“রিফাত আমাকে এলোপাথাড়ি পেটাতে শুরু করে। তাকে জানাই যে আমি দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী। মাস দুয়েক আগে আমার বাম চোখে বড় অপারেশন হয়েছে। এসব শোনার পর রিফাত আমার চোখে ঘুষি মারে।”
হামলার শিকার শুক্কুর চবির দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, যার অপরাধ ছিল রিফাতের গায়ে দুর্ঘটনাবশত ধাক্কা দেয়া।
‘আমি রিফাতকে সরি বলেছি। বলেছি, যা ঘটেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। গায়ে ধাক্কা লেগেছে কারণ আমি চোখে দেখি না’।
ছাত্র সন্ত্রাসী দল ছাত্রলীগ প্রায় দশ বছর জুড়ে একচেটিয়া ভাবে বাংলদেশের ক্যাম্পাসগুলোকে শোষণ করে চলেছে, যার স্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠছিলো বিগত অক্টোবরে বেরিয়ে আসা শত শত নিপীড়ণের বর্ণনায়। বেশিভাগ সময়ে এইসব নিপীড়ন চালানো হয় সেসব ছাত্রদের/ছাত্রীদের ওপর যারা কোথাও সরকার বিরোধী মত প্রকাশ করেছে। যেকোনো স্বৈরাচারী সরকারই ভীন্নমতের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক ভাবেই কঠোর অবস্থান নিবে। জনমত নয়, শক্তিই একজন স্বৈরাচারী সরকারের সম্বল।
সত্তুরের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে স্ট্যানফোর্ড প্রিসন এক্সপেরিমেন্ট নামে কুখ্যাত একটি সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট করা হয়। এই এক্সপেরিমেন্টটিতে চব্বিশজন সাধারণ যুবককে বাছাই করা হয়, যাদের কোনো মানসিক রোগ অথবা অপরাধমূলক প্রবণতা ছিল না। এই যুবকদেরকে লটারী অনুযায়ী দুটি দলে ভাগ করা হয়: কয়েদী এবং পাহারাদার। ছয় দিনের এই এক্সপেরিমেন্টে দেখা যায় যে যাদের শুধুমাত্র লটারী অনুযায়ী পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়েছিল তারা দৃশ্যমান ভাবে আক্রমণাত্মক ব্যবহার করছে, এবং যাদেরকে কয়েদী নিযুক্ত করা হয়েছিল তারা শোষণ মেনে নিচ্ছে। তারা প্রথমে প্রতিবাদ করলেও কিছুটা সাজা পেয়ে মাথা নিচু করে সব শোষণ মেনে নিচ্ছিলো, যেন এটাই তাদের প্রাপ্য।
এই এক্সপেরিমেন্টটি কুখ্যাত এইজন্য because it implies under the right circumstances any of us will become monstrous. এই এক্সপেরিমেনটির কনক্লুশনটি ভয়াবহ, আর এর মানে হচ্ছে শুধুমাত্র পরিবেশের কারণে আমরা মানবতা হারিয়ে ফেলি, অন্যের মানবতা ভুলে যাই।
এই ভয়াবহ কনক্লুশনটির সত্যতা আরো কয়েকটি এক্সপেরিমেন্টে উঠে আসে। এই ঘটনার সত্যতা পৃথিবীর অনেক সন্ত্রাসী অথবা মিলিটারী সংস্থার দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পারি। অনেক ধর্মীয় টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন সম্পূর্ণ সাধারণ কিশোর কিশোরীকে নিয়ে তাদের এমন ভাবে পরিবর্তন করে যে তারা পাশবিক সব কার করে নির্দ্বিধায়। অনেক রাজনৈতিক সংস্থাও তাই করে।
আবরারের হত্যাকারী অনিক সরকার জবানবন্দিতে বলেন যে নটরডেম থেকে তিনি যখন বুয়েটে আসেন, তিনি হাসি খুশি ছিলেন, এরকম ছিলেন না। তিনি বর্ণনা দেন কিভাবে আবরারকে এলোপাথাড়ি ভাবে মেরেছেন। তিনি বলেন যে এভাবে মারার জন্য উপর থেকে নির্দেশ ছিল, তিনি অমান্য করার কে?
একটি ধর্মীয় এক্সট্রিমিস্ট দল যেভাবে সন্ত্রাসী তৈরী করে, আমাদের সরকার ঠিক একই পদ্ধতিতে সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে পাশবিক নৃশংস দানব তৈরী করছে বছরের পর বছর। একজন সুস্থ মানুষ কিভাবে একজন দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী সহপাঠীকে ধাক্কা দেয়ার অপরাধে এলোপাথাড়ি মারতে পারে? সে মারতে পারে কারণ সেই প্রিসন এক্সপেরিমেন্টের পাহারাদারদের মতো সে তার অবস্থানকে পুরোপুরি ধারণ করে নিয়েছে। সে মারতে পারে কারণ তাকে ধাক্কা দেয়ার সাহস একজন সাধারণ ছাত্রের হয় কিভাবে, হোক না হয় সে দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী?
এখন বিবেচনার বিষয় এটাই যে আমরা কি আদৌ আমাদের কয়েদীর বেশ পূর্ণ ভাবে ধারণ করে নিয়েছি, নাকি প্রতিবাদের শক্তি এখনো কিছু বাকি আছে? এভাবে আর কতদিন?
মুক্তিফোরামের পক্ষে এই সম্পাদকীয়টি রচনা করেছেন তনিমা