস্যের পেছনে ব্যয় হবে। ঠিক এ মুহূর্তে বাজারে মজুদ খাদ্যশস্যের পরিমাণ স্থির এবং আগামী কিছুদিনেও নতুন চাল বাজারে আসা পর্যন্ত এই পরিমাণ স্থির থাকবে। একই সঙ্গে সামনের অনিশ্চয়তা মাথায় রেখে অনেক সমর্থ পরিবার একই সময়ে খাদ্য মজুদ করতে চাইবে। এ অবস্থায় সামান্য মূল্যস্ফীতি ভোক্তা পর্যায়ে একটি মজুদের প্রবণতা তৈরি করতে পারে।
এ অবস্থায় বর্তমান সময়ের খাদ্য সংকট দূর করার জন্য যেটা করা যায় সেটা হলো, বাংলাদেশ সরকার এ মুহূর্তে তার গুদামে রাখা ১৫ লাখ টন মজুদ থেকে ৭০ বা ৮০ শতাংশ রেশনের মাধ্যমে খাদ্য সংকটে পতিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করা। এতে তত্ক্ষণাত্ভাবে খাদ্য সংকটটি দূর হবে, কিন্তু খাদ্যশস্যের দাম বাড়বে না। বরং অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে খাদ্যশস্যের মূল্য হ্রাস পাবে। আর যদি যদি এডিপি থেকে কাটছাট করেও সমন্বয় করা না যায় তাহলে বাইরের দাতা সংস্থাগুলো থেকে ঋণ নেয়া যেতে পারে যেহেতু আমাদের গ্লোবাল ইকোনমিতে ঋণ এডযাস্টমেন্ট ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু নতুন করে টাকা ছাপিয়ে নতুন আরেক বিপদ ডেকে না আনাই কাম্য ও বুদ্ধিমানের কাজ।