কিয়ানু রিভস-এর ম্যাট্রিক্স মুভিতে একটি আইকনিক দৃশ্যে দেখা যায় তার মেন্টর (গুরু) লরেন্স ফিশবার্ন তাকে একটি চয়েস অফার করেন – একটি লাল পিল এবং একটি নীল পিল। নীল পিলটি বেছে নিলে রিভস এর চরিত্র নিও তার স্বাভাবিক, সচ্ছল, আরামদায়ক জীবনে ফেরত যেতে পারবে, আর লাল পিলটি নিলে সে কিছু কঠিন বাস্তবতা জানতে পারবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ফারজানা ইসলামের কার্যালয় ৮৪ লক্ষ টাকায় সাজানো হয়েছে। ডেইলী ষ্টার-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এই টাকাটি ব্যয় করার কথা ছিল শিক্ষার্থীদের কল্যানে। রিপোর্টটিতে আরো উল্ল্যেখ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর কর্তৃপক্ষ জানায় যে ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনকে (ইউজিসি) এই ফান্ডিং-এর সূত্র, অথচ ইউজিসির সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায় যে কারো কার্যালয় সাজানোর জন্যে তারা ফান্ডিং বরাদ্ধ করেনি। সংবাদের পাতায় যারা চোখ রাখেন তারা জেনে থাকবেন যে প্রায় এক মাস আগে এই উপাচার্যের বাড়ীর সামনে লাগামহীন দুর্নীতির প্রতিবাদে আন্দোলন করেন জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকরা। তার নামে অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রকল্পগুলো থেকে মোটা অংকের টাকা ছাত্রলীগের কাছে পাচার করে দেয়ার, এবং এই আন্দোলনের মাঝে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ চালায়। এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র।
আরো কিছুদিন আগের কথা চিন্তা করলে আবরার ফাহাদ-এর কথা মনে পরতে পারে। কিন্তু বাকস্বাধীনতা তো শুধু আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের ভয়েই বিসর্জন দেইনি, সেটা দেশজুড়েই হারিয়েছি। ঢাকা এখন পৃথীবির সবচেয়ে দূষীত নগরী। যে শহরে কুয়াশাও সচরাচর দেখা যায় না, সে শহর এখন স্মগে আচ্ছন্ন। অথচ এই ব্যাপারে আঙ্গুল তুলে কর্তৃপক্ষকে দোষ দেয়ার সাহস কারো নেই।
গুটিকয়েক মানুষ সাহসী হয়ে স্বীকার করবেন যে ক্ষমতা যার, পরিবর্তন আনার বোঝাটাও তার, আর ক্ষমতার অপব্যবহার করার দায়ও তার। অনেকে এ ব্যাপারে ইন্টেলেক্চুয়ালি ডিসনেস্ট ভাবে ক্ষমতাবানদের দায়টি মিটিয়ে দিতে চেষ্টা করবে: দেশ পরিষ্কার রাখার দায় প্রত্যেকটি নাগরিকের। কিন্তু এক দল হয়ে বায়ু দূষণ রোধ করা নাগরিকদের দ্বায়ীত্ব না, এবং এরকম সংগঠিত শক্তি নাগরিকদের কাছে আশাও করা যায় না – একটা দেশ বসবাসযোগ্য রাখার দায় সরকারের, যেমন প্রধান খাদ্যগুলোর দাম জনগণের নাগালের মধ্যে রাখার দায় সরকারের। জনগণের দায় দেশের এবং নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে সরকার নির্বাচন করা, কিন্তু যেখানে স্বার্থ আলোচনা করলেও গুম হয়ে যাবার ভয় থাকে, এবং নির্বাচন এমনই প্রহসন যে জার্মানীর মতো গম্ভীর জাতীর রাষ্ট্রদূতও সেটা নিয়ে হাসে, সেখানে ক্ষমতাহীন সাধারণ নাগরিক আর কার কার অযোগ্যতা ও দুর্নীতির দায় নেবে?
আসলে এসব একজন ক্ষমতাহীন বাংলাদেশী নাগরিকের কঠিন বাস্তবতা। নিজেদের ক্ষমতাহীনতা ও দুরবস্থার চিন্তা করলে বিষন্নতায় তলিয়ে যেতে হয়। এর থেকে ভালো জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবীদের মধুর মধুর কথা শোনা। দেশ গোল্লায় যাচ্ছে? দোষটা সরকারের না, আপনি, জ্বী, ভোট বঞ্চিত, বাকস্বাধীনতাবিহীন, স্মগে আচ্ছন্ন, মশারীর ভেতরে বসে থাকা আপনিই দেশের প্রতি নিজের দ্বায়ীত্ব অবহেলা করছেন। এখন নিন এই নীল পিলটি খেয়ে পাঁচবার বলুন “আমাদের জিডিপি এইট পার্সেন্ট”।
মুক্তিফোরামের পক্ষে এই সম্পাদকীয়টি রচনা করেছেন তনিমা