শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকে ভাবছেন এ আবার কি? আসলে আজকাল তো এনিভার্সারির অভাব নেই কথায় কথায় বাৎসরিক এনিভার্সারির পাশাপাশি ষান্মাসিক, ত্রৈমাসিক, মাসিক এমনকি সাপ্তাহিক এনিভার্সারি পালন হয়! তাই ভাবলাম কোভিড-১৯ এর লকডাউনের এক মাস পূর্তিতে শুরু থেকে দিন গুলো একটু ঘুরে ফীরে দেখি আর সবার সাথে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।
আমি একজন প্রবাসী (শুনেই হয়তো অনেকেই গালাগাল শুরু করতে পারেন আমার মত প্রবাসীদের জন্যই আজ বাংলাদেশের এই দূরাবস্থা)। দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার, কুয়ালালামপুর শহরে।
মালয়েশিয়ার নাম শোনার পর আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের চোখে দুটি জিনিষ ভেসে ওঠে এক মাহাথীর মাহামুদ ও দুই কুয়ালামপুরের টুইন-টাওয়ার। আসলে এর বাইরেও অনেক কিছু রয়েছে এই দেশটিতে আয়তনে বাংলাদেশ হতে আড়াই গুণ বড় এবং মাত্র সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যার এই দেশটি যোগাযোগ, প্রযুক্তি, আধুনিকতায় ভরপুর। এর বাইরে আরো একটি বলার মত বিষয় এদেশের স্বাস্থ্যখাত। ২০১৯ সালের একটি জরিপে দেখা যায় স্বাস্থ্যসেবা ফ্যাসিলিটির দিক থেকে মালয়েশিয়া সবার উপরে।
এবার আসি কোভিড-১৯ বা করোনা ইশ্যুতে। চীনের উহান হতে যখন সংক্রামন ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে যে কটি দেশে কোভিড-১৯ ছড়ায় তার মধ্যে মালয়েশিয়া একটি। বলে রাখা ভালো চীনের সাথে বিভিন্ন দিক হতে ওতপ্রত ভাবে সম্পর্ক রয়েছে এমনকটি দেশের একটি মালয়েশিয়া এছাড়াও মালয়েশিয়ার প্রধান তিনটি জাতীগোষ্ঠির একটি চীনা জাতী। এক কথায় চীনের সাথে এদের জাতীগত একটি সম্পর্ক রয়েছে।
তাই কোভিড-১৯ সংক্রামনের শুরু থেকেই স্থানীয় ভাবে সংক্রামন মোকাবেলায় বিভিন্ন সতর্কতা গ্রহন করা হয়। তার পরেও জানুয়ারিতেই মালয়েশিয়াতে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত সনাক্তের পর পরই এখানকার সরকার চীনের নাগরিকদের জন্য সকল প্রকার ভিসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল ঘোষনা করে এবং ফ্লাইট বাতিল করে। সারা দেশে জনগনের সুরক্ষা ও সচেতনতায় নেয়া হয় নানা কার্যক্রম। কর্মক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ঘুরাফেরা বন্ধে বার বার বলা হয়। বাস, ট্রেন বা মেট্রোরেল এর মত গণপরিবহন গুলোতে দৈনিক নিয়ম করে জিবাণুনাশক ছিটানো, এবং গণপরিবহন পরিহার করে চলাচলর নিরুৎসাহী করা হয়েছে বার বার। এর মাঝে হঠাৎ করে সরকার পরিবর্তনের ঘটনাও এ কার্যক্রমে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগির সংখ্যাও খুব একটা বেশি বৃদ্ধি ছিল না একমাসেও। এমনকি লকডাউনও ঘোষনারও প্রয়োজন হয়নি। কারন ১৩ টি প্রদেশ বা বিভাগের মাত্র দুটিতেই নির্দিষ্ট চিকিৎসা কেন্দ্রের ভেতরেই চিকিৎসা নিচ্ছিল কোভিড-১৯ পজেটিভ রোগীরা।
তবে এর মাঝে মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বাজে ঘটনাটি ঘটেযায় ফেব্রুয়ারির ২৭ – মার্চের ২ তারিখ পর্যন্ত চারদিন ব্যাপি তাবলিগ জামায়াতের একটি সম্মেলনকে ঘিরে। যেখানে সারা দেশ থেকে অংশ নেয় সাড়ে ১৪ হাজার মানুষ এবং বিভিন্ন প্রতিবেশি মুসলিম দেশ হতে আগত আরো ২ হাজার সহ সর্বমোট সাড়ে ১৬ হাজার মানুষ। এই অনুষ্ঠানে আগতদের মাঝ হতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে সারা মালয়েশিয়াতে। যেখানে জানুয়ারি হতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একমাসে রোগীর সংখা ২০০ পার হয়নি সেখানে মার্চের ২ তারিখের পর লাফিয়ে বাড়তে থাকে এই সংখ্যা। দৈনিক এক-দেড়শ করে বাড়তে থাকে।
এই যখন পরিস্থতি তখন তাৎক্ষনিক ভাবেই সরকারি ভাবে উক্ত তাবলীগ সম্মেলনে অংশনেয়া এবং তাদের সংস্পর্শে আসা লোকজনকে বাধ্যতামূলক কোভিড-১৯ পরীক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়। এবং সর্বশেষ ১৮ই মার্চ হতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে MCO (Movement Control Order) বা চলাচল নিয়ন্ত্রন ঘোষনা আরোপ করা হয়, যা পরিবর্তে দুই দফায় ১৪ দিন হিসেবে বৃদ্ধি করে ২৮শে এপ্রিল পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। ১৪ দিন করে তিন ধাপের এই চলাচল নিয়ন্ত্রন বা এক হিসেবে লকডাউনে ধাপে ধাপে বেড়েছে কড়াকড়ি। আমরা হয়ত ভাবি একমাত্র আমাদের দেশেই রয়েছে অসচেতন মানুষ, আমাদের দেশই শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে ভরপুর বিষয়টি তা নয়। আমেরিকা, ইউরোপ, মালয়শিয়াতেও রয়েছে। এখানেও অনেক দরিদ্র মানুষের বসবাস, এখানেও রাস্তার ধারে মানুষ ঘুমোতে দেখা যায়।
তবে পার্থক্যটা হলএখানে আমাদের দেশের মত ত্রানের জন্য হাহাকার করতে দেখা যায় না কারন যার যার যার খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন তার তার ঘরে ঘরে পৌছে গেছে, গৃহহীন মানুষজনকে এই দূর্যোগে নিয়ে আসা হয়েছে একাধিক স্টেডিয়াম ও বিশাল আকারের কনভেনশন সেন্টার গুলোতে অস্থায়ী সুরক্ষা সেন্টারে। প্রয়োজন অনুযায়ী করা হচ্ছে পরীক্ষা, কাউকে এই হাসপাতাল সেই হাসপাতালে ধর্না দিতে হচ্ছে না হটলাইন নম্বরে কল করলেই কোভিড-১৯ এর উপসর্গ থাকলে মেডিক্যেল টিম এসে নমুনা সংগ্রহ হতে প্রয়োজনে করা হচ্ছে হাসপাতালে স্থানান্তর। যে সকল এপার্টমেন্ট বা সুউচ্চভবনে কোভিড সংক্রামিত রোগী পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই তাৎক্ষনিক লকডাউন ঘোষনা দিয়ে সমস্ত বাসিন্দাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অস্থায়ী মেডিকেল টিম প্রেরন হতে শুরু করে বাসিন্দাদের জন্য খাদ্য সহায়তা পর্যন্ত প্রেরণ করা হচ্ছে প্রতিটি দরজায়।
অপ্রয়োজনে ঘর হতে বের হওয়া বন্ধ করতে গ্রোসারী, ক্লিনিক ও হাসপাতাল ছাড়া সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। খাদ্য দ্রব্যের দোকান ও ফুড ডেলিভারিও সকাল ৮টা হতে সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রন করা হচ্ছে কঠোর ভাবে সেই সাথে ট্যাক্সি ওবিভিন্ন ই-হাইলিং যানবাহনও এর পরেও বিনা প্রয়োজনা বাইরে ঘোরাফেরা নিয়ন্ত্রন করতে প্রতিটি সড়কে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট রাস্তায় রাস্তায় চলছে পুলিশ ও সেনা টহল, চলছে জেল জরিমানা। এখনো পর্যন্ত পরিস্থিথি যাতে কোন ভাবেই আবার আবনতি না হয় তা ঠিক রাখতে স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টি বার বার নিশ্চিত করা হচ্ছে। যথেষ্ট প্রস্ততির পরেও যাতে স্বাস্থ্য সেবায় কোন কমতি না থাকে তা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে কঠোর ভাবে। সব মিলিয়ে গত একমাসে যা কিছু হয়েছে তার প্রতিটি বিষয় হয়েছে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক। আমাদের দেশের মত নেই একে অন্যের উপর দোষ চাপানো আর অব্যবস্থাপনা।
আর কোভিড-১৯ এর বিষয়টি মালয়েশিয়াতে রাজনৈতিকদের ফাঁকা বুলির মাধ্যমে নয় স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখানে প্রধানমন্ত্রী বা স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রনে সকল সিদ্ধান্ত বা আদেশ নির্দেশ দিচ্ছেন না, সমন্বয় ও সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন স্বাস্থ্যক্ষাতের মহাপরিচালক দাতুক ডাঃ নূর হাশিম, যিনি ১৯৮৮ সালে ডক্টর অফ মেডিসিন, ১৯৯২ সালে সার্জারি তে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন মালয়েশিয়া হতে এবং পরবর্তীতে এন্ডোক্রাইন সার্জারি সহ একাধিক বিষয়ে অষ্ট্রেলিয়া হতে একাধিক বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষন লাভ করেন। তার একের পর এক দৃঢ় ও সময় উপযোগী পদক্ষেপে অবশেষে পরিস্থতি উন্নতি লাভ করেছে সর্বশেষ আজ নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ জন যার বিপরীতে সুস্থ্য হয়েছেন ৯৮ জন। অন্যদিকে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫৪২৫ জন যার মধ্যে ৩২৯৫ জন ইতমধ্যে সুস্থ্য হয়েছেন, মোট মারা গেছেন ৮৯ জন, এবং চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২০৪১ জন। আর সর্বোমোট করোনা টেষ্ট করা হয়েছে ১ লক্ষ ২ হাজার ৭১১ জনের।
এই তো গেল আমার প্রবাসে লকডাউনের একমাস পূর্তির হিসেব নিকেশ। এবার দেখি আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের অবস্থা।
শুরু থেকেই আমাদের দেশে বিষয়টি সরকার গুরুত্ব সহকারে নেয় নি। সারা বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ নিয়ে চিন্তিত তখনো আমরা আতশবাজী আর নির্বাচন নিয়ে ব্যাস্ত। আমাদের নীতিনির্ধারক লেভেলের রাজনৈতিকদের চিন্তাধারা এতই নিকৃষ্ট আমরা নির্বাচন বাদ না দিয়ে হাত ধুয়ে ভোট দেয়ার স্লোগান দিতে দেখি এদের। অতপর আসি দোষ চাপানোয়। উহান হতে ফেরত ছাত্র-ছাত্রী, গবেষকদের কথা মনে আছে যারা প্রথম দফায় চীন হতে ফিরেছিল? তাদের যখন এনে আশকোনার হজ্ব ক্যাম্পে রাখাহয় তখনও তাদের গাদাগাদি করে গণরুমে রাখা হয় কয়েকজন যখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম গুলোতে বিষয়গুলো তুলে ধরেন তখন তড়িঘড়ি করে কিছু বিষয় ঠিক করে কোনরকম ১৪ দিন পার করা হয়। এবং আনন্দের বিষয় ছিল এদের কেউ কোভিড-১৯ পজেটিভ ছিল না। তবে এটি একই সাধে একটি বিপদেরও বিষয় হয়ে দাঁড়ায় আমাদের জন্য। কারন উহান বা চীন ফেরত কারো কোভিড-১৯ পজেটিভ না হওয়ায় আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় ও অভিবাসন বিভাগ বিষয়টাকে আরো হালকা ভাবে নেয় আর যার ফলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন দেশ হতে আগত প্রবাসীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ক্ষেত্রে উদাসীনতা ছিল লক্ষনীয়! এয়ারপোর্টে নামমাত্র তাপমাত্রা পরীক্ষা অতপর হোমকোয়ারেন্টাইন এর কথা বলে যোগাযোগের জন্য একটি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে তারা। অথচ হোম কোয়ারেন্টাইন কি তা বুঝিয়ে বলার মত ছিলনা কোন লক্ষনীয় উদ্যোগ। ছিলনা পর্যাপ্ত পরীক্ষা করার মত কিটও। উপসর্গ নিয়ে অনেকেই যোগাযোগ করলেও শতভাগ প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকা আইইডিসিআর থেকে করা হয়নি পরীক্ষার ব্যবস্থ্যা।
যার ফলাফল পাওয়াগেল হাতেনাতে। ইউরোপ ফেরত মানুষ গুলো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল কোভিড-১৯ নিয়ে। নিজেদের পাশাপাশি আক্রান্ত করলেন আসেপাশের মানুষকে। আর এই সুযোগে বিদেশ ফেরতদের বানানো হল বলির পাঁঠা। প্রস্তুতির ঘাটতির বিষয়টি প্রবাসীদের অসচেতনতার উপর দায় চাপিয়ে জনগণকে করে দেয়া হল বিভক্ত ও প্রবাসী বিদ্বেষী! অথছ পৃথীবির সকল দেশই যেখানেই নিরাপত্তার অভাব বোধ কেরেছে সেখান হতেই তার নাগরিকদের নিজদেশে ফেরত এনেছে। কারন একজন নাগরিকরের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বও কিন্তু রাষ্ট্রের। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী গত তিনমাসে প্রায় ৪.৫ হতে ৫ লক্ষ প্রবাসী দেশে ফীরে। এই ৫ লক্ষ প্রবাসীর সবাই কোভিড-১৯ পজেটিভ তা না। কিন্তু বিপর্যয় এড়াতে যদি তাৎক্ষনিক ভাবে প্রবাস হতে আগতদের জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি প্রবাস ফেরত নাগরিককের ১৪ দিনের প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করা হত তাহলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রন সরকারের জন্যই সহজ হত। দৈনিক ২ হাজার টাকা করে ১৪ দিনে যদি ২৮ হাজার টাকা করেও প্রবাসফেরতদের জন্য সরকার খরচের সিদ্ধান্ত নিত তাহলে তিনমাসে ৫ লক্ষ প্রবাস ফেরত মানুষের জন্য সরকারের খরচ হত ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অথচ তৎক্ষনিক ভাবে হয়ত টাকার অংকটা বেশ বড় মনে হয়েছিল আমাদের নীতিনির্ধারক মহলের কাছে! কিন্তু ৫ লক্ষ কোটি টাকার উপরে যে দেশের বাৎসরিক বাজেট পরিকল্পনা করা হয় সেখানে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বেশি কিছু নয়। দিন শেষে আমরা দেখলাম প্রধানমন্ত্রীকে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রনোদনা ঘোষনা দিতে! এটাকে তুলানা করা যেতো পারে গাধার ঘোলা করে জল পানের সাথে। শেষমেষ প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের নামে মানহীন অব্যবস্থাপনায় ভরপুর আশকোনার হজ্ব ক্যম্পে যা ঘটল ইটালি ফেরতদের নিয়ে সেটা নিয়ে নতুন করে বলার নেই। আর সবশেষ করে ইউরোপের ফ্লাইট বন্ধ করা হল।
অতপর উঠে এলো সমন্বয়হীনতা আর অব্যবস্থাপনার একের পর এক নগ্ন চিত্র! শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি দেয়া হল ঘরে থাকার নির্দেশনা ছাড়া! মানুষ ছুটলো গ্রাম আর বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে! সমালোচনার মুখে বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ হল অথচ রাতে হলো আতসবাজি উৎসব! ছুটি ঘোষনা দেয়া হল দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ না রেখে! নিম্ন আয়ের মানুষ ছুটলো গ্রামের পথে। আবার সমালোচনা! এবার যানবাহন বন্ধ! সিঙ্গাপুর কানাডা ছাড়িয়ে যাওয়া অর্থনীতির দেশে দুদিন ছুটিতেই খাবার আর ত্রানের জন্য হাহাকার দেখল মাানুষ, এগিয়ে আসতে হল সামাজিক সংগঠন গুলোকে। সরকার থেকেও এলো ত্রান তৎপরতার খবর তবে ত্রানের চাল চুরির তৎপরতাই বেশি দেখাগেল! আকাশ হতে লসএ্যঞ্জেলেস মনে হওয়া ঢাকা শহরে ক্ষুধা সামলাতে না পেয়ে ত্রানের ট্রাক লুট দেখলো নগরবাসী! গার্মেন্টস ছুটি দিয়ে আবার খোলার নির্দেশ পেয়ে লাখ লাখ মানুষের পায়ে হেঁটে ঢাকায় প্রবেশ! পরদিন আবার ছুটি ঘোষনা! সর্বত্র কারনে অকারনে লোকসমাগম।
এসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত আসুন এবার একটু স্বাস্থ্যখাত দেখি। শুরু থেকে শতভাগ প্রস্তুতি অথচ পরীক্ষার জন্য নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক কিট! পজেটিভ রোগীর সংখ্যা ও সামাজিক কারন দেখিয়ে তথ্য গোপন করা হল এমন ভাবে যেন তারা HIV পজেটিভ! অথচ পজেটিভ রোগীর তথ্য জানানো উচিত ছিল আশেপাশে তাদের সংস্পর্শে আসা মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থেই কিন্তু পরীক্ষা সরঞ্জামাদির অভাব ঢাকতে সেটাকে বানিয়ে দেয়া হল রোগীর সামাজিক স্বার্থ! দিন শেষে হল হিতে-বিপরীত, সাধারনের এখন কেউ উপসর্গ দেখাদিলে চেপে যান! তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে গিয়ে আক্রান্ত করছেন চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী সহ আশেপাশের অনেককেই! অন্যদিকে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিতদের প্রয়োজনীয় উপাদান সংকট সহ বছরের পর বছর দূর্নীতির কবলে বিপর্যস্ত চিকিৎসা খাতের উলঙ্গ দিক রাষ্ট্রর নাগরিকদের সামনে প্রকাশ হয়ে গেছে! দিন শেষে আশার বানী শোনানোর কিছু খুঁজে পাই না।
এই যখন পরিস্থিতি তখনও সবকিছুর সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রন হচ্ছে রাজনৈতিক ভাবে। সত্য বলতে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের সব মুশকিলে আছান একজন, সবজান্তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, বিচার আচার, ছাত্র আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোথাও আগুন লাগলে অগ্নিনির্বাপণ, কোথাও লঞ্চ ডুবলে তার উদ্ধার কাজ হতে শুরু করে সর্বশেষ কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রনের নির্দেশনা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার জন্য! আচ্ছা সব কাজের নির্দেশনা যদি তাকেই দিতে হয় তবে বাকী মন্ত্রী এমপি সচিব প্রজাতন্ত্রেরর বাকি সব কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজ কি? নাকি তিনি কি সবজান্তা? সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ? সেটা কি সম্ভব? আমি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক জ্ঞান নিয়ে কোন প্রশ্নো তুলছি না কারন প্রশ্নো তোলাটা বোকামি। আমি প্রশ্নো তুলছি বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রনালয়ে নিয়োজিতদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও অভিজ্ঞতার অভাব নিয়ে। কারন একটি ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পানিছিটানোর নির্দেশনা পাওয়ার জন্য বসে থেকে অপেক্ষার চাইতে দেশ বিদেশের ফায়ারর সেইফটি ও ফাইটিং এক্সপার্টদের মতামত নেয়াটা কি সহজ ও যুক্তি সংগত নয়? প্রধানমন্ত্রীর কাজ কি কোথায় আগুন লাগলো, কোথায় পানিতে লঞ্চ ডুবলো, কোথায় কে খুন হল আসামি ধরতে পারছেনা পুলিশ এসব দেখা? নাকি বড় সিদ্ধান্তগুলো দেখা?
করোনা নিয়ন্ত্রনের বিষয়টি দেখভাল করার জন্য কি আমাদের দেশে মালয়েশিয়ার ডাঃ নূর হাশিমের মত চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কেউ নেই? নিশ্চই অনেকেই আছে। তার পরও কেন দিনের পর দিন স্বাস্থ্য মন্ত্রীর ভুল ভাল কথাবার্তার ভিডিও বার্তা নিয়ে ট্রল হচ্ছে? আমার হিসেবেতো স্বাস্থ্যমন্ত্রীও এখানে একপ্রকার বলীর পাঁঠা। এখন পর্যন্ত তার কোন ক্ষমতা নেই মিডিয়া ব্রিফিং ছাড়া! আর করার আছেও কি? কোন কিছুতেই নেই সমন্বয়, আর তিনি তো চিকিৎসা ব্যাক্তিত্বও নন যে এসব বিষয়ে তার পরিপূর্ণ জ্ঞান রয়েছে! এখনো পর্যন্ত তাকে কাঁঠাল পাতার চিবোনোর মত করে কিছু প্রিন্ট করে কাগজ মিডিয়ার সামনে পড়া ছাড়া আর কিছু করতে দেখছি না! সময় খারাপ হলে দেখাযাবে তাকে পদত্যাগ বাধ্য করে অনেকেই হয়তো বাহাবাও নিবেন!
তাই বলি এই সবজান্তার দেশের সিষ্টেমে পরিবর্তন হোক। আপনি কিভাবে হাঁচি-কাশি দিবেন সেটা সেখানোর দায়িত্ব কখনে প্রধানমন্ত্রীর নয়। যে যেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং যেখানে যার প্রয়োজন সেখানে তাকে সেটাই সামলানোর দায়িত্ব দেয়া হোক। বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশের নেতা-নেত্রী, সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ভ্রমন করেন আলু তোলা, পটল তোলা, পুকুর খনন এর প্রশিক্ষণ নিতে অথছ দরকারি কিছুই শিখেন না কিভাবে সবাই মিলে একটি দেশ পরিচালনা করতে হয়, কিভাবে একজনের নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে সবাই মিলে একটি সংকট মোকাবেলা করতে হয়।
অন্তত এইটুক বোধদ্বয় আমাদের হওয়া উচিত। একজন প্রধানমন্ত্রী, একজন মন্ত্রী, বা একজন সাধারণ নেতা-নেত্রী তো সবজান্তা নয়, সবজান্তা হওয়া সম্ভবও নয়।
আবু রাইহান, মুক্তিফরামের একজন সম্পাদক