১ম পক্ষ:
পৃথিবীর সর্বউত্তরের বিশাল এলাকাকে বলা হয় সুমেরু আর পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুকে ডাকা হয় কুমেরু নামে। কুমেরু আবার অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ নামেও পরিচিত।
তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ওই দুই এলাকার কাজ এখন কিন্তু একই, বরফ গলানো! গবেষকদের ধারনা অনুসারে, বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা ২৫% বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে এই দুই মেরু অঞ্চলের বরফের আশঙ্কাজনক হারে গলে যাওয়া।
এখন, আসল কথায় আসা যাক।
অ্যাটলান্টিক ও আর্কটিক মহাসাগরের মধ্যে উত্তর মেরুর সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা চারটা দেশের মধ্যে একটা হলো বৃহৎ দ্বীপরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ড। জলবায়ুর সাংঘাতিক পরিবর্তনের কারণে এই দেশটির অবস্থা দিন দিন ভয়ঙ্কর হওয়ার পথে চলে যাচ্ছে। যার প্রভাবে পুরো পৃথিবীকে ভুগতে হচ্ছে।
গ্রিনল্যান্ডে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বরফ গলে। কিন্তু ২০২১ সালে মাত্র ২ মাসের মধ্যেই ১১ হাজার টন বরফ গলে গিয়েছে, যা আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। যার ফলে, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে কালসদৃশ বন্যার আঘাত বারংবার আছড়ে পড়ছে; জনজীবন ও প্রাণীকুল বিপন্ন হচ্ছে, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতের দিকে এগিয়ে চলার অবস্থায় পরিণীত হচ্ছে।
তাছাড়া, এই বরফ গুলো শুধু উপরিভাগ থেকে গলে ক্ষান্ত হচ্ছে না, গলে যাওয়ার সাথে সাথে এদের ভেতরের অধিক ঘনত্ব সম্পন্ন বরফের স্তর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে ধরে রেখে মহাকাশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে পৃথিবী আবার উষ্ণ হয়েই চলেছে; এই উষ্ণতার যেন আর শেষ নেই!
এটা বাদেও, পারমাফ্রোস্ট আরেক দুঃশ্চিন্তার কারণ। এটি হলো বরফ-মাটির স্তর যাতে বিভিন্ন ঘাতক জীবাণু কার্যকর অবস্থায় অনেক কাল বেঁচে থাকতে পারে। বরফের ওপরিভাগ গলে যাওয়ায় এসব জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস পরিবেশে বের হয়ে আসার প্রচণ্ড সম্ভবনা রয়েছে। ফলস্বরূপ, বিভিন্ন অজানা রোগের সৃষ্টি হবে, এটা অনায়াসেই বলা যায়। এর উদাহরণও ইতিমধ্যে পৃথিবীর জীবজগৎ অবলোকন করে ফেলেছে, যখন প্রথমবারের মত ১৯৪১ সালে রাশিয়ায় ব্যাসিলাস এনথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়ার আবির্ভাবই বরফ গলার অপকারিতা জানান দেয়। ফলে বুঝাই যাচ্ছে, জলবায়ুর মারাত্মক পরিবর্তন পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলছে যা দিন দিন ‘এই প্রকৃতি আমার না, আপনার না, এমনকি কারোর পক্ষেই না’— এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে মুখ্য করে তুলছে!
২য় পক্ষ:
কুমেরু খ্যাত পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে অবস্থিত যা পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম দুটো স্থানের মধ্যে একটি। তবে এই মহাদেশের এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে গত প্রায় ২ মিলিয়ন বছরেও কোন বৃষ্টি হয় নি! কিন্তু এখানে বরফ গলার সাথে ভূমিকম্পও হয়ে থাকে। ইউনিভার্সিটি অফ চিলি’র গবেষণায় জানা যায়, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে শুধুমাত্র গত ২০২০ সালে ৩০,০০০ বারের ওপর ভুমিকম্প হয়েছে!
অ্যান্টার্কটিকার পূর্ব দিকের প্রায় সব গুলো আইছশিট সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপরে যেখানে পশ্চিম দিকের আইছশিটগুলোর অবস্থা ঠিক উল্টো, কেননা সেখানে বেশির ভাগ বরফ সমুদ্রজলে নিমজ্জিত। ফলে, পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার তুলনায় পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার বরফ গুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার Thwaites Glacier (হিমবাহ) আয়তনে অ্যামেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের সমান যার দ্রুত গলে যাওয়ার কারণে ভবিষ্যতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনাময় দেশ গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, নেদারল্যান্ড এবং অ্যামেরিকার মায়ামি ও নিউইয়র্ক সিটি রয়েছে তালিকার শীর্ষে!
দ্রুত বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে আগামী শতকে পৃথিবীর কয়েকটা বড় চ্যালেঞ্জ গুলোর মধ্যে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বেড়ে উঠা অন্যতম, যেটার ক্ষতিকর আভাস ইতিমধ্যেই মারাত্মকভাবেই লক্ষণীয়। বিশেষ করে, নিম্নাঞ্চল ও সমুদ্রতীরবর্তী দেশ গুলো বছরে কয়েকবার করে বন্যার কবলে পড়ছে, এসব এলাকায় বন্যার জল বেশি দিন স্থায়ী হচ্ছে। ফলে, আপামর জনসাধারণ সহ পুরো জীবজগৎ হুমকির মুখে পড়ছে। আর এজন্যই বরাবরের মত অ্যামেরিকান মেটেরোলজিক্যাল সোসাইটির মতে, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন যদি হাঙর হয়, তবে জল হাঙরের দাঁত’’।
৩য় পক্ষ:
দিন দিন প্রকৃতির নিদারুণ নেতিবাচক প্রভাব যেন কমছেই না, বিশেষ করে নিম্নাঞ্চলের আওতাভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
ওজোন স্তর, বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে বসে থেকে পৃথিবীকে সযতনে আগলে ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটি আজ নিজেই ধীরে ধীরে শঙ্কাময় অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে!
বর্তমানে চাষাবাদের জন্য খ্যাত নাইট্রোজেন ফার্টিলাইজারের দ্বারা ওজোন স্তরের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া, এটা ব্যবহার করা হয় মূলত জ্বালানি থেকে আগুন জ্বালানোর কাজে। এটমিক বিস্ফোরণও ক্ষতিগ্রস্ত করছে আমাদের ওজন স্তরকে। বিশেষজ্ঞদের মতে ১.৫ মেগা টনের নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের ফলে আমাদের ওজন স্তর সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া, এটা ধারণা করা হয় যে একটি স্পেস সাঁটলের নিক্ষেপের ফলে যে পরিমাণ ক্লোরিন এবং অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস আমাদের পরিবেশে মিশে যায় তা এক কোটি টনের বেশি ওজোন গ্যাসকে নষ্ট করতে যথেষ্ট। যদি অনবরত একশটি স্পেস শিফটকে একই সময়ে একের পর এক আকাশে ছাড়া হয়, তাহলে ওজোন স্তরের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না বললেই চলে। (মিঃ OS হতে নেয়া)
দিন দিন ওজোন স্তর ধ্বংসের ফলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীর প্রানিকুল ও উদ্ভিদের ওপর ক্ষতির পরিমানণটাও ভালো মতই ফুটিয়ে তুলেছে। এই রশ্মি মানুষ ও প্রাণীদের দেহে নানা ভাবে ক্ষতি করছে, যেমন ত্বকের ক্যান্সার, চোখের কর্নিয়া ও লেন্সের বিভিন্ন সমস্যা তৈরিতে এটি ওস্তাদ! এছাড়াও এক গবেষণার সুবাদে জানা যায়, অতিবেগুনী রশ্মির ফলে অ্যান্টার্কটিকার পাশের সমুদ্র অঞ্চলে এসব ফাইটোপ্লাঙ্কটনের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ফাইটোপ্লাঙ্কটন আমাদের ৩০% প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণ করার জন্য চুপিসারে কাজ করে।
আর এদিকে, ঐ ক্ষতিকর রশ্মি বায়ুর স্বাভাবিক গুণগত মানকে চরমভাবে হতাশ করছে। যার ফলে তৈরি হচ্ছে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড যা কিনা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী ও গাছপালার ওপর মারাত্মক আঘাত হানছে।
তাই যতদ্রুত সম্ভব, একান্ত ভাবেই আমাদের এমন সব কাজ করা বা পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ যাতে করে ওজোন স্তরের ক্ষতি হওয়াটাকে কিছুটা হলেও লাঘব করা যায় । তাছাড়া, The International Montreal Protocol অনুসারে ওজোন স্তর রক্ষার্থে উল্লেখ্য সকল কাজ করা এবং প্রতি বছেরের ১৬ই সেপ্টেম্বরকে ‘বিশ্ব ওজোন দিবস’ হিসেবে স্মরণে রেখে ওজোন গ্যাসের প্রতি আমাদের ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ রাখি।
৪র্থ পক্ষ:
জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিকম্পের মত একটি বড় ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে জোট বেঁধেছে যার ফলাফল শুধুই ভয়ানকরকম বাজে! এখন অব্দি অন্যান্য কিছু দেশের মতো হাইতি, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, চায়না, নেপাল ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
উত্তর এমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত হাইতি একটা দরিদ্র দেশ যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়টা মারাত্মক পর্যায়ের। এই দেশকে প্রতি বছরই সুনামি, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের আঘাতে জর্জরিত হতে হয়। গত ২০১০ সালের ভূমিকম্পে এই দেশে প্রায় ২ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে এফং অর্থনৈতিকভাবেও অনেক ক্ষতি হয়। তাছাড়া, এই ২০২১ সালের আগস্ট মাসেও কয়েকদফা ভূমিকম্পের উৎপন্ন হয়, রিকটার স্কেলে যার সর্বোচ্চ মান ছিলো ৭.২! ফলে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০০ এর ওপরে মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং অনেক বাড়িঘর, স্কুলসহ রাস্তাঘাট ও অন্যান্য কাঠামো ব্যাপকহারে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
নেপালে ২০১৫ সালের ২৫শে এপ্রিল ঘটে যাওয়া ৮.১ মাত্রার ভূমিকম্প পুরো দুনিয়ার মানুষের মনকে আলোরিত করে ফেলে যদিও এর আগে নেপালে আরো ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ফলে ঐখানে প্রায় ৯০০০ মানুষের প্রাণহানিসহ হাজার হাজার ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে যায়; এমনকি রাস্তাঘাটের অবস্থাও করুণ হয়ে পরে। তাছাড়া, তখনকার সময় মাউন্ট এভারেস্টের কিছু স্থানেও ভূমিধস বা বরফধস ঘটে। এবং নেপালের ঐ ভূমিকম্পের কিছুটা আঁচ কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্থানেও বিশেষভাবে পাওয়া গিয়েছিল।
অন্যদিকে জাপানকেও প্রতি বছর বিশাল সুনামির মুখোমুখি হতে হয় যার প্রধান কারণ ভূমিকম্প। তবে এখন অব্দি ২০১১ সালে ঘটে যাওয়া ৯.০ মাত্রার ভূমিকম্পটা ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী। ফলশ্রুতিতে, আশেপাশের সমুদ্রের জলের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৪০০-৫০০ কিলোমিটার। এখন, বুঝাই যাচ্ছে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল জাপানকে। সেই সময় ১১০০০ মানুষের নিখোঁজ হওয়া সহ প্রায় ৭০০০-এর বেশি মানুষ মারা যায়। তাছাড়া, সুনামির জলে তলিয়ে যাওয়া ফুকুশিমা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেদ্রের ৮টি প্ল্যান্ট এখন চালু থাকলেও বাকিগুলো নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। আর এসব প্ল্যান্ট থেকে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতার সম্মুখীন হওয়ায় জাপান সরকার ইতিমধ্যে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের ওপর কড়া নজর ফেলেছে।
আর এইদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ায় বর্তমানে ভূমিকম্পের হার কি রকম জানি ব্যাপক ভাবে বেড়ে চলেছে! এই দেশটিতে বছরে রেকর্ড করা প্রায় ৫০০০ ভূমিকম্পনের বেশির ভাগই ৪.০ মাত্রার বেশি। এই ২০২১ সালেই কয়েকবার বড় ধরণের ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে ইন্দোনেশিয়ার কিছু এলাকা তছনছ হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৪ই জানুয়ারি, ২০২১, সুলাওয়েসি দ্বীপেই ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প ও এর কারণে সংঘটিত সুনামিতে শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে আর বহু ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়।
তবে অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও ভূমিকম্পের ঝুকিতে ব্যাপকভাবেই রয়েছে যার আভাসও কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পাওয়া যাচ্ছে।
তাই যতদূর সম্ভব, পৃথিবী ও এর পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধম্যে চেষ্টা চালানোটা একান্ত অত্যাবশ্যকীয়। ধরণী বা পৃথিবী হলো মায়ের মত যার আঁচলের ছায়ায় সন্তানেরা পরিপুষ্টভাবে বেড়ে উঠে ও সুন্দর, স্বচ্ছ প্রকৃতিতে বেঁচে থাকে। তাই, পৃথিবী বাঁচলে, প্রাণীকুলও বাঁচবে; এটার কোন বিকল্প নেই। নিচের Karliene’র ‘’Mother Earth’’ গানটা লিরিক্সের সাথে এর বাঁশির সুরটাও যেন তারই কথা বারংবার মনে করিয়ে দেয়।
Link: https://www.youtube.com/watch?v=cPh3Rm9IaJM
৫ম পক্ষ:
যেহেতু জলবায়ুর অপরিমেয় নেতিবাচক পরিবর্তন পৃথিবীকে প্রতিটি মুহূর্তে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাই বিভিন্ন প্রকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিয়ামক বার বার এবং অধিক হারে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানান ভাবে আছড়ে পড়ছে।
আর আগ্নেয়গিরির (volcano) অগ্ন্যুতপাত হচ্ছে বর্তমানে অন্যতম একটি মহাপ্রলয়কারী প্রাকৃতিক দুর্যোগ! আগ্নেয়গিরি (অগ্নি ও গিরি/ পাহাড়) এর সংজ্ঞা বলতে সহজভাবে বলা যায় যে কোন কারণে, হয়তোবা ভূমিকম্পের সংঘটনের সময় মাটির নিচের জমাকৃত গ্যাস, জলীয় বাস্প, গলিত শিলাপাথর, ছাই, বিভিন্ন মূল্যবান ধতব পদার্থ প্রভৃতি যখন কোন ফাটল বা ছিদ্র দিয়ে মাটির ওপরে চলে আসে, তখন ওসব ওই ছিদ্রের চারদিকে জমা হয়ে একধরনের মোচাকৃতি পাহাড়ের মত তৈরি করে, যা শেষ অব্দি আগ্নেয়গিরি নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে এখানে মাটির গভীরের বিভিন্ন দ্রব্যাদি লাভা (lava) নামে খ্যাত।
কিন্তু আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লালাভাবের লাভা যখন ভূগর্ভের তলা থেকে বাইরের পরিবেশ বা মাটির ওপরিভাগে চলে আসে এবং ঠিক তখনই দেখতে আমার দারুণ লাগে। বরাবরই মনে হয় যেন লাভাকে একটু ধরে ও একটু খেয়ে দেখি কেমন স্বাদ! হা হা!
তবে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো যতই দেখতে সুন্দর হোক না কেন, মাঝে মধ্যে এর মাধ্যমে সৃষ্ট নিদারুন ক্ষতিকর পরিস্থিতি মানবকুল, প্রানিকুলের জন্য মারাত্মক কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেমন, আগ্নেয়গিরি, যার দরুন জলোচ্ছ্বাস (সুনামি), বন্যা, পাহাড়ধস এমনকি স্বাভাবিক বায়ু ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সাথে বেঁচে থাকার জন্য সুপেয় পানীয় জলের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয়।
আগ্নেয়গিরি প্রতিবছর কোথাও না কোথাও বিস্ফোরিত হয়। তবে এর ভয়ালরুপ দেখার জন্য বেশি দূর না গিয়ে সম্প্রতি ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের কথা উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হবে, যেই সময়ে টোঙ্গা (Tonga) নামের দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের একটি আগ্নেয়গিরিতে বিশাল অগ্ন্যুতপাতের ফলে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
টোঙ্গা প্রায় ১৭০ টি ছোটো-বড়ো দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দেশ যাকে পৃথিবীর মানচিত্রের মাধ্যমে দেখলে মনে হয় যেন কয়েকটা গোলাকার, অর্ধচন্দ্রাকার বিন্দু প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরিপৃষ্ঠে লেপটে রয়েছে। এখানকার শুধুমাত্র ৩৬টি দ্বীপ মানুষের বসবাসযোগ্য বলে এখানে মাত্র এক লাখ লোকের বসবাস রয়েছে যেখানে বিভিন্ন প্রকার ফসলের ফলন ঘটানো হয়। যেমন, কলা, নারকেল, টমেটো, তরমুজ, অ্যাপেল, ব্রেডফ্রুট (বলা যায়, আমাদের দেশের কাঁঠালের ছোট ভাই; হা হা), আম, পেয়ারা, কমলা ইত্যাদি ফসল গুলো টোঙ্গাতে বেশ ভালো ভাবেই উৎপন্ন হয়।
যাইহোক, গত ১৫ই জানুয়ারি, ২০২২, টোঙ্গা-এর রাজধানী নুকু’আলফা (Nuku’alofa) থেকে প্রায় ৬৫ কিমি দূরে অবস্থানরত একটি দ্বীপে হুঙ্গা টোঙ্গা–হুঙ্গা হাপাই (Hunga Tonga–Hunga Haʻapai ) নামক আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়। টোঙ্গা জিওলজিক্যাল সার্ভিসেস-এর তথ্য মোতাবেক, আগ্নেয়গিরি থেকে গ্যাস, ধোঁয়া ও ছাই আকাশের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায় এবং যার রেশ রাজধানীতেও এসে পড়ে। তাছাড়া, এ অগ্ন্যুৎপাতের ফলে হিহিফো (Hihifo) নামক উপদ্বীপের হা’তাফু (Ha’atafu) বিচ রিসোর্টটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
তবে সবচেয়ে বেশি যেটা ভয়ংকর ছিল তা হলো অগ্ন্যুতপাতের পরক্ষণেই বিশাল সুনামির শুরু হওয়া। ফলে, টোঙ্গা-এর প্রায় ৮০ হাজারের মত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং ওই পরিস্থিতিতে আগ্নেয়গিরির আশেপাশের এলাকাগুলোতে অন্যান্য জরুরি জিনিসপত্রের পাশাপাশি বিশেষ করে পানীয় জল, ওষুধ ও মাস্কের অভাব দেখা যায়। তবে বলে রাখা ভালো, এই টোঙ্গা দেশে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ তেমন ছিল না বললেই চলে। তাই, যখন অন্যান্য দেশ টোঙ্গার ওই জরুরি ও বিপদের সময় সাহায্য করতে আসছিল বা চাচ্ছিল, তখন তারা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পরই কেবল টোঙ্গা দেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল।
আগ্নেয়গিরির ফলে উৎপন্ন সুনামির এমন ভয়াবহতা শেষ পর্যন্ত আশেপাশের দেশ ফিজি, সামোয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড হয়ে জাপান, আমেরিকার সান-ফ্রান্সিস্কোতে ছড়িয়ে পড়ে। এবং এমনকি ১০ ঘণ্টা পরেও এই সুনামির তীব্রতা ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী চেন্নাই সমুদ্রসৈকতে উপলব্দি হয় যেখানে যদিও এর তীব্রতা টোঙ্গা থেকে অনেক কম ছিল।
আর তাছাড়া, এই সুনামির কারণে প্রশান্ত মহাসাগরের নিচের ইনটারনেট ও অন্যান্য ক্যাবলের বিছিন্নতা ঘটে যা টোঙ্গার সাথে সারা দুনিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপনাআপনি ভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। এই শতাব্দীর মধ্যে ঘটে যাওয়া অগ্ন্যুৎপাতের মধ্যে ১৫ই জানুয়ারি, ২০২২-এর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময়টা ছিল টোঙ্গা-এর জন্য এক বিধ্বংসী অভিশপ্ত কাল যার প্রভাব হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে থাকা মানুষগুলোও কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছিল।
লেখকঃ কণাদ সরকার