প্রথমেই যে প্রশ্নটা আসে তা হলো কি এই বুদ্ধিজীবীতা?! Intellectualism বা বুদ্ধিজীবীতা হলো এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। শেখা ও যৌক্তিক চিন্তাভাবনা সংক্রান্ত দার্শনিক অবস্থা। এখন কথা হচ্ছে এই ব্যপারটা অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীতার চর্চা আদপে বাংলাদেশের ক’জন বুদ্ধিজীবী বর্তমানে করেন? যাদের বুদ্ধিজীবী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে এদেশে (বর্তমানকালের) তারা কি সত্যিই বুদ্ধিজীবী নাকি নিছক বিশেষ এক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত বুদ্ধিবিক্রেতা? বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোন মঙ্গলার্থে কি এরা কোন অবদান রাখছে? একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাদের দায়িত্ব তারা পালন করছে কি?
আচ্ছা, এতো প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে বুদ্ধিজীবীর সার্বজনীন সংজ্ঞাটা জানা দরকার। ” An Intellectual is a person who uses his or her intellect to work, study, reflect, speculate on or ask and answer questions with regard to variety of different ideas.” – from the preface of “Representations of the Intellectual” এখন আসা যাক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ও দ্বায়িত্বের ব্যপারে। অধ্যাপক এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদের মতে একজন বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা হচ্ছে, “ক্ষমতার প্রতি সত্য ভাষণ ( Speaking Truth to Power)” তাঁর এই উক্তিটি বর্তমান বাংলাদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের জানা আছে কিনা জানিনা। কিংবা জানা থাকলেও এর প্রয়োগ দেখা যায় না। ৯৮% ব্যক্তিবিশেষ যারা বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিহ্নিত এদেশে তাদের কারো মধ্যে না এই উক্তির প্রতিফলন দেখা যায় আর না খুঁজে পাওয়া যায় বুদ্ধিজীবীর সার্বজনীন সংজ্ঞার ছিটেফোঁটা! অথচ তাঁরা বুদ্ধিজীবী!
Noam Chomsky এর মতে, একজন বুদ্ধিজীবীকে অনিবার্যভাবে ভুল ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আর আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাবলে দেখা যায় আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর ভুল ব্যাখ্যার সাথে সহমত পোষণ করছেন, বিরুদ্ধে দাড়াঁনো তো দূরের কথা, তারা উল্টো সেই ভুল ব্যাখ্যাগুলোকেই আরো শক্তিশালী করে উস্কে দিচ্ছেন। এতে করে জাতি হিসেবে আমরা যে ক্রমেই অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছি তা চিন্তা করার অবকাশও আমাদের নেই! এই বুদ্ধিজীবীদের প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তাঁদের ইমেজ। এমন একটা পজিটিভ ইমেজ এরা তৈরি করেছে যাতে জনগণ বিনা বাক্যব্যয়ে এদের কথা বিশ্বাস করে। আর ক্ষমতাশালীরা এটাকেই ব্যবহার করছে। ফ্যাসিজম এর এই একটা বেশ সূক্ষ্ম চাল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মডিফাই করে ঢাল বানিয়ে ফ্যাসিস্টদের ভালোই লাভ হয়েছে। কারণ, মানুষ এই টোপটা অকপটে গিলেছে। এদিকে যে ইতিহাসের বারোটা বাজিয়ে ফেলা হয়েছে তা কেউ টের পাচ্ছে না। অন্ধ অনুসরণ করে চলেছে এক-একটা দলের। এতে আখেরে ক্ষতিটা হচ্ছে দেশের,সর্বসাধারণ এর। অথচ বুদ্ধিজীবীদের এই ক্ষেত্রে একটা মস্ত দ্বায়িত্ব আছে।
“আদর্শ শ্রেণীস্বার্থ এবং বর্তমান ইতিহাসের অখণ্ড সত্যকে প্রকাশ করতে হবে।”- নোয়াম চমস্কি। আদর্শ,শ্রেণীস্বার্থ যে কি তা বোধহয় এনারা ভুলেই গেছেন। আর ইতিহাসের অখণ্ড সত্যকে প্রকাশ করলে যদি ক্ষমতা হাত থেকে ফসকে যায়,কালো টাকায় পকেট ভর্তি না হয় ইত্যাদি আশঙ্কায় তারা সত্য প্রকাশে বিরত। অথচ ” The intellectuals role generally is to uncover and elucidate the content, to challenge and defeat both an imposed silence and the normalized quiet of unseen power. Where ever and whenever possible. For overbearing collective interests and the discourse used to justify,disguise or mystify its working while at the same time preventives objections or challenge to it.” – Edward W. Said.
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবথেকে অগ্রণী এবং কার্যকর ভূমিকা হতে পারতো একজন বুদ্ধিজীবীর। তাদের সমালোচনা, ভুলগুলো চিহ্নিত করা,উদ্ভুত সমস্যার নিরপেক্ষ সমাধানের পথ তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারতো। কারণ, আমরা যাদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে জানি তাঁরা অধ্যাপনা, শিক্ষকতা,চিকিৎসাসেবা,আইনচর্চা কিংবা সাংবাদিকতার মতো পেশায় নিয়োজিত এবং সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। অথবা খুবই প্রিয়ভাজন যারা বই লেখা কিংবা শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত। দুঃখজনক এই যে প্রায় সকলেই হয় হাত গুটিয়ে ফেলেছেন নয় ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কথা বলছে যৌক্তিকতা বিচার ছাড়াই। যেখানে ” বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে তথাকথিত চালচলন এবং খন্ডিত বিষয়গুলোর সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙে ফেলা। কেননা এগুলো মানুষের চিন্তাভাবনা এবং যোগাযোগের সামর্থকে সীমিত করে ফেলে”- এডওয়ার্ড সাইদ।
বাংলাদেশের শিক্ষার হার বাড়ছে তবে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার হার উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে এই কারণেই যে আমাদের সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বজায় আছে। আমরা ভাবতে শিখছি না বা শেখাচ্ছি না যে যেকোন বিষয়ে যৌক্তিক চিন্তাভাবনা করতে হয়, শেখার বা জানার আগ্রহ কমে গেছে এবং আরো কমছে। আমরা শুধু কিছু বিবেকহীন, মানবতাবিবর্জিত কিছু পাঠ্যপুস্তকের মুখস্থবিদ্যা নির্ভর অসম্ভব স্বার্থপর যন্ত্রমানব তৈরি করছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গঠনশৈলীই ওই বুদ্ধিজীবীরা এমন করে ফেলেছে। এরা জনগণের মঙ্গলার্থে তো কিছু করেই না বরং অমঙ্গল করছে দিনকে দিন।
করণীয় হচ্ছে নিজের মানসিকতা পাল্টে ফেলা। মানুষ হওয়া এবং মানুষের মধ্যে মানবিকতাবোধ জাগ্রত করা। কারণ সমাজ আমাদের আর এই সমাজব্যাবস্থার ধসে পড়ায় আমরাও দায়ী। নিজের ঘর ধসে গেলে নিজেরই তো গড়তে হয়,আমাদেরও তাই করতে হবে। পরিবর্তন একদিনে আসে না। একটা প্রজন্মকে ঠিক ছাঁচে গড়ে দিতে পাড়লে বাকিটা আপনাতেই ঠিক হবে। কারণ আজকের চারা গাছটাই আগামী দিনে মহীরুহ হবে।
মুক্তিফোরামের পক্ষে সম্পাদকীয়টি লেখেন, ইরাবতী চৌধুরী ।