গত বুধবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করে শুনানী হয় হাউসে, যেখানে বিপক্ষ রাজনৈতিক দল ডেমোক্রাটরা প্রায় সর্বসম্মত ভাবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। হাউসে ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছে, এখন শুনানিটি এগুবে সিনেটের সামনে। সিনেট ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানদের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ট, তাই সিনেট ট্রাম্পের পক্ষে রায় দিতে পারে – বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সেটাই আশংকা করছেন।

কিন্তু আমি যেই আলোচনাটা করতে চাচ্ছি সেটা ট্রাম্পকে নিয়ে নয়। সেটি একজন ডেমোক্রেটিক রিপ্রেসেন্টেটিভ তুলসি গাবার্ডকে নিয়ে। তিনি ট্রাম্পের শুনানিতে পক্ষে অথবা বিপক্ষে ভোট দেননি, তিনি শুধুমাত্র ‘উপস্থিত’ ভোট কাস্ট করেছেন। তিনি ২০২০-সালে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনের জন্যে ডেমোক্রেটিক মনোনয়নের জন্যে লড়ছেন। তিনি ট্রাম্পের মতো এতটা বর্ণবাদী, নৈতিক ভাবে দেউলিয়া প্রেসিডেন্টকে অভিযুক্ত করার পক্ষে ভোট দেয়া থেকে পিছপা হবেন কেন ? তুলসী গাবার্ড-এর এই পদক্ষেপটি বোঝার জন্য দেশে এবং বিদেশে থাকা (আপাতদৃষ্টিতে) বামপন্থী বাদামী চামড়ার মানুষের কিছু হিপোক্রিসি আমাদের বোঝা উচিত।

এই দশকে (২০১০-২০২০) সাদা চামড়ার মানুষের ‘হোয়াইট ফেমিনিজম’ নিয়ে কঠোর সমালোচনা হয় পশ্চিমা লিবারেল সার্কেলগুলোতে। সমালোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে যে নারী-অধীকার মানবাধীকারেরই একটি অংশ, কিন্তু অতীতের অনেক নারী অধীকার সংগ্রামগুলো শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। একটা মানবাধীকারের আন্দোলন বর্ণবাদী হওয়াটা ironic এবং একটি অন্যায়। ধরুন “নারীদের অধিকার বঞ্চিত করা ভুল, প্রত্যেকটি নাগরিককে সমান অধিকার দেয়া উচিত” এটা যদি একটি আন্দোলনের প্রেমিস হয়, তাহলে সেই প্রেমিসের যৌক্তিক সম্প্রসারণের মধ্যে “কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অধিকার বঞ্চিত করা ভুল, প্রত্যেকটি নাগরিককে সমান অধিকার দেয়া উচিত” পরে। যদি প্রথম আন্দোলনটি দ্বিতীয় আন্দোলনকে উপেক্ষা করে যায়, যদি নারী-অধিকারের লড়াই বর্ণবাদী হয়, তাহলে আন্দোলনটি সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার সমর্থন করছে না, এবং প্রেমিসটি সোজা কথায় একধরণের ভন্ডামী।

অনেক ফেমিনিস্ট আন্দোলনকারী ব্যাপারটি ধরতে পেরেছেন, এবং ‘হোয়াইট ফেমিনিজম’-এর বিরুদ্ধে কঠোর লড়াই করে যাচ্ছেন। কিন্তু ‘হোয়াইট ফেমিনিজম’ বাস্তবেরই একটি অংশ, এবং এটির একটি কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ ছিল ২০১৬-এর প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে, যেখানে বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ নারী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্যে ভোট দেন। এতটা বর্ণবাদী এবং নারীবিদ্বেষী একজন লোককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তারা কিভাবে গ্রহণ করতে পারেন ? এর কারণ হিসেবে অনেকে বিশ্লেষণ দিয়েছেন যে নারীবিদ্বেষী হলেও ট্রাম্প শ্বেতবর্ণের আধিপত্য আকারে ইঙ্গিতে সমর্থন করেন, এবং অনেক শ্বেতবর্ণ নারীর কাছে শুধুমাত্র বর্ণের সাথে যেসব সুযোগ সুবিধা আসে সেটাই যথেষ্ট।

তুলসী গাবার্ড শ্বেতাঙ্গ নন, তিনি বাদামী চামড়ার। তার এই আকস্মিক ট্রাম্প-প্রীতি ‘হোয়াইট ফেমিনিজম’ নয়, কিন্তু ‘হোয়াইট ফেমিনিজম’ – সংলগ্ন হিপোক্রিসি, যেটা প্রবাসী বাদামী বর্ণের মানুষের মধ্যে দেখা যায়। তুলসী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট করেননি, কারণ তিনি ট্রাম্পকে নিয়ে বিব্রত, কিন্তু শ্বেতাঙ্গ ডানপন্থী ভোটারদের আকর্ষণ করতে চান। তার একটি নীতিগত দ্বায়িত্ব ছিল, এবং একটি রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের পথ ছিল, এবং তিনি তার দ্বয়িত্ব উপেক্ষা করে সুবিধা নিয়েছেন, ঠিক যেভাবে শ্বেতাঙ্গ নারীরা নিজের এবং অন্যের নীতিগত দাবী বিসর্জন দিয়ে বর্ণের ওপর নির্ভরশীল সুবিধা বিদ্যমান রাখার জন্যে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু গাবার্ড নিজেকে একজন বামপন্থী এবং নারীবাদী দাবী করেন।

বাদামী চামড়ার মানুষের এই ধরণের হিপোক্রিসির আরেকটি উদাহরণ দেই | প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নিজেকে একজন নারীবাদী দাবী করেন। তিনি একজন গুডউইল এম্বাসেডর, তিনি UNICEF-এর সাথে কাজ করেছেন। গাবার্ডর মতো তিনি আমেরিকার নাগরিক নন, কিন্তু এখন তিনি আমেরিকায়, বিশেষ করে হলিউডে জীবনযাপন করেন, এবং তিনি হলিউডের বর্ণবাদ নিয়ে সোচ্চার। মানবাধিকার নিয়ে এতো কাজ করেও তিনি মোদী-ঘেঁষা। তিনি মোদিকে তার ব্যক্তিগত জীবনে স্থান দিয়ে, যেমন তার বিয়েতে আমন্ত্রণ করে, নিজের তারকা অবস্থান ব্যবহার করে হরহামেশা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। গত আগস্টে যখন কাশ্মীরের কারণে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কাও করা হচ্ছিলো, এই মানবাধিকার কর্মী কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে উৎসাহ দেননি, বরং ‘জয় হিন্দ’ বলে উস্কে দিয়েছেন। মোদির মতো একজন উগ্রবাদীর সমর্থক পশ্চিমে গিয়ে নিজেকে বামপন্থী পরিচয় দেন কেন? কারণ তিনি পশ্চিমে বর্ণবাদের কারণে ভুগছেন, সেখানে তিনি সমতা চান, সেখানকার বামপন্থীদের সমর্থন চান। কিন্তু নিজ দেশে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থানে সরাসরি প্রচুর সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন, তাই এখানে তিনি তার নৈতিক দ্বায়িত্বটি বিসর্জন দিচ্ছেন, একজন মৌলবাদীর সাথে হাত মেলাচ্ছেন।

এতক্ষন ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত নিয়ে এতো কথা বলার কারণ কি? ভারতীয় জ্ঞানপাপী এমন হিপোক্রিটের মতো বাঙালী শিক্ষিত প্রবাসী অনেক হিপোক্রিট আছেন, যারা দিনের পর দিন একটি বাকস্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া একনায়কতন্ত্রের সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন, যদিও অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের নারীবাদী এবং বামপন্থী দাবী করেন। যেখানে গণতন্ত্র নেই, সেখানে সরকার যা চায় সেটাই আইন হয়ে যেতে পারে। এমন লাগামহীন ক্ষমতার কারণেই আজ বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতার মতো মৌলিক মানবাধিকারটিও নেই। এর ফলে একজন ছাত্র সরাসরি সরকার কেন, শুধু ভারতের সাথে করা সরকারের চুক্তি নিয়ে সমালোচনা করলেও বর্বর ভাবে খুন হয়ে যায়।

“আমাদের অবস্থা নর্থ কোরিয়া থেকে ভালো” – এমন অজুহাতও কেউ কেউ দিয়ে থাকে। নর্থ কোরিয়া পর্যন্ত যাওয়ার পরে হয়তো প্রতিবাদ করার আর সময় থাকবে না, হয়তো এখনই নেই। কিন্তু নিজেকে বামপন্থী/নারীবাদী দাবী করে যারা নিয়মিত গুম/খুন করা একনায়কতন্ত্র সমর্থন করেন, তাদের সাথে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আর তুলসী গাবার্ডের সিলেক্টিভ মানবাধিকারের লড়াইয়ের কোনো পার্থক্য দেখি না।

মুক্তিফোরামের পক্ষে এই সম্পাদকীয়টি রচনা করেছেন তনিমা

Share.

I am an Example Writer. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipisicing elit, sed do eiusmod tempor incididunt labored et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat.

Leave A Reply