১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি, বড় ভাই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান। তাঁর এই ফিরে না আসা জন্ম দেয় বিভিন্ন রহস্য ও তর্ক-বিতর্কের। তাই অনেককেই বলতে দেখা যায়, জহির রায়হান ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন, ‘নিহত’ হননি।

জহির রায়হান নিহত হয়েছেন ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে। তাঁর মৃত্যুকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনি হারিয়ে গেছেন। এরশাদ সরকারের সময় ফতোয়া দেয়া হতো, জহির রায়হানকে মুক্তিযুদ্ধের শহীদও বলা যাবে না। তবে রহস্য ও বিতর্কের ডালপালা ছড়ায় অন্য একটা কারণে। মূলত যে প্রশ্ন ঘিরে বিতর্ক চলতে থাকে তা হচ্ছে, জহির রায়হানকে কারা হত্যা করেছে, কিংবা কাদের হাতে জহির রায়হান মারা গেলেন, কিংবা কারাই বা জহির রায়হানকে গুম করল। এই প্রশ্নগুলোর জবাবে তখন অধিকাংশই তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। সেটার যথেষ্ট কারণও ছিল।

জহির রায়হান জীবনের শুরু থেকেই তাঁর বড় ভাইয়ের সংস্পর্শে কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথেই জড়িত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সাথেও জড়িত ছিলেন সক্রিয়ভাবে।

পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে অসাধারণ কিছু উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখেছেন জহির রায়হান। এমনকি এই প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র বানানোর পরিকল্পনাও করেছিলেন তিনি। একসময় আর্থিক কারণে বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণ করেন। কিন্তু, ‘আপন বিবেকের কাছে প্রতারক সাব্যস্ত হব’ এমন চিন্তা থেকে ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘এই সময় আমার আর্থিক সংকট ছিল বলে সৃজনশীল ছবির বদলে বাণিজ্যিক ছবির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এখন সে সামর্থ্য এসেছে। তাই আমার স্বপ্ন–সাধ নিয়ে ছবি তুলবার সময় উপস্থিত।’

সে সময়েই নির্মিত হয় ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটি।

একাত্তরে জহির রায়হান যখন স্টপ জেনোসাইড নির্মাণ করেন, তখন এর প্রচার নিয়ে অনেকেই বিরোধিতা করেন। বিরোধিতার কারণ ছিল, সেখানে লেনিনের ছবি ব্যবহার করা, শেখ মুজিবের কথা উল্লেখ না করা, ছয় দফার কথা উল্লেখ না করা ইত্যাদি। আসলে জহির রায়হানের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানকে অনেকেই মেনে নিতে পারেন  নি। আওয়ামীলীগের একাংশ যেখানে তখন মার্কিন সাহায্য পেতে উন্মুখ ছিল তখন কারা এমন বিরোধিতা করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে তিনি যখন বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার তথ্য অনুসন্ধান ও ঘাতকদের ধরার জন্যে কমিটি গঠন করে কাজ শুরু  করেন, তখন অনেক গোপন তথ্যই তাঁর হাতে পৌঁছায়। এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমাদের কাছে এমন অনেক তথ্য ও প্রমাণ আছে যা প্রকাশ করলে অনেকের মুখোশ খুলে যাবে। সময় বুঝে আমি এক এক করে সব প্রকাশ করব।” তাই, জহির রায়হান যখন মিরপুর থেকে ফিরে আসেন নি, এবং তাঁর ‘নিখোঁজ’ হবার পর সরকারী বা ব্যক্তিগত উদ্যোগেও কোন কমিটি হয় নি, তখন স্বাভাবিক ভাবেই সকলে প্রশ্ন তুলেন তখনকার সরকারী বাহিনীর উপর। এমনকি, কুখ্যাত আলবদর নেতা নিজামীও এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিল জহির রায়হানের নেতৃত্বে; সেই তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান জহির রায়হানকে কারা উধাও করল? কেন উধাও করল? সেই তদন্তটাও কেন হল না? এই প্রশ্নের উত্তর যদি আপনারা বের করতে পারেন, তাহলে আসল রহস্য আমাদের সামনে বের হবে!”

১৯৯৯ সালের পূর্বে প্রায় সকলেই জহির রায়হানের মৃত্যুকে ‘নিখোঁজ’ হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন, এবং প্রশ্নগুলো সেদিকেই  ঘুরপাক খেয়েছে। তবে, ১৯৯৯ সালের দিকে ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর রহস্যের কিছু সমাধান আমরা পেতে থাকি। 

জহির রায়হানের পুত্র অনল রায়হানের প্রতিবেদন ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক ২০০০’তে। শিরোনাম ছিল, ‘পিতার অস্থির সন্ধানে’। সে সময় ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় জহির রায়হানকে নিয়ে কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়। এগুলোকে ভিত্তি করেই এই আলোচনা।

কয়েকজন সেনাসদস্য নিহত হন। ক্যাপ্টেন মোর্শেদ ও নায়েক আমিরসহ কয়েকজন আহত হন। নিহতদের মাত্র ৩-৪ জন ব্যতীত আর কারও লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি মিরপুর পুরো জনশূন্য করার পরও। জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর মতে, ৩০ জানুয়ারি রাতেই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। রাতের অন্ধকারে বিহারিদের সরিয়ে ফেলা সেই লাশগুলোর সঙ্গে হারিয়ে যান আমাদের জহির রায়হানও।

জহির রায়হানের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁর বাসায় পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাইদ চৌধুরী বলেছিলেন, “স্বাধীন দেশে এমন একজন ব্যক্তিকে হারালাম, যাকে এখন আমাদের বেশি করে প্রয়োজন। যা ঘটল– এ আমাদের সকলের ব্যর্থতা।”

পত্রপত্রিকায় জহির রায়হানের হারিয়ে যাওয়ার খবর বের হতে লাগল। অনেকগুলো নতুন সিনেমা বানানোর কথা ছিল তাঁর। ভাষা আন্দোলন নিয়েও একটা সিনেমা বানানোর কথা ছিল। 

সিনেমার নামও দিয়েছিলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। কিছুই করা হল না। হারিয়ে গেলেন আমাদের জহির রায়হান।

জহির রায়হানের এই ‘ফিরে না আসা’কে কেন্দ্র করে চলতে থাকে নানা তর্ক-বিতর্ক, পূর্বেই তা উল্লেখ করেছি। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে মিরপুর ১২ নং সেকশনের মুসলিম বাজারের নূরী মসজিদের নির্মাণকাজের জন্য খননকালে বের হয়ে আসে মানুষের দেহাবশেষ, গুলিবিদ্ধ হাড়, করোটি; আবিষ্কৃত হয় বাংলার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বধ্যভূমির একটি। 

১২ নং সেকশনের এই বধ্যভূমি আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় ৩০ জানুয়ারির কথা , আবারও সামনে চলে আসেন হারিয়ে যাওয়া জহির রায়হান।

যুদ্ধের ২৮ বছর পর সেদিনের আহত নায়েক আমির হোসেনের সন্ধান পাওয়া যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। 

উল্লেখ্য, এই নায়েক আমিরের কথা জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীও তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন। তাঁর মুখ থেকেই বেরিয়ে পড়ে ঘটনা। তিনি স্বচক্ষে জহির রায়হানকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখেছিলেন। আমির হোসেন জহির রায়হানকে চিনতেন না। ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ‘সাংবাদিক’ হিসেবে। তার প্রতি নির্দেশ ছিল ওই সাংবাদিকসহ অন্যদের পাহারায় থাকা। যেহেতু সবাই সামরিক বাহিনীর লোক ছিলেন, তাই একমাত্র সেই সাংবাদিকই ছিলেন সিভিল পোশাকে। তিনি বলেন, ‘বেলা ১১টার দিকে ঢং ঢং পাগলা ঘণ্টা শুনতে পাই। গুলি ছুটে আসতে থাকে দক্ষিণ দিক থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই অনেক পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে এবং সেখানেই একটি ইটের স্তূপের পিছনে আমি অবস্থান নিই। তখন তাকিয়ে দেখি, পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিক সাহেবও যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, তাঁর পাশেই পানির ট্যাংকের দেয়ালের পাশে তাঁর দেহ পড়ে আছে।’ 

আমির হোসেনের কথা থেকেই আরও জানা যায়, ‘পুলিশের সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ দিক থেকে গোলাগুলি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তখনই ‘সিভিল পোশাকে’ একশ জনের মতো বিহারি দা-ছুরিসহ নানা ধরনের অস্ত্রপাতি নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসতে থাকে। 

তারা উর্দুতে গালিগালাজ করাসহ ‘কাউকেই ছাড়া হবে না’ বলে চিৎকার করছিল। 

অবাঙালিরা দক্ষিণ দিক থেকে এদিকে এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়া পুলিশ সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো শুরু করে এবং টেনে-হিঁচড়ে পানির ট্যাংকের পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে থাকে। এ সময় পড়ে থাকা সাংবাদিককেও (জহির রায়হান) ৬-৭ জন অবাঙালি হাত-ঘাড়-কোমর ধরে টেনে নিয়ে যায় পানির ট্যাংকের পশ্চিম দিকে।’

আমির হোসেনের জবানবন্দি নিয়ে দৈনিক ভোরের কাগজ ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘নিখোঁজ নন, গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘জহির রায়হান যে পোশাক পরে বেরিয়েছিলেন বলে তাঁর চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবির জানিয়েছেন, আমির হোসেনের দেয়া বর্ণনা তার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।’

এছাড়াও ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় হেলাল মোর্শেদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সে সময় আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তিনিও মিরপুর যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

তিনি জানান যে, জহির রায়হান যে মিরপুর যুদ্ধেই মারা গিয়েছিলেন সে বিষয়ে তিনি প্রায় নিশ্চিত ছিলেন। সে কথা তিনি জহির রায়হানের স্ত্রী সুচন্দাকে জানিয়েছিলেন বলেও মন্তব্য করেন।

জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীও বলেন, “অবশ্য এর আগে থেকেই আমরা যখন নিজেদের সদস্যদের হতাহতের খোঁজখবর তথা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করি, তখনই সৈন্যদের সঙ্গে একজন বাঙালি বেসামরিক লোক নিহত হয় বলে তথ্য বেরিয়ে আসে। ঘটনা বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে, তিনিই ছিলেন জহির রায়হান।”

এই প্রতিবেদনগুলোর মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, জহির রায়হান স্রেফ ‘নিখোঁজ’ হয়ে যান নি বরংপাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর বিহারীদের হাতেই নিহত হয়েছিলেন। আসলে, জহির রায়হানের এই মৃত্যু পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা পরিচালিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডেরই একটা অংশ।

১৯৭২ সালে জহির রায়হান যখন ঘাতকের হাতে নিহত হন তখন তাঁর বয়স সবে মাত্র ৩৭ বছর। এই মৃত্যুর ফলে বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলে প্রতিভাবান সৃষ্টিশীল এক সন্তানকে। তবে, তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আরেকটা বড় ক্ষতি হয়ে যায়। তিনি যে ‘বেইমান’দের মুখোশ উন্মোচন করার কথা বলেছিলেন, সেই মুখোশ আর উন্মোচিত হল না। আমাদের ঘরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা শত্রুদেরও আর চেনা গেল না। তবে এই শত্রুরাই যে পরবর্তীতে দেশের গতিমুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল, তা ইতিহাসেই প্রমাণিত।

জহির রায়হানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বোধহয় এই যে, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অনেক বড় পরিসরে ভাবতে পেরেছিলেন এবং সেটা ক্যামেরার মাধ্যমে ফুটিয়েও তুলছিলেন। আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামকে তিনি দেখেছিলেন দুনিয়া জুড়ে সব মুক্তিসংগ্রামের অংশ হিসেবে।

 আবার, ‘মুক্তি’ বলতে তিনি শুধু রাজনৈতিক মুক্তির কথাই বোঝাতেন না, তাঁর লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে। আজীবন কথা বলেছেন গণহত্যার বিরুদ্ধে, মানব হত্যার বিরুদ্ধে। 

গল্প, কবিতা, উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র, সবকিছুর মাধ্যমেই তিনি অবস্থান নিয়েছেন বিপন্ন মানবতার পক্ষে। জহির রায়হানের লেখা থেকে একটি উক্তি দিয়েই আলোচনা শেষ করি।

                             আমরা কোথায়?

                   ভিয়েতনামে না ইন্দোনেশিয়ায়।

                     জেরুজালেমে না সাইপ্রাসে।

                        ভারতে না পাকিস্তানে।

                            কোথায় আমরা?

জানো ওরা আমার ছেলেটাকে হত্যা করেছে হিরোশিমায়।

ওরা আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়।

আমার বাবাকে মেরেছে বুখেনওয়াল্ডে গুলি করে।

আর আমার ভাই। তাঁকে ওরা ফাঁসে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতো।

একজন জহির রায়হানের শূন্যতা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়। এখনও অপেক্ষা করি এমন একজনের জন্যে। আমাদের অপেক্ষার রাত বাড়ছে, হাজার বছরের পুরনো সে রাত!

লেখকঃ সহুল আহমেদ মুন্না, লেখক ও গবেষক

Share.

I am an Example Writer. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt labored et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Leave A Reply