নিটসে বেশ স্পষ্টভাবেই তার আশঙ্কার কথা লিখে গেছেন– পাশ্চাত্যে ন্যায়নীতির উৎস ও বিকাশের পথ সচেতনভাবেই রুদ্ধ হয়েছে আধুনিক মানসের ‘গণতান্ত্রিক কুসংষ্কার’-এর মাধ্যমে।[2] আমরা যখন বর্তমানের ঐতিহাসিক সাম্যবাদী ও প্রগতিশীল আত্মশ্লাঘার মধ্য দিয়ে অতীতের প্রতিসরণ ঘটাই, নিটসের বিশ্বাসমতে, অপরাপর মূল্যবোধগুলোকে উপলব্ধি করতে তখন ব্যর্থ হই আমরা আর এগুলোর মাধ্যমে নিজেকে বুঝার ও নিজের ওপর এদের প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগও পরিত্যাগ করি। এই ‘গণতান্ত্রিক কুসংস্কার’ আমাদের অতীতকে পাঠ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং বস্তুর নৈতিক বিন্যাস(এবং তার অনিশ্চিত প্রকৃতির) সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব ধারণার মাঝে যে ক্ষমতা ক্রিয়াশীল থাকে, তাকে দেখার বংশানুক্রমিক সম্ভাবনাকে বিসর্জন দেয়।
আজকের দিনে বহু পশ্চিমা চিন্তাভাবনাই এরকম এক সমস্যায় ভুগছে, যাকে নিটসের এই অভিযোগেরই রকমফের বলা যায়। যেমন, একটা ‘সেকুলার কুসংস্কার’ অতীত ও বর্তমানে আমাদের চিন্তার মাঝে এবং বিশ্বজুড়ে ধর্মের খেলা বুঝে উঠার চেষ্টায় বাঁধা দিচ্ছে। ধার্মিক ও সেকুলার ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু অনুমানের দ্বারা চালিত হয়ে, আমরা তাদের কিছু তথাকথিত প্রতিপক্ষে বিশ্বাস করে নেই। এবং এর ফলে আমরা ভুলে যাই যে, এমনকি এই আধুনিক সময়েও অন্যভাবে এদের জন্ম হতে পারত। এবং এভাবেই আমরা সেকুলারিজম, ধর্ম এবং বিশ্বায়ন সম্পর্কিত সাম্প্রতিক পরিস্থিতিগুলো উপলব্ধি করার সুযোগ হারাই।
সুখবর এই যে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবি সমাজের কিছু অংশে কতিপয় পণ্ডিতের সুবুদ্ধির প্রভাবে এই ‘সেকুলার কুসংস্কার’ ভাঙতে বসেছে। অন্যদের মধ্যে যেমন— তালাল আসাদ, উইলিয়াম কনোলি, সাবা মাহমুদ, চার্লস্ টেইলর, উইনিফ্রেড সালিভান, পিটার ডানচিন, তমোকো মাসুযাওয়া, হ্যান্ট দে ব্রিসের নাম অন্তর্ভুক্ত।[3] এই চিন্তাবিদগণ আমাদের শিখিয়েছেন যে আধুনিক পশ্চিমা সেকুলারিজমের কারণে কেবল চার্চ ও রাষ্ট্রের বিভাজন বা ধর্মবিহীন জনসমষ্টি কিংবা চিন্তার বিন্যাসই ঘটে না বরং এসবের বাইরে আরও অনেক কিছুরই আমদানি ঘটে। এবং তা গভার্নমেন্টালিটি ও বিষয় উৎপাদনের(subject production) কাঠামোতে রূপ নেয় যার থেকে আরও নানা অনুসিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে।
প্রথমত, সেকুলারিজম যে শুধু ধর্মকেই ধারণ করে তা নয়, বরং সমাজ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তা ধর্ম নিরপেক্ষও হয়ে উঠতে পারে না। সেকুলারিজম ধর্মের একটি সুনির্দিষ্ট মডেল ও অর্থ উৎপাদন করে। এবং একই সাথে উৎপাদন করে বিশেষ ধরনের কিছু ধর্মীয় বিষয় ও আচারের। উদাহারণস্বরূপ, প্রোটেস্টেন্টদের সংস্কার গোটা পশ্চিমকে এবং ধর্মবিশ্বাসী কিছু ব্যক্তিকে গড়ে তুলে, যাদের বিশ্বাস এবং উপাসনা দৈনিক আর্থ-সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ধর্মকে বিদায় জানানো দূরের কথা, সেকুলারিজম বরং ধর্মেরই জন্ম দেয় ও তাকে সংগঠিত করে, তার সাথে আতাত করে চলে। অন্যভাবে বলতে গেলে, চার্চ ও রাষ্ট্র, ধর্ম ও রাজনীতি, ব্যক্তি ও সমষ্টিকে পৃথকীকরণের বাইরেও সেকুলারিজম এই বিভাজনের উভয় অংশেই নানা অর্থ ও প্রথার জন্ম দেয় এবং এদের মধ্যেকার সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই কাজ করে।
দ্বিতীয়ত, জনজীবন থেকে ধর্মকে বিদায় জানানোর বদলে, সেকুলারিজম যেই সমাজে কর্তৃত্ব করে সেই সমাজে চেতনাজাত ধর্মীয় ভাবকল্পনা ও সাধনপ্রণালিকে রূপান্তরিত ও প্রচার করে। এই প্রচারণা আধুনিক সার্বভৌমত্বের চরিত্র[4 ] থেকে রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের সম্পর্কের প্রকৃতি হয়ে[5] আদর্শিক বিন্যাস এবং বিষয়ের তত্ত্ব[6 ] পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
তৃতীয়ত, তথাকথিত বহু সেকুলার চিন্তকের পাশাপাশি সেকুলার ধারণা ও এর নির্মাণ ইহজাগতিক ধর্মীয় চেতনা, আখ্যান ও কাঠামোর দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। উদাহারণস্বরূপ, নিটসে যদি বস্তুতান্ত্রিকতার সমস্ত আকাঙক্ষার ওপর ঐশ্বরিক দৃষ্টি স্থাপনের অহমিকাকে উন্মোচন করে থাকেন, তবে খ্রিস্টীয় রীতি-নীতির সরাসরি প্রত্যাখ্যান ও বিরোধীতা করার মাধ্যমে এন্টি-ক্রাইস্ট হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করে বলা যায় নানাভাবেই তিনি খৃস্টধর্মের মাঝেই আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। অথবা যদি স্মিথের কথা ধরি, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের ধর্মতাত্ত্বিক উৎস চিহ্নিতকরণের সময় যিনি সার্বভৌমত্বের ধারণা নির্মাণে এই ধর্মীয় কাঠামোরই পুনরাবৃত্তি করেন, যা কিনা সহজাতভাবেই অনন্ত, চিরন্তন, পরম, নিরপেক্ষ, আইনের ঊর্ধ্বে এবং সত্যের নির্মাণ ও নির্ধারণে সক্ষম। অথবা মার্ক্সের বস্তুবাদী ইতিহাসবিষয়ক রচনাবলী, যা মানবজাতির ইতিহাস নির্মাণে সচেষ্ট হয়ে এমন এক আখ্যান দাঁড় করায়, যা ঈশ্বরের কৃপা হতে বঞ্চিত হওয়া থেকে শুরু করে পাপমোচন ও পৃথিবীতে স্বর্গ নির্মাণে গিয়ে শেষ হয়। এরকম অসংখ্য উদাহারণ আছে, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে সেকুলার প্রতিশ্রুতির ফলেই মানুষের সমাজ ও সামাজিক অভ্যাস এবং চিন্তা থেকে ধর্মীয় চেতনা বিলীন হয়ে যায় না।
চতুর্থত, বিপবিত্রীকরণ কোনোভাবেই প্রগতিশীল ও সংগত প্রক্রিয়া নয়, এবং সেকুলারাইজেশানের সমার্থকও নয়। ক্রমাগত নৈরাশ্য যেমন আনন্দদায়ক কোনো ঘটনার দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে, গণতান্ত্রিক নির্দেশমালা যেমন অগণতান্ত্রিকতায় আক্রান্ত হতে পারে, তেমনি পবিত্রকরণ প্রক্রিয়াও বিপবিত্রকরণ শক্তির ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না।[7] তাছাড়া, ধর্মকে সেকুলারিজম দিয়ে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিস্থাপন করলেই অনানুষ্ঠানিক পবিত্রকরণ প্রক্রিয়াকে দমন করা যায় না। অর্থাৎ, কোনো সমাজে মানুষ নিজেদের কঠোরভাবে সেকুলার হিসেবে চিন্তা করলেও পণ্য, টাকা, পদমর্যাদা, সংস্কৃতি, জাতি, রাষ্ট্র, এমনকি সভ্যতাকেও পবিত্রকরণ করা হতে পারে।
এই প্রতিটি দাবির পেছনেই প্রচুর তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে, যেগুলোর কেবল সারাংশ বর্ণনা করেছি আমি। সেকুলার এবং পবিত্রতা সম্পর্কে হাল আমলের অনেক নতুন চিন্তা থেকে উদ্ভূত আরও অনেক উপলব্ধির উদাহারণ দেয়া যায়, আসাদের ‘সেকুলারের গঠনপ্রক্রিয়া’র বহুত্বকরণ থেকে শুরু করে মাসুযাওয়ার ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘বিশ্ব ধর্মের’ প্রাচ্যবাদী উৎপাদনের চমৎকার বৃত্তান্ত, এবং মাহমুদের প্রস্তাবনা যা দাবি করে– সেকুলারিজমের ডিসকোর্স ধর্মের প্রকৃত অবস্থান উল্লেখ করে না বরং এর সংজ্ঞা ও অর্থ নির্দেশ করে মাত্র।[8] কিন্তু যে তিনটি আলোচনা এখানে নির্দেশ করেছি আমি, পুঁজিবাদের ধার্মিক চরিত্র সম্পর্কে মার্ক্সের চিন্তাভাবনার সাথে পুনঃসম্পর্ক স্থাপনের পথ খুলে দেয় সেগুলো। যেই পরিস্থিতিগুলোর উল্লেখ করে আমি আলোচনা শুরু করেছিলাম সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মার্ক্সের চিন্তাকে বের করে নিয়ে আসার জন্য এই সম্পর্ক গ্রহণ করা হয়েছে: কেন বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের অভূতপূর্ব তীব্রতাবৃদ্ধির সাথে সাথে সমহারে ধর্মের পুনরুত্থান ঘটছে? পুঁজিবাদ তার নিজের অভ্যন্তরে ঠিক কোন ধরনের ধার্মিকতাকে অধিগ্রহণ করে? শুধু বিপবিত্রীকরণই না, কোন্ পবিত্রীকরণ প্রক্রিয়াকে পুঁজিবাদ প্রকাশ ও সম্পাদন করে, এবং কোন্ ধর্মীয় প্রণোদনাকে তা প্ররোচিত করে?
– ওয়েন্ডি ব্রাউন
[‘মার্ক্স (ক্যাপিটাল) কি সেকুলার?’- এর অংশ বিশেষ]
তানভীর আকন্দ
***
2. Friedrich Nietzsche, On the Genealogy of Morals, trans. Walter Kaufman (New York: Vintage, 1967), 28.
3. See Talal Asad, Formations of the Secular (Stanford: Stanford University Press, 2003), hereafter cited as fs;
William Connolly, Why I Am Not a Secularist (Minneapolis: University of Minnesota Press, 1999);
Peter Danchin (with Saba Mahmood), The Politics of Religious Freedom: Contested Genealogies, special issue of South Atlantic Quarterly 113, no. 1 (forthcoming, 2014);
Hent de Vries and Lawrence E. Sullivan, eds., Political Theologies: Public Religions in a Post- Secular World (New York: Fordham University Press, 2006);
Hent de Vries, ed., Religion: Beyond a Concept (New York: Fordham University Press, 2008);
Tomoko Masuzawa, The Invention of World Religions (Chicago: University of Chicago Press, 2005), hereafter cited as iwr; Saba Mahmood, Politics of Piety (Princeton: Princeton University Press, 2005), hereafter cited as pp;
Saba Mahmood, “Secularism, Hermeneutics, and Empire: The Politics of Islamic Reformation,” Public Culture 18, no. 2 (2006), hereafter cited as “she”;
Winnifred Fallers Sullivan, The Impossibility of Religious Freedom (Princeton: Princeton University Press, 2005);
Charles Taylor, A Secular Age (Cambridge: Harvard University Press, 2007), hereafter cited as SA.
4. See Carl Schmitt, Political Theology: Four Chapters on the Concept of Sovereignty, trans George Schwab (Chicago: University of Chicago, 2005);
Carl Schmitt, Concept of the Political, trans. George Schwab (Chicago: University of Chicago, 2007).
5. Robert Tucker, ed., The Marx-Engels Reader, 2nd ed. (New York: Norton, 1976), 319. Hereaftercited as m.
6. Max Weber, The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism, trans. Talcott Parsons (Mineolany: Dover, 2003);
Michel Foucault, The Birth of Biopolitics: Lectures at the College de France 1978–1979, ed. Michel Senellart, trans. Graham Burchell (New York: Palgrave Macmillan, 2008).
7. Jane Bennett, The Enchantment of Modern Life (Princeton: Princeton University Press, 2001).
8. See fs, iwr, pp, and “she.”