জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ভোগান্তি এখন আর বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে আটকে নেই, মানুষের প্রতিদিনকার বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। হারিয়ে ফেলা ঋতুবৈচিত্র্যের প্রকৃতি, অস্বাভাবিক শীত গরমের অনুভূতি, ঝড়বাদলের খামখেয়ালী অবস্থিতিসহ যাপিত অনুষঙ্গের প্রায় সবকিছুতেই এই পরিবর্তনের প্রতিকুলতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে মানুষকে। এরইমধ্যে প্রভাববিস্তারী সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন জানিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে অর্থাৎ আগামী ৩০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের ৩ ভাগের ১ ভাগ অঞ্চল পানির তলে তলিয়ে যাওয়ায় দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবন জীবিকা হুমকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এ তথ্য বিস্ময়কর রকমের ভয়াবহ, যেহেতু এতদিন এ ঘটনা এই শতকের মধ্যে ঘটবে বলা হয়েছিল। এ তথ্যের মানে দাঁড়াচ্ছে, বিপদের ভবিষ্যদ্বাণী তার সময়কে আরও নিকটে নিয়ে এসেছে, বাংলাদেশের নিয়তিকে নাকের ডগায় নিয়ে এসেছে। পরিবেশ ও জলবায়ু বিজ্ঞানীদের ধারণামতে, এই শতাব্দী, অর্থাৎ ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বাড়বে। কিন্তু তাদেরকেই এখন বলতে হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যেই এই একই পরিমাণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। একইসাথে, এতদিন একারণে বিশ্বের ২৫ কোটি মানুষ বিপদে পড়বে বলা হলেও এখন বলা হচ্ছে, বিপদে পড়া মানুষের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে দাঁড়াবে!
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের এতবড় অঞ্চল পানির তলে তলিয়ে যাবার কারণ হিসেবে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে- যে দায়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ভূমিকা রাখছে, এবং এ উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভারসাম্যহীন কার্বন নিঃসরণ কারণ হিসেবে কাজ করছে। এ ঘটনার ফলে স্বাদুপানির নদীগুলো সাগরের নোনাজলে ভরে যাবে, মৎস্য ও কৃষিসম্পসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবন জীবিকা ঝুঁকিতে পড়বে। নোনাজলে চরাচর তলিয়ে যাওয়ায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এবং কৃষি বিপন্ন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কথা হচ্ছে, অভাবিত এই বাস্তবতা মোকাবেলায় উন্নয়নের বিস্ময় বাংলাদেশ সরকার কী করছে? এইত কিছুদিন আগেই সংশ্লিষ্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ভয়াবহ এক দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে ১০ কোটি টাকার সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণে ৪৬ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এবং দুর্নীতির এ ঘটনা এটাই প্রথম নয়, বরং এই মন্ত্রণালয় তার প্রতিষ্ঠাপর্ব থেকে এ কাজেই দক্ষতা দেখিয়ে আসছে। প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত ৩ হাজার কোটি টাকার জলবায়ু তহবিল অনায়াসে গিলে খাওয়ার পর এর উদর এতটাই বড় হয়েছে যে, প্রতিবছর বাজেট থেকে বিপুল সংখ্যক টাকা এদের খিদে মেটানোর কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। যেজন্যে এত এত টাকাপয়সা ঢালার পরেও গত এক যুগে পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশের ৫৪ ধাপ অবনতি হয়েছে। অবশ্য যা হবার তাই হয়েছে্ এবং হচ্ছে। আদি মানুষের বর্বর বাস্তবে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল যে উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ চোরের ধন পাহারা দেয়ার প্রয়াসে- রাষ্ট্র প্রকল্পের সেই কনসেপ্টই এখন পর্যন্ত কায়েম হচ্ছে ত্রিশ লাখ শহিদী আত্মার আরাধ্য বাংলাদেশে।
গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স মতে, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, যেখানকার ৩ ভাগের ১ ভাগ মানুষের জীবন জীবিকা ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থাৎ তারা উদ্বাস্তু হবার ঝুঁকিতে আছে। যদিও এরইমধ্যে বাংলাদেশ উদ্বাস্তু গ্রহণে শীর্ষ দশে স্থান নিয়েছে; মিয়ানমারের ১৫ লাখ মানুষকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। এরপর আবার ইন্ডিয়া নামক প্রতিবেশ বন্ধুদেশ নাকি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিবেচনায় সেখানকার ১৭টি রাজ্য থেকে কমছেকম ২ কোটি মানুষকে ফেরত পাঠানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইউরোপে এবং আমেরিকায় থাকা অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর তোরজোড় চলছে। মালয়েশিয়া ধরপাকড় শুরু করেছে। সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অটোমেশনের দিকে চলে যাচ্ছে, সেখানে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছে। এ অবস্থায় শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক বেকারত্ব নিয়ে বাংলাদেশ নিকট নিয়তির চাপকে কীভাবে সামাল দেবে এটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। যদিও সরকার এসমস্ত বাস্তবতা অস্বীকারের মাধ্যমে এগুলোকে অস্তিত্বহীন প্রমাণে সবসময় আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখিয়ে আসছে। এবং এজন্যই তারা ৫ কোটি শ্রমিচ্ছু বেকারকে ২৫ লাখ ৮৭ হাজারের পরিসংখ্যানে বেঁধে দিয়ে প্রশান্তির ঢেকুর তুলতে পারছে। অন্যসব খাতের মতো জীবন মরণের জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রচেষ্টা নিয়েও জোচ্চুরি খেলে চলেছে !
মুক্তিফোরামের পক্ষে সম্পাদকীয়টি লিখেছেন চারু হক