চরিত্র–
শহীদঃ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, তরুণ
মৃত্তিকাঃ ডাক্তার, তরুণী
হারিছঃ মধ্যবয়েসি, পেশায় গার্ড
দৃশ্য ১
পরিবেশঃ দিনের বেলা। বিকেল।
হারিছঃ [দর্শকের দিকে তাকিয়ে] আইজকা আমার আনন্দের দিন। আইজ বুধবার। আইজ পার্কে শহীদ ভাই আর মৃত্তিকা আপা আইবো। মৃত্তিকা আপা আইলেই আমারে কিছু বখশিশ দেয়। শহীদ ভাইয়ের লগে থাকলে তার মনটাও থাকে ভালা। আইজকা দিনটাও ফাটাফাটি। ঝিরঝিরা বাতাস দিছে, আকাশ ভরা মেঘ। আজকে অনেকক্ষণ থাকবও ওনারা। এইটা ওইটা আনাইব। আমি থাকুম আশেপাশেই। আমার ওনাগো দেখতে ভালোই লাগে। সুন্দর জিনিস দেখতে কার না ভালো লাগে কন।
[মৃত্তিকা প্রবেশ করবে। তার পরনে শাড়ি, তার ওপরে ডাক্তারই এপ্রোন। একটু পর পর ঘড়ি দেখবে। সে কারো জন্য অপেক্ষা করবে। এমন সময়ে হারিছ তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিছুক্ষক পর শহীদ প্রবেশ করবে হন্তদন্ত হয়ে।]
শহীদ– [কানে হাত দিয়ে] স্যরি স্যরি স্যরি। দেরী হয়ে গেলো। আজকে বিসিএস সাধারজ্ঞান পড়াইতে পড়াইতে গাজীপুর থেকে মেসোপটেমিয়ায় নিয়া গেছে। আমি বেরও হইতে পারতেসিলাম না। এখনো সারা দুনিয়ায় সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন ঘুরতেসে। আসার সময় এক অন্ধ ভিক্ষুকরে মাফ চাও বলতে গিয়ে বলে ফেললাম, বলেন তো কানাডা কোন মহাদেশে। মাথাই নষ্ট।
মৃত্তিকা– হয়েছে হয়েছে থাক। আর কৈফিয়ত দিতে হবেনা। প্রতিবারই তোমার কোন না কোন অজুহাত। তুমি আসোনা আর সবাই আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। ওই শালা দারোয়ান হারিছ মিয়াও এতক্ষণ চেক আউট করেছে। চোখ তো না, যেন এক্স রে মেশিন।
শহীদ– এক্স রে মেশিন কে আবিষ্কার করেছে বল তো। পারলে না তো? রন্টজেন, উইলহেলম কনরাড রন্টজেন। দেখলা? তোমার তো ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া হবেনা।
মৃত্তিকা– ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আমি কি করবো? ডাক্তার তো হয়েই আছি। ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কি লাভ?
শহীদ– ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে লাভ নাই? কি যে বল। ম্যাজিস্ট্রেটের কতো পাওয়ার। তুমি আর আমি মোবাইল টেলিফোন নিয়ে ঘুরতেই হিমশিম খাই, আর সেই বাবাজি আস্ত একটা মোবাইল কোর্ট নিয়ে ঘুরে।
মৃত্তিকা– তুমি তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট হবে? ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কি করবে?
শহীদ– তোমাকে বিয়ে করবো, তারপর পার্কে পার্কে গিয়ে যারা প্রেম করছে তাদের জেলে ঢুকিয়ে দেবো। ভালোবাসার ওপরে মনোপলি জারি করবো।
মৃত্তিকা– এটা কোন রোমান্টিক কথা না শহীদ। এটা খুব বিচ্ছিরি কথা। খুব কর্তৃত্ববাদী কথা।
শহীদ– এখন রোমান্টিক লাগছে না। বাইরে চল, ফ্লাইওভারের নিচে যাই। উন্নয়নের ছায়ায় কর্তৃত্ববাদীতা দারুণ ভালো লাগে।
[এমন সময় হারিছ পেছন থেকে দৌড়ে এসে শহীদকে সিগারেটের প্যাকেট দেবে।]
হারিছ– ভাই, আপনের সিগ্রেট। কালকা টাকা দিসিলেন রাতে, দিতে ভুইলা গেসি।
শহীদ– [লজ্জা পাবে। সিগারেটের কথা অস্বীকার করার চেষ্টা করবে।] কিসের সিগারেট হারিছ মিয়া। তুমি গোলায়া ফেলসো। সিগারেটের টাকা দিয়েছে বখতিয়ার। আমি দেইনাই। [হারিছ মাথা চুলকে চলে যেতে চাইবে। শহীদ একটু ভেবে ওকে ডাক দেবে] আরে মিয়া দাঁড়াও দাঁড়াও। আমাকেই দিয়া দাও। বখতিয়ারকে দিয়ে দিবনে আমি।
মৃত্তিকা– শহীদ, বখতিয়ার তো সিগারেট খায়না। সিগারেট তুমিই কিনতে দিয়েছ। আমার কাছ থেকে লুকানোর জন্যে মিথ্যে বলছ। সমস্যা নেই, খাও খাও, সিগারেট খাও। যা ইচ্ছে কর।
শহীদ– [মৃত্তিকার অভিমান বুঝতে না পেরে] খোদা! বাচাইলা। ওই হারিছ মিয়া। এইদিক এসো। [হারিছ আসবে, শহীদ তার হাতে ষাট টাকা দিবে] চারটা বেনসন সুইচ আনবো আরও। [হারিছ টাকা নিয়ে যায় না, দাঁড়িয়ে থাকে।] কি মিয়া? খাড়ায়া আছ কেন? ও বখশিশ? [পকেট থেকে একশ টাকা বের করে দিবে।]
হারিছ– আর কয়টা টাকা বাড়ায়া দেন ভাই। জিনিসপত্রের যে দাম বাড়সে, বেতন দিয়া সংসার চলে না। পোলাপাইনের ইশকুল থেইকা নাম কাটা গেছে। ঘরে চাউল নাই।
মৃত্তিকা– ঘরে চাল নেই? ঘরে চাল না থাকলে মুশকিল আসানের একটা মন্ত্র আছে। যখন দেখবা বস্তায় চাল নাই তখন জোরে জোরে মন্ত্রটা পড়বা, আর বস্তা ভরে যাবে। চাল নাই দেখলেই বলবা, প্রবৃদ্ধি আট পার্সেন্ট, প্রবৃদ্ধি আট পার্সেন্ট, প্রবৃদ্ধি আট পার্সেন্ট। কি বলবা?
হারিছ– [দূর্বলভাবে] প্রবৃদ্ধি আট পার্সেন্ট।
মৃত্তিকা– ভাগও এইবার, বলতে বলতে ভাগ।
[হারিছের প্রস্থান]
[শহীদ ডানে বামে তাকাবে।]
শহীদ– আজ এখানে এতো মানুষ কেন বল তো? শান্তিমতন কোথাও বসারও উপায় নাই।
মৃত্তিকা– সামনের পার্কে যারা বসতো, তারা সব এখানে এসে জুটেছে। ওটা বন্ধ করে দিলো তো। লিজ দিয়ে দিয়েছে। শপিং কমপ্লেক্স হবে ওখানে।
শহীদ– দেশটারেই লিজে দিয়ে দিলো শালারা। চলতো বরং উত্তরার দিক যাই। দিয়াবাড়ির পেছনের দিকে এখনো উন্নয়ন পৌছায়নাই।
মৃত্তিকা– যাওয়া যায়। কিন্তু কতো বছর লাগবে যেতে কে জানে! যে জ্যাম রাস্তায়।
শহীদ– [হারিছের প্রস্থানের পথে তাকিয়ে] হারিছ ভাই! ও হারিছ ভাই!
[হন্তদন্ত হয়ে হারিছের প্রবেশ।]
হারিছ– জ্বী শহীদ ভাই। কি হইছে?
শহীদ– আচ্ছা, এখন উত্তরা যাইতে কতক্ষণ লাগবে বলতে পারেন? রাস্তাঘাটের অবস্থা কি?
হারিছ– এখন আর উত্তরা যাওন যাইতোনা ভাই। রাস্তাঘাট পুরা জাম। ভার্সিটির পোলাপানে শাহবাগ ব্লক কইরা দিছে। শ্রমিকেরা আন্দোলন করতেছে গাজীপুরে, বেতন পায়নাই। ওগো লগে পোলাপাইনও নামছে। কেন যে এইসব করে খোদাই জানে! মজুরি মাইর গ্যাসে কামলাগো, তোরার কি? সব হইলও গ্যাঞ্জাম লাগানির ধান্দা বুঝলেন? জোয়ান বয়েসে গ্যাঞ্জাম লাগায় মজা লাগে।
মৃত্তিকা– গ্যাঞ্জাম মানে? শ্রমিকের মজুরী না পেলে ছাত্রের রাস্তায় নামবে না? এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কার পয়সায়? কার ট্যাক্সের টাকায় চলে দেশ?
শহীদ– আরে তা তো ঠিক আছে। রাস্তা বন্ধ করার মানে কি? সাধারণ মানুষ তো আর বেতন মেরে দেয়নাই। তাদের ক্ষতি কেন করবে?
মৃত্তিকা– ওরকম করা লাগে শহীদ। দম বন্ধ করে না ধরলে আজকাল কিছু হয় না। বাধ্য করতে হয় সকলকে।
শহীদ– আরে ধুর। ওসব কিছু না। আলগা ফুটেজ খাওয়ার ধান্দা সব। পলিটিকাল পোলাপান সব গেছে দেইখো। হারামজাদা সবগুলা।
হারিছ– কার কথা কন ভাইসাব? আপনার ভাই বেরাদর সবডি গেছে। টুলু ভাই গেছে, সেলিম ভাই গেছে, মৃদুল ভাই গেছে। যাইব তো যাইবো, বখতিয়ার ভাইও গেছে। পার্কের সামনে দিয়াই তো গেলো।
শহিদ– ইশ, বখতিয়ারও গেছে? ওর আজকে আমার সাথে বিসিএসের পড়াশুনা করার কথা। বাকিগুলা গেছে ঠিক আছে, ওইগুলা তো ছাত্রফোরাম করে। বখতিয়ার ছাগল কি করতে গেছে?
হারিছ– কি জানি ভাই! আমিও বুঝিনাই।
শহিদ– আচ্ছা ঠিকাসে, যান এখন। কিছু লাগলে ডাক দিবোনে।
[হারিছের প্রস্থান]
শহীদ– কেন যে করে এইসব মালিকেরা? দিয়া দিলেই পারে বেতন।
মৃত্তিকা– কোথা থেকে দেবে? ব্যবসা সব চলে গেছে আফ্রিকায়, আরও সস্তা শ্রমের দেশের। শ্রমভিত্তিক অর্থনীতি কয়দিন টেকে? অর্থনীতি ডাইভারসিফাই করেনাই। লোন সব মাইরা দিসে খেলাপিরা, নতুন ব্যবসা উঠেনাই। এখন বিপদে পড়সে।
শহীদ– তুমি ডাক্তার হয়ে এইসব নিয়ে পড়ে আছ কেন? পত্রিকা বেশি পড়া হয়ে যাচ্ছে তোমার। ওদের কাজই সবকিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা। ওইসবে বিশ্বাস করলে পৃথিবী আরও দশ বছর আগে তিনবার ধ্বংস হয়ে যেত। এর চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আমাদের হাতে।
মৃত্তিকা– কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তোমার এতো?
শহীদ– চুপ মেরে বসে থাকা। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কাজ হচ্ছে চুপ মেরে বসে থাকা। বিসিএস দিব, সরকারী চাকরি করবো, আর চুপ মেরে বসে থাকব। চোখের সামনে যা ইচ্ছে হবে আর চুপ করে বসে থাকব। মাঝে মাঝে মন্ত্রীসান্ত্রীরা আসবে, তখন শুরু হবে কথা বলা। ঠিকঠাক কথা বলতে পারলে দ্রুত প্রমোশন।
মৃত্তিকা– ফাইজলামি রাখো তো শহীদ। একটু সিরিয়াস হও।
শহীদ– সিরিয়াসই তো আছি। তুমি ডাক্তার হয়ে বসে আছ, আর আমি এখনও ভেরেণ্ডা ভাজছি। এমনিতে তুমি আমার চেয়ে বয়েসে বড়, তার ওপরে তো হিন্দু-মুসলিম ক্যাচাল আছেই। আমার দরকার এখন এইসব পূর্ব পশ্চিম না ভেবে পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়া। বিসিএসটা দিতে হবে। ভালো একটা চাকরি পেতে হবে। সরকারি চাকরি পেয়ে সরকারি গাড়ি হাঁকিয়ে তোমার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলে আর না করতে পারবে না, যতই ঝামেলা থাক।
মৃত্তিকা– [দীর্ঘশ্বাস ফেলে] সবাই যদি তোমার মতন হতো শহীদ, তাহলে দেশে আর কোনই [এয়ার কোটস] গ্যাঞ্জাম হতো না।
শহীদ– [মৃত্তিকার খোঁচা বুঝতে না পেরে] সেটাই! কোন গ্যাঞ্জামের দরকার নাই। শিক্ষাটুকু হয়ে গেছে, এখন শুধু শান্তি আর প্রগতি হবে। আর কোন কথা হবেনা বস। উন্নয়নের বন্যায়, ভেসে যাবে সব ন্যায়, থুড়ি অন্যায়। মিছিল দিয়ে পেট ভরে না, স্লোগানে মুড়িও ভেজে না। বিপ্লব করে কে কবে বড়লোক হইসে বল?
মৃত্তিকা– সব কি বড়োলোকি দিয়ে বিচার করতে হয় শহীদ? মাস্টারদা সূর্যসেন সেই শতবছর আগে বিপ্লব করেছিলেন বলেই আজকে আমরা স্বাধীন।
শহীদ– মাস্টারদা সূর্যসেন কোন বিষয়ের মাস্টার ছিলেন বলো দেখি? মনে হতে পারে ইতিহাস, কিন্তু আসলে গণিত। উচ্চ মাধ্যমিক ত্রিকোণমিতির প্রতি ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। একবার বিপ্লবী ভাষণ দিতে গিয়ে বলে বসলেন, ভাইসব, মনে বড় cos2.
মৃত্তিকা– [দাঁত কিড়মিড় করতে করতে] আমার ইচ্ছা করছে থাপ্পড় মেরে তোমার গালের দাঁত সব ফেলে দেই।
শহীদ– দাঁত তো মৃত্তিকা গালে থাকে না, দাঁত থাকে মাড়িতে।
[মৃত্তিকা শহীদকে ঘুরিয়ে একটা থাপ্পড় মারবে]
মৃত্তিকা– দেখলে এখন? গালের পেছনেই যে মাড়ি থাকে দেখলে?
[বলেই মৃত্তিকা গটগট করে হেঁটে যেতে থাকবে। শহীদ কোনভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে মৃত্তিকার হাত ধরবে।]
শহীদ– রাগ কইরও নারে বাবা। এতো সহজে সব ভালোবাসা নষ্ট হয়ে গেলো। এইদিকে আমি তোমারে কতো ভালোবাসি জানো? তোমার ভালোবাসায় আমি তাজমহল বানাতে পারি।
মৃত্তিকা– হারামজাদা! এতো সাধারণ জ্ঞান জানোস, এইটা জানোস না যে তাজমহল হইল একটা সমাধিসৌধ। আমারে মেরে ফেলতে চাস তুই?
শহীদ– তাজমহল কোন নদীর তীরে অবস্থিত বল তো? পারবানা। যমুনা নদীর তীরে। যমুনা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায় জানো? হিমালয়ের যমুনত্রি হিমবাহে। দেখলা, এটাও পারলা না। আচ্ছা এবার একদম সহজ একটা প্রশ্ন করি, হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম কি?
[মৃত্তিকা রক্তচক্ষু নিয়ে শহীদের দিকে তাকাবে, তারপর এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবে।]
দৃশ্য ২
পরিবেশঃ মৃদু আলো। মেঝেতে শুয়ে রয়েছে শহীদ , সম্ভবত ঘুমাচ্ছে। শহীদের পরণে কুঁচকানো হলুদ পাঞ্জাবী, গলায় লাল উত্তরীয়। সেটা দিয়ে মুখ ঢেকে রেখে ঘুমাচ্ছে সে। এমন সময়ে মৃত্তিকা প্রবেশ করবে। মৃত্তিকার পরনে শাড়ি, চুড়ি, পায়েল, টিপ, নাকফুল। চোখে কাজল। শাড়ির ওপরে ডাক্তারী এপ্রণ পরে আছে সে। সে হন্তদন্ত হয়ে শহিদকে খুঁজবে। পাবে না খুঁজে। এমন সময় হারিছ প্রবেশ করবে।
হারিছ– মিত্তিকা আপা, এতো রাতে আপনে এইখানে! কারে খুঁজেন?
মৃত্তিকা– [ভয়ার্ত চোখে] শহীদকে। শহীদকে দেখেছেন?
হারিছ– শহীদ ভাই এইখানে আইবো কইত্থেকে? আইজকা তো বুধবার না। আইজকা তো সোমবার।
মৃত্তিকা– খবর শুনলাম, ক্যাম্পাসে গুলি চলেছে। অনেক ছাত্র মরে গেছে। তাদর লাশ নিয়ে এখানে সেখানে লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। শহীদের হলের অনেকের খোজ পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি তাই খুঁজছি ওকে। এখানে তো প্রায়ই আসতো ও। তাই খুঁজতে এসেছি। ওরও কি গুলি লাগলো? ওকেও কি লুকিয়ে ফেলেছে ওরা?
হারিছ– কি যে বলেন আপা! এইসব ভুয়া খবর–গুজব গুজব। এইগুলাতে কান দিবেন না। এইগুলা যারা ছড়ায় তারা…
মৃত্তিকা– কি? নব্য রাজাকার? দুষ্কৃতিকারী? বিপথগামী? জঙ্গি?
হারিছ– [গলা খাঁকারি দিয়ে] এইখানে এতো রাতে মহিলা মানুষ থাকার নিয়ম নাই আপা।
মৃত্তিকা– [একশো টাকা বের করে] এখন আছে?
[হারিছ টাকাটা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে।]
মৃত্তিকা– আচ্ছা, এখন যদি এই বিরান প্রান্তরে কেউ এসে আমাকে ধর্ষণ করতে চেষ্টা করে, আপনি ঠেকাতে পারবেন?
হারিছ– [কাশি দিয়ে] দশ মিনিটের মাঝে বন্ধ হইয়া যাইব আফা।
মৃত্তিকা– আপনি আমাকে কি বাঁচাবেন? আপনি নিজেই এতো সহজে নিজেকে বিক্রি করে দেন।
হারিছ– কি কইলেন?
মৃত্তিকা– হারিছ ভাই, আমাকে একটা সিগারেট এনে দিতে পারবেন?
হারিছ– কি কইলেন?
মৃত্তিকা– সিগারেট, সিগারেট। বিড়ি। পারবেন? গোল্ড লিফ সুইচ। আচ্ছা না, না। বেনসন।
হারিছ– [পকেট থেকে সিগারেট বের করে দেবে।] ওই দিন কিনতে দিসিলো শহীদ ভাইয়ে, দেয়া হয়নাই।
মৃত্তিকা– [সিগারেট নিয়ে] ঠিক আছে, আপনি যান।
[হারিছ বেরিয়ে যাবে। মৃত্তিকা আবার শহীদকে খুঁজতে থাকবে। খুঁজে পাবেনা কোথাও। এমন সময়ে পেছন থেকে স্লোগানের ধ্বনি শোনা যাবে। আমাদের ধমনিতে শহীদের রক্ত, এই রক্ত কোনদিন বৃথা যেতে দেবোনা। জয় বাংলা, জয় জনতা। স্লোগান শুনে শহীদ ধড়মড় করে উঠে বসবে। গলায় উত্তরীয় পেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে মিছিলে যোগ দিতে যাবে। মৃত্তিকা দেখতে পাবে তাকে। দৌড়ে হাত ধরে থামাবে।]
মৃত্তিকা– কোথায় যাচ্ছ শহীদ? কোথায় যাচ্ছ?
শহিদ– আমাকে যেতে হবে মৃ, ওরা ডাকছে আমাকে। সময় ডাকছে।
মৃত্তিকা– তুমি কেন যাবে ওখানে? তোমার কি আসে যায়? তোমার কোন ক্ষতি তো করেনি ওরা।
শহীদ– ওরা টুলুর গায়ে রাবার বুলেট মেরেছে। মৃদুলকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে দালালগুলা। এই যুদ্ধ এখন আমাদের সকলের যুদ্ধ। সময়ের যুদ্ধ। আমাকে যেতেই হবে মৃ।
মৃত্তিকা– যেও। ওরা তো চলে গেছে এখন। ফিরে এলে যেও। এখন আমার সাথে বস কিছুক্ষণ।
[মৃত্তিকা শহীদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শহীদ মৃত্তিকার পাশে বসে। মৃত্তিকা কড়ে আঙ্গুল দিয়ে শহীদের কড়ে আঙ্গুল ধরে]
শহীদ– [চোখ মুছতে মুছতে] কখন এলে তুমি?
মৃত্তিকা– এইতো, মাত্রই। কতক্ষণ ধরে ঘুমুচ্ছ তুমি?
শহীদ– কি জানি! এক ঘণ্টাও হতে পারে, এক বছর হতে পারে, এক দশক হতে পারে, এক জীবনও হতে পারে।
শহীদ– আমাকে খুঁজে পেলে কেমন করে?
মৃত্তিকা– আমি তোমাদের গন্ধ পাই। তোমাদের আমার হাড়ে হাড়ে চেনা। তোমরা কোথায় থাকো, কোথায় ঘুমাও, সব জানি আমি। চোখ লাল কেন তোমার? রাতে ঘুমাওনি? কি করেছো সারারাত।
শহীদ– বারোটার দিকে টুলু রুমে এলো। মৃদুলও। বখতিয়ারকে টেনে তুলল ওরা। আজ সারারাত নাকি ওরা পথে পথে হেঁটে বেড়াবে। আমি বললাম, শহরজুড়ে তো কারফিউ। ওরা বলল, সেজন্যেই তো। কারফিউ ভাঙবো আমরা। আরও অনেকে। খোলা রাস্তায় মৌন মিছিল করবো। আমাদের শ্রমিক ভাইদের ওরা পিটিয়েছে। সাহস থাকলে আমাদের পেটাক। আমরা ওদের একই শ্রেণীর লোক—ক্লাস কন্টিনিউয়াস। আমাদের গায়ে হাত দিলে শালা গদি নাড়িয়ে দেব ওদের।
মৃত্তিকা– তারপর?
শহীদ– বেরিয়ে গেলো ওরা।
মৃত্তিকা– তুমি গেলেনা?
শহীদ– না, যাইনি। তবে ঘুমুতেও পারছিলাম না। বসে বসে বিসিএসের পড়া পড়ছিলাম। মাঝে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বোধহয়। স্বপ্নে দেখলাম একা একা হল ছেড়ে বেড়িয়েছি। খুঁজে পেয়েছি বখতিয়ারকে, টুলুকে, মৃদুলকে, শাহানাকে। তারপর ওদের পাশাপাশি হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এসে দাঁড়ালাম হাইকোর্টের সামনে। রাস্তা রুখে দাঁড়িয়ে পুলিশ। হাতে উদ্যত অস্ত্র। এখনই গুলি করতে তৈরি। সবাই থেমে গেলো। আমি থামলাম না। পাঞ্জাবির বোতাম খুলে সোজা হেঁটে এগুতে থাকলাম ওদের দিকে। তারপর চিৎকার করে বললাম, গুলি কর হারামজাদা। সাহস থাকলে গুলি কর।
মৃত্তিকা– [দুইহাতে শহীদের হাত জড়িয়ে ধরে] তারপর?
শহীদ– [দীর্ঘশ্বাস ফেলে] তারপর ঠাস ঠাস ঠাস করে তিনটা গুলি এসে আমার বুকে লাগলো। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম আর প্রচন্ডভাবে তোমাকে খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু পেলাম না।
মৃত্তিকা– তারপর তোমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো?
[শহীদ চুপ করে থাকবে খানিকক্ষণ। মৃত্তিকা তার শরীর ধরে ঝাঁকি দেবে।]
মৃত্তিকা– কি হলো? জেগে উঠলে তুমি তারপর? নাকি আরও কিছু হয়েছে?
শহীদ– জাগিনি। বরং মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছি। এখানে কিভাবে এলাম, জানিনা। ।
মৃত্তিকা– আর শাহানা, টুলু, মৃদুল, বখতিয়ার–ওদের কি হলো?
শহীদ– জানিনা। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা সবাই মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছি । শাহানা, টুলু, মৃদুল, বখতিয়ার সবাই আমারই মতো শহীদ হয়ে গেছে।
[মৃত্তিকা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবে। তারপর কথা ঘুরানো চেষ্টা করবে।]
মৃত্তিকা– আমি বলি কি, শহীদ, তুমি বিসিএসের চিন্তা বাদ দাও। একটা ব্যবসা দাও। এই চাকরি হারানো শ্রমিকদেরকে চাকরি দাও। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করও।
শহিদ– তাই দিয়ে কি মুক্তি আসবে মৃত্তিকা? সেই তো টাকার পেছনে ছোটা। নতুন যুগের দাসত্ব। সেই তো কমোডিটি ফেটিশিজম। নিজেদের বানানো পণ্য নিজেরা কিনতে না পারা।
মৃত্তিকা– এভাবেই সংসার চলে শহীদ। দর্শন দিয়ে পৃথিবী চলেনা। তুমি যা চাও তা বালখিল্য কিশোর ছাড়া কেউ চায়না । দেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে। শহর জুড়ে ফ্লাইওভার হচ্ছে। তার ওপরে শাই শাই করে গাড়ি চলছে। তার নিচে ঘরভাঙা লোকেরা রাতে ঘুমাচ্ছে। হয় তুমি সেই গাড়ি হাঁকাবে, নাহয় ফ্লাইওভারের ছায়ায় মৃত পরিসংখ্যান হয়ে পড়ে থাকবে। তুমিই বেছে নাও তুমি কি চাও।
শহীদ– আমি জীবন চাই মৃ। বেঁচে থাকতে চাই। নিশ্বাস নিতে চাই। দালানকোঠার পাঁজরে গ্রাফিতি আঁকতে চাই। মৃত পরিসংখ্যানের কবর উখড়ে মানুষের আত্মাকে বাঁচিয়ে তুলতে চাই। গাড়ির কালো কাঁচ তুলে দেয়া লোকগুলোকে রোদ্দুরের নিচে আনতে চাই। তুমি আজ হারিছ মিয়ার মতন কথা বলছ কেন মৃ? কি হয়েছে তোমার? এত ভয় ভয় চোখে তাকাচ্ছ কেন?
মৃত্তিকা– আমি তোমাকে ধ্বংসের পথ থেকে সরিয়ে আনতে চাইছি। আমি তোমাকে নিয়ে সংসার গড়তে চাইছি। কিন্তু তুমি তা চাও না মনে হচ্ছে। তুমিও বদলে গেছও হঠাৎ। তুমি সংঘাত চাও, তুমি ধ্বংস চাও। তুমি বেঁচে থাকতে চাও না, তুমি মৃত্যু চাও। নির্মম, বিভৎস মৃত্যু।
শহীদ– তবে তাই হোক। তোমাকে ছাড়া আর কোন কামনাকে পেয়েছি কোনদিন? নাহয় মৃত্যুকে পেলাম। মৃত্যুই কেবল তোমার মতন সুন্দর প্রেয়সী।
মৃত্তিকা– আমার তোমাকে নিয়ে ভয় হয় শহীদ। না। আমার তোমাকেই ভয় হয়।
শহীদ– হা হা। এই শহরে সবাই মৃত্যুর ভয় বুকে নিয়ে বাঁচে। সেখানে কেউ যদি মৃত্যুকে আগলে নিয়ে পড়ে থাকে, তাকে তো উন্মাদ মনে হবেই, তাকে তো ভয় করবেই।
মৃত্তিকা– তোমার মাথা ঠিক নেই শহীদ। তুমি রাতে ঘুমানই, মনে হচ্ছে খেয়েছ টেয়েছ কিছু। থামো তুমি। আমার কথা ভেবে হলেও থামো। আমি এইসব চাইনা। এইসব ধ্বংস, মৃত্যু, রক্ত চাইনা আমি। আমি মৃত্তিকা, আমি ফসল চাই।
শহীদ– বিপ্লব ছাড়া কি ফসল ফলে মৃ? সেইজন্যে কর্ষণ প্রয়োজন হয়, মৃত্তিকাকে আলোড়িত করতে হয়, আন্দোলন করতে হয়। সেজন্যেই তো জীবন দিতে চাই। আমার রক্ত তুমি পুষ্ট হও, আমার মৃতদেহ হোক তোমার কম্পোস্ট।
মৃত্তিকা– কর্ষন তুমি করনি? বছরের পর বছর ধরে, রাতের পর রাত পার করে আমার দেহের সাথে কি করেছো তাহলে?
শহীদ– সেই কর্ষণ তো নিষ্ফলা।
মৃত্তিকা– যদি বলি ফসল এসেছিলো?
শহীদ– [অবাক দৃষ্টিতে] মানে? কবে এসেছিলো? আমাকে কিছু বলনি কেন?
মৃত্তিকা– এসেছিলো। বিপ্লব এসেছিলো। ভূমিষ্ঠ হবার আগেই জঠরে মরে গেছে।
শহীদ– [দীর্ঘশ্বাস ফেলে] তাহলে মৃত্তিকা এখনো প্রস্তুত হওনি তুমি। বিপ্লব আসবার জন্যে পলিমাটিকে প্রস্তুত হতে হয়। সেই দিন আসেনি এখনও। তবে আসবে। আর নিরীহ মাটিতে আজকে জন্ম নিচ্ছে সচেতনতার ধান। গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আসবে আবার বাংলাদেশের প্রাণ। বিপ্লব আসবেই! আমরা বেঁচে থাকি বিপ্লব করবার জন্যে।
মৃত্তিকা– তুমিও কি তাই বেঁচে আছো? বিপ্লব করবার জন্যে? প্রথা ভাঙবার জন্যে? আমার সাথেও কি তাই সম্পর্ক করেছো? বুড়ো হিন্দু মেয়ের সাথে প্রেম করে বিপ্লব করবে বলে? আমি তোমার এডভেঞ্চারাস জীবনের একটা অনুষঙ্গ মাত্র, তাই তো?
শহিদ– তুমি অকারণে রেগে যাচ্ছ মৃত্তিকা। আমি যদি তোমাকে বিপ্লবের মতন ভালোবাসি, তাতে দোষের কি আছে? তোমার তো তাতে বরং খুশি হবার কথা। সত্যিকারের বিপ্লবীরা তাদের ভালোবাসার জন্যে জীবন দিতে পারে। আমিও পারি। সব মাটিতে লুটিয়ে দিতে পারি তোমার জন্যে।
মৃত্তিকা– হয়েছে, আর ওসব মিঠে কথা বলতে হবেনা। সব যদি বিসর্জন দিতে পারো, তবে নিজের এই শিশুতোষ গোয়ার্তুমিটাকে বিসর্জন দিতে পারোনা? এই বিপ্লবের স্বপ্ন ছেড়ে বাস্তব জীবনের জন্যে কিছু করতে পারোনা?
শহিদ– না। পারিনা। বাস্তবতা যখন এতোটা অশ্লীল তখন স্বপ্নে বেঁচে থাকাটাই একমাত্র বিকল্প। তুমি কি দেখোনা ওরা লক্ষ মানুষের যুদ্ধকে একটি লোকের তর্জনীর ছায়ায় নিয়ে গেছে? তুমি কি দেখনা শিক্ষার নামে শিশুদের চোখ গেলে দেয়া হচ্ছে? তুমি কি দেখোনা টাকার লোভ দেখিয়ে একটি আস্ত প্রজন্মকে খোজা করে দেয়া হচ্ছে?
মৃত্তিকা– না দেখিনা। তোমরা যতই কষ্ট নিয়ে কাব্য করনা কেন, মানুষ সুখে আছে শহীদ। তারা সুখের স্বপ্ন দেখছে। সুখের জন্যে যুদ্ধ করছে। তোমরা তাদের অবাস্তব কথা বলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছ। তোমরা নিজেরাই সবচেয়ে বিভ্রান্ত। বিপ্লবের পরের দিন কি হবে তোমরা জানোনা। কেবল অন্ধ মৃত্যুক্ষুধায় বিপ্লব বিপ্লব বলে চ্যাঁচ্যাঁও। সাধারণ মানুষ এমন পাগল না। তারা সুখ চায়, সুখে বাঁচতে চায়। তাদের সুখে থাকতে দাও। গরীবের অধিকার গরীবও চায়না–সে চায় বড়লোক হতে।
শহিদ– সুখ না মৃ–মায়া, ভ্রম, কল্পনা। দূর থেকে চাকচিক্য দেখে মোহিত হচ্ছে সকলে। যেটাকে তোমরা সুখ ভাব সেটা কেবলই মরীচিকা। এই মৃত পুঁজির নগরীতে সুখ মানে কেবলই বিত্তপূজা।
মৃত্তিকা– তুমি একটা সোশিওপ্যাথ। আমি কেন যে তোমাকে ভালোবাসি আমি জানিনা।
শহিদ– কেউ কি কোন কারণে ভালোবাসে? আমরা ভালোবাসি নিশ্বাস নেবার মতন। বেঁচে থাকার তাগিদে। আমরা ভালবাসি হৃদয়ের ধুকপুকের মতন। ছন্দ, তাল আর লয়ের তাগিদে। আমরা ভালবাসি কারণ সেটাই আমাদের বেঁচে থাকবার একমাত্র নির্নায়ক। আমি আছি, কারণ আমি ভালোবাসি।
মৃত্তিকা– তুমি কিছুই দেখোনা শহীদ, তুমি কিছুই বোঝনা। [দর্শকের দিকে, মঞ্চের সামনে দিকে আগাবে মৃত্তিকা, পিছু নেবে শহীদ।] ওই দেখ আকাশ ছিঁড়ে অট্টালিকা উঠেছে। ফ্লাইওভার হয়েছে, তার ওপরে গাড়ি চলছে। ওই দেখও আকাশে উড়ছে যুদ্ধবিমান। তার পালকে আমাদের জাতীয় পতাকা।
শহীদ– [মৃত্তিকার চোখ অনুসরণ করে সবকিছু দেখবে। আকাশে চেয়ে যুদ্ধবিমান দেখবে।ঘৃণায় মুখ কুচকে আসবে তার। অতঃপর আকাশে দিকে মধ্যাঙ্গুলি তুলে ধরবে সে।] ওই উন্নয়ন আমার নয়। ওই পতাকা আমার নয়। খিদের পতাকা নেই, বিনাসুতো মালা গেঁথে গড়েছে দুনিয়াজোড়া দেশ। এতোবড় পতাকার কাপড় যাবেনা পাওয়া কোথা।
মৃত্তিকা– আমি উঠলাম, শহিদ।
[মৃত্তিকা উঠে যায় না। বসে থাকে। শহিদ মাটিতে শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে। লাঠি হাতে গার্ডের পোশাক পরা হারিছ দৃশ্যমান হয় । হারিছকে দেখেই শহিদ হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে। দৌড়ে হারিছের গলা টিপতে যায়। মৃত্তিকা তাকে জাপটে ধরে থামায়]
শহীদ– আবার খুন করতে আসতে আসছস হারামজাদা। তুই কি ভাবসস তোর বন্দুক আমি ডরাই? তোর বুলেট আমি ভাজি কইরা খাই হারামি, তোর বেয়নেট দিয়ে আমি দাঁত খিলাল করি কুত্তার বাচ্চা। সাহস থাকলে বন্দুক ফালা। ফালা বন্দুক। খালি হাতে মার শালা দেখি কতো পারস।
মৃত্তিকা– শহীদ! শহীদ! কি করছ তুমি? ওটা হারিছ ভাই। এই পার্কের গার্ড। যাও! তুমি শুয়ে পড়ো, আমি আসছি।
[শহীদ শান্ত হবে, ফিরে যাবে। শুয়ে পড়বে। উত্তরীয় দিয়ে ঢেকে দেবে মুখ।]
হারিছ– আপা, কার সাথে কথা কন?
মৃত্তিকা– কারও সাথে না। আপনি এরকম হুট করে চলে আসলেন কি মনে করে?
হারিছ– আফা! ম্যালা রাত হইছে। বাড়িত যাইবেন না? এগারোটা বাজে।
মৃত্তিকা– যাবো
হারিছ– বিষ্টি আইবো। ভিজ্যা যাইবেন।
মৃত্তিকা– ভিজলে ভিজবো। সমস্যা নাই। [সিগারেট ধরায়, দুইটা টান দেয়। তারপর খপ করে হারিছের হাত ধরে ফেলে।]
হারিছ– কি করেন আপা! হাত ছাড়েন, ছাড়েন হাত!
মৃত্তিকা– ছাড়তেসি। আপনি আগে বলেন, রাতেরবেলা এই পার্কে পুলিশ আসছিলো? লাশ ফালায়ে গেছে? পুতে গেছে লাশ? সত্যি করে বলেন। হাইলে এক্ষণ হাত পুড়ায়া দিব।
হারিছ– আপা ছাইরা দেন আপা। আমি কিছুই জানিনা আপা। পিক আপ ট্রাক লইয়া পুলিশ আইছিলো। পিছনে পুরা ঢাকা। আমারে দুইশ টাকা দিয়া কইল চা সিগারেট খাইয়া আয়। আমি গেলাম গা। দুই ঘনটা পরে আইসা দেখি কেউ নাই।
মৃত্তিকা– কোদাল ছিল ওদের সাথে?
[হারিছ চুপ করে থাকে]
মৃত্তিকা– [চিৎকার করে] কথা বলেন না কেন? ছিল কোদাল?
হারিছ– [বিড়বিড় করে] ছিল আপা। কোদাল ছিল।
মৃত্তিকা– [হারিছের হাত ছেড়ে দিয়ে।] যান এখন আমার জন্যে কোদাল নিয়ে আসেন।
হারিছ– কই থেকে আনবো আপা? কি করবেন আপনে কোদাল দিয়ে?
মৃত্তিকা– কই থেকে আনবেন আপনে জানেন। আমি এই পার্কের সব লাশ খুড়ে তুলবো। এরপর তাদের দাফনের ব্যবস্থা করবো। এখানে ওখানে ঢিবি হয়ে আছে। ভালোবাসার এই পার্ককে ওরা গোরস্থান বানিয়ে ছেড়েছে, আর আপনি কিছুই বুঝেন নাই? এই শত শত কবর আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? দুইশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে আপনার সরকার আপনার চোখ কিনে নিলো? এতো সহজ? মরা মাংসের গন্ধও আপনি পান্ না?
যান, এখন দূর হন। দশ মিনিটের মাঝে কোদাল নিয়ে উপস্থিত হবেন।
[হারিছ চলে যায়। মৃত্তিকা জ্বলন্ত সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। শহীদ উঠে বসবে]
শহীদ– তুমি এখন মাঝরাতে এই গোরস্থানে বসে সিগারেট খাচ্ছো?
মৃত্তিকা– তুমি যদি এই গোরস্থানে এসে রাতবিরাতে বসে থাকো , আমি কি করব?
শহীদ– আমার কি আর উপায় আছে বল? আমার তো এই একটাই নিরাপদ আবাস । অনন্তকাল পিচগলা রাস্তা হাটতে হাটতে আমি এই নির্জন অনিকেত প্রান্তরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছি। এইখানে, এই মৃত মানুষের রাজত্বে কোন রাজা নেই, কোন জাতীয়তা নেই, কোন বর্ণ নেই, ধর্ম নেই। এইখানে সবাই সমান। মাংস গলে গিয়ে যখন হাড্ডি বেরিয়ে আসে, তখন সবাই আমরা এই হয়ে যাই মৃত্তিকা। তখনই অর্জিত হয় সত্যিকারের সাম্য। যেই সাম্যের জন্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমরা জীবন দেই।
[মৃত্তিকাচুপ করবে। শহীদের মাথা কোলে নেবে। চুলে হাত বুলিয়ে দেবে।]
মৃত্তিকা– শান্তি পাচ্ছ তুমি?
শহীদ– হ্যাঁ।
মৃত্তিকা– তুমি এখনই শান্তি পেলে হবে শহীদ? এখনও তো কতো কাজ বাকি। কতো দেশে এখনও সূর্য ওঠেনি। কতো গ্রামে আজও অমাবশ্যা। কতো জমিনে আজও ফাটল।
শহীদ– তুমি কি আমাকে নিয়ে মজা করছ, নাকি সত্যিসত্যি আমাকে প্রেরণা দিচ্ছো?
মৃত্তিকা– বিদ্রূপ আর বিদ্রোহের মাঝে তফাৎ কি বল? প্রেম আর প্রোপাগান্ডার মাঝে কতোটুকুই বা অমিল?
মৃত্তিকা– কবিতা লিখিনা অনেকদিন। তোমাকে নিয়েও না, বিপ্লব নিয়েও না। কাগজ কলম খুঁজে পাই না। এক দুই লাইন মাথায় এসে হারিয়ে যায়। জড়ো করতে পারিনা। বুকের মাঝে ছ্যাদা হয়ে গেছে তো, আর কোন আবেগ বের হয়ে আসে না।
মৃত্তিকা– তুমি এমনটা না হলে কি হতো? কি হতো তুমি হাত তুলে সেলাম ঠুকলে? কি হতো তুমি ট্যাংকের সামনে দাড়িয়ে না পড়লে? কি হতো তুমি মুঠোহাত নিয়ে মিছিলের সামনে গিয়ে না দাঁড়ালে? কি হতো তুমি আর দশজন ছেলের মতন হলে?
শহীদ– তুমি আমাকে ভালবাসতে না।
মৃত্তিকা– এখন তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু তোমার হতে পারবনা। ভালো হলো?
শহীদ– কিন্তু ভালো তো বাসলে। আমার হয়ে আমাকে ভালো না বাসলে কি হতো? দিনে তিনবার ভাঙ্গা রেকর্ডের মতন ভালোবাসি বলতে, কিন্তু একবারও বুক কেঁপে যেতো না। যে ভালোবাসায় বুক কাঁপে না, সেই ভালোবাসার কোন মূল্য আছে?
মৃত্তিকা– ভালো তো বাসি অস্তিত্বের তাগিদে। মৃত্তিকাদের শহীদদের ভালো না বেসে উপায় আছে? শত সূর্যের বিপ্লব শেষে শহীদেরা তো মৃত্তিকার বুকে এসেই ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের জন্যে বুক পেতে দিতে হবে না?
শহীদ– তোমরা বুক পেতে দাও, সেই লোভেই তো আমরা বারবার শহীদ হয়ে যাই।
[হন্তদন্ত হয়ে হারিছের অনুপ্রবেশ। শহীদ আবার শুয়ে পড়বে, চোখ বন্ধ করবে।]
হারিছ– আফা, আপনের কোদাল
মৃত্তিকা– [সিগারেট হাতে নিয়ে] থ্যাংকস হারিছ ভাই।
[মৃত্তিকা কোদাল নিয়ে এখনে সেখানে খোরা শুরু করবে। খুঁড়তেই থাকবে। কিন্তু খুড়ে কিছু পাবেনা। খুঁড়তে খুড়তে কথা বলতে থাকবে হারিছের সাথে।]
মৃত্তিকা– হারিছ ভাই, আপনার বাড়ি কই?
হারিছ– বাড়ি আছিলো আপা চাঁদপুর জেলায়, মাঠভাঙ্গা গায়ে। জমিন আছিলো পাঁচ বিঘা। সব ভাইঙ্গা গেল নদীর কামড়ে। নদীর রিফুজি হইয়া ভাইসা আইলাম এই শহরে। তারপরে ভাসতে ভাসতে আইসা পড়ছি এই গোরস্থানে।
মৃত্তিকা– নদীতে জমিন ভেঙ্গে গেলো, আপনি কারও কাছে নালিশ করলেন না? ক্ষতিপূরণ চাইলেন না কারও কাছে?
হারিছ– কি যে কন আফা! কার কাছে নালিশ দিমু? কার কাছে ক্ষতিপূরণ চামু। নদী থাইকা চর জাগছে, লইয়া গেছে নদীতেই, কার কাছে বিচার দিমু কন আফা? সাগরের কাছে? পাহাড়ের কাছে? সূর্যের কাছে? তারার তো কারও টাকশাল নাই।
মৃত্তিকা– সরকার আছে। তাদের দায়িত্ব ছিল আপনাদের রক্ষা করবার। তারা করেনি। তাদের কাছে জবাব চাইবেন।
হারিছ– [হেসে] এর থেইকা আল্লাহর কাছে জবাব চাওন ভালা। গরীবের তাও আল্লাহ আছে। গরীবের কোন সরকার নাই। কোন সংসদ নাই। কোন পতাকা নাই।
মৃত্তিকা–[মৃত্তিকা মুচকি হেসে শহীদের দিকে তাকায়] আপনাকে কেউ বাঁচাতে আসেনি? সাহায্য করতে আসেনি কেউ?
হারিছ– কে আইবো কন? সবাই যার যার ধান্দায় ব্যস্ত। আগে একসময় গাঁয়ে একজন বিপদে পড়লে দশজনে আগাইত। সেই দিন বাগে খাইছে। অহন শহর গঞ্জ গ্রাম, সকলই একসমান।
মৃত্তিকা–উন্নয়ন হচ্ছে হারিছ ভাই। কেউ বাদ যাবেনা। সকলে আধুনিক হবে। সমাজ ভেঙ্গে গড়ে উঠবে হাই সোসাইটির দালান।
হারিছ– এইখানে এতো পাখি কেন আফা?
মৃত্তিকা– আপনার পার্ক, আপনার গোরস্থান, আপনি জানেন না পাখি কেন?
হারিছ– না
মৃত্তিকা– রাস্তার ধারে কখনও কাক মরে পড়ে থাকতে দেখেছেন? একটা কাক মরলে কেমন করে সবগুলো কাক তার শবদেহ ঘিরে উড়তে থাকে দেখেছেন?
হারিছ– জ্বে। কিন্তু এইগুলান তো কাক না। দেখে পায়রা মনে হয়। কিন্তু পায়রাও না।
মৃত্তিকা– আবাবিল। এরা আবাবিল। ঐযে দেখছেন, উনি সূর্যসেন। উনি প্রীতিলতা। ও ক্ষুদিরাম। বিপ্লবীরা মারা গেলে শহীদ হয়ে যায়। শহীদের পরকালে যায় না। তাদের আত্মা পাখি হয়ে যায়। আবাবিল পাখি। নখরে ছোট ছোট পাথর নিয়ে তারা অপেক্ষা করতে থাকে। কোন এক অন্ধকার দুপুরে শহরের ওপর পাথুরে বৃষ্টি ঘটাবে বলে।
[বলেই মৃত্তিকা শহীদের মাথার কাছে খুঁড়তে শুরু করে।]
হারিছ– আফা, এই যে গোর খুড়তাসেন, কার গোর জানেন?
মৃত্তিকা– [সিগারেটে টান দিয়ে] জানিনা। আপনি জানেন?
হারিছ– নাহ। কইলাম তো, রাইতের আন্ধারে পুলিশের লোকেরা আইসা গোর দিয়া গেছে। কুন চিনপরিচয় নাই।
মৃত্তিকা– আপনার কি মনে হয়? কার কবর হয়েছে এখানে?
হারিছ– যে কাউর হইতে পারে। রাস্তায় সেইদিন যে কয়ডা পুলাপান মারল তারারও হইতে পারে আবার পথের কোন রান্ডিরও হইতে পারে।
মৃত্তিকা– [হেসে] গুজব না তাহলে? [থেমে] বেশ্যা আর বিপ্লবীর তফাত কি বলেন? দুইজনেরেই সমাজ ত্যজ্য করেছে। সবাই ভান করছে যেন এদের কথা কেউ জানে না। যেন এরা ছিলনা কোনদিন। এদের মৃত্যু হয়ে গেছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সবাই এখন ব্যস্ত এদের কবরের ওপরে নিজেদের অট্টালিকা রচনা করতে। বিপ্লবীরা হল ইতিহাসের বেশ্যা। পরিবর্তনের কামোল উঠলে সে এদের এক একটাকে কামড়ে ধরে, এরপর ক্ষুধাশেষে ছুঁড়ে ফেলে গোরস্থানে।
হারিছ– জানাজা করা হয়নাই কোনদিন এই কবরের। আপনে করবেন? ব্যবস্থা করবো?
মৃত্তিকা– আমি মেয়ে এবং হিন্দু। আমার জানাজা কবুল হবেনা। আর এখানে যার কবর হয়েছে তার জানাজা হবেনা। কারণ সে মরেনাই। রাস্তায় যেদিন রোদ্দুর উঠবে, সেদিন সে কবর ভেদ করে উঠে আসবে।
হারিছ- আফা, কি কন? আমার ডর করতাসে।
মৃত্তিকা– আপনার কিসের ভয়? আপনার কি বন্দুক আছে? ট্যাংক আছে? সংবাদপত্র আছে? টিভি চ্যনেল আছে? সংসদ আছে? আপনাকে ওরা কিছু বলবে না। আপনার মাথার ওপর দিয়ে ওরা উড়ে যাবে, তারপর আবাবিল পাখির মতন পাথর বর্ষণ করবে আক্রোশের মালিকদের ওপরে।
হারিছ– আপনে যাই বলেন আপা, এই গোর আমি রাখুম না। এই গোর আমি খুইড়া তুলমু। এই লাশ আমি নদীতে ভাসামু।
[ মৃত্তিকার হাত থেকে কোদাল টেনে নিয়ে নিজে কবর খুঁড়তে শুরু করে। মৃত্তিকা হারিছের অলক্ষ্যে মাটিতে শুয়ে পড়বে। এপ্রোন দিয়ে ঢেকে দেবে নিজের শরীর আর মুখ। তারপর শহীদকে জড়িয়ে ধরবে। হারিছ কবর খুঁড়ে কিছুই পাবে না। সরাসরি তাকিয়ে থাকবে শহীদ আর মৃত্তিকার দিকে, কিন্তু তাদের দেখতে পাবেনা। উলটো ঘুরে মৃত্তিকাকে খুঁজবে। তাকেও খুঁজে পাবেনা।]
হারিছ– আপা, মিত্তিকা আপা। আফনে গেলেন কই? এই গোরে তো কিছু পাইলাম না। কই গেলেন আপনি। কই গেলো লাশ?
ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে মৃত্তিকা, শহীদ এবং সমবেত কণ্ঠে শাহানা, টুলু, মৃদুল বখতিয়ার [হারিছ ভীত দৃষ্টিতে চারিদিকে ওদের খুঁজবে] — আপনি আমাদের আর পাবেন না হারিছ ভাই। আমাদের মৃতদেহের ওপরে, আমাদের পলির ওপরে আপনারা হাঁটবেন, দালান বানাবেন, সংসার গড়বেন, ভালবাসবেন। তবে ভুলে যাবেন পায়ের তলায় আমাদের অবস্থান। ভুলে যাবেন তালুতে লেগে থাকা রক্তের কথা। আমাদের মধ্যকার যারা টাউট বাটপার, তাদেরকে আপনারা দেবতা বানাবেন, আর তারা হয়ে উঠবে আপনাদের শয়তান। তারপর একদিন কটকটে রোদ্দুরের নিচে অন্ধকার বিকেল আসবে। সেইসব শোষকের বিরুদ্ধে এই শহরের সন্তানের আবার মুঠো তুলবে। তখন আবাবিলের পাখায় ঢেকে যাবে সূর্য। শহরজুড়ে মুহুর্মুহু পাথরবৃষ্টি হবে। সেই পাথরবৃষ্টি শেষে আরও একদল শহীদ মৃত্তিকায় মিশে যাবে জন্ম জন্মান্তরের আরও লক্ষ লক্ষ শহীদের মতন। তারপর তারা ব্যগ্র হয়ে থাকবে, আবার আবাবিল হয়ে ফিরে আসবে বলে। সেদিন পর্যন্ত, আপনি মাটিতে মাটিতে, পার্কে পার্কে, শহরে শহরে আপনি আমাদের খুঁজতে থাকুন হারিছ ভাই। আমরা ফিরে আসবো।
[লাইটস অফ।]
দৃশ্য ৩
[শূন্য মঞ্চ। মাঝখানে হারিছ হেঁটে আসবে। তাকে কিছুটা বয়স্ক লাগছে।]
হারিছঃ সেই দিনের পরে আমি আর মৃত্তিকা আপারে দেখলাম না, দেখলাম না শহীদ ভাইরেও। এই পার্কে আর এখন বুধবার আসে না। কতোগুলা দিন কাইটা গেলো, কারও দেখা নাই। সবাই ব্যস্ত, সবাই ব্যস্ত। আমার বয়স হইসে, বয়স হইসে শহরের। বাচ্চাকাচ্চা, তরুণ-যুবা সবাই এইখানে বৃদ্ধ হইয়া গ্যাসে। সবাই আরাম পায়া গ্যাসে। সবাই যা হইতেসে দেখে, বিপদে পড়ে, ঘুষ দেয়, ছিনতাই হয়, কিন্তু কেউ কাউরে দোষ দেয়না। দোষ খালি দেয় নিজের ভাগ্যরে। ভাগ্যরে বদলাইতে আর কেউ রাস্তায় নামে না। সেই যে একবার শহিদ ভাইরা, শাহানা আপারা, বখতিয়ার ভাইরা নামলো। তাগোরে যে মাইরা শুয়ায়া দিলো, তারপরে আর কেউ স্লোগান দেয় না, কেউ মিছিল ডাকে না। সবাই পিঠ বাঁচায়। সবাই বিসিএস দেয়। এই মরা শহরে সবাই উন্নতি করে আর শহরটারও খালি উন্নয়নই হইয়া যায়। উন্নয়ন আর উন্নয়ন। উন্নয়ন ছাড়া কিছু নাই কারও মনে।
শুধু আমার মনে আইজকাও বাইচা আছে সেই আবাবিল পাখির গান। শহরের কানাকাঞ্চিতে আমি এখনও দিনেরাইতে আবাবিল পাখি খুঁজি। আকাশে যেদিন গনগনায়া সূর্য ওঠে সেইদিন আমি অপেক্ষা করে– এই বুঝি পাখির ডানায় ঢাইকা যাইব আকাশ। এই বুঝই পাথরের বর্ষা নামলো। এই বুঝই ছারখার হয়ে গেলো সব। এই বুঝই সব বদলাইয়া গেলো।
কিন্তু কিছুই হয়না। আমি শুধু পথে, পার্কে, প্রান্তরে বৃদ্ধ আবাবিল পাখির মৃতদেহ দেখতে পাই। নখের মধ্যে পাথর নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে তারা মইরা গেছে। তারা আর কোনদিন জাগবো না।
এইযে আপনারা, আপনারা সবাই। এই যে আপনারা নাটক দেখতে আইসেন। আপনারা কেউ দেখেন না সেই মরা পাখির পাহাড়। দেখেন না আপনারা সব বোবা হইয়া বইসা আপনাগো পূর্বপুরুষের আত্মারে কষ্ট দিতেসেন? দেখেননা কিছু?
আওয়াজ করেন না ক্যান মিয়ারা? কথা কন না কেন? কণ্ঠনালী কাইটটা গ্যাছে? ভুইলা গেছেন হাত মুঠা করা?
না ভুললে চিৎকার দেন। বুকে সাহস নিয়া রাজপথে নামেন।
একজন্, দুইজন, তিনজন। তারপর লক্ষ লক্ষ মানুষ নাইমা যান পথে।
দেখবেন তারপর, ওরা ফিরা আসবে। আকাশ ভইরা যাবে পাখির পাখায়। ঝরঝর বর্ষা নামবে নুড়ি পাথরের।
সেদিন বদলায়ে যাবে সব।
আনেন, আনেন মিয়া, আনেন সেদিন।
সাহস করেন মিয়া, আওয়াজ তোলেন।
সাহস করেন মিয়া, তোলেন আওয়াজ।
লেখকঃ অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিফোরামের ভারপ্রাপ্ত মুখপত্র সম্পাদক