২০১৯ সালে আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকান্ডের পরে উদ্ভুত রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে আমি আমার আরও কিছু রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া মুক্তিফোরাম নেটওয়ার্ক তখনই একটি সংগঠনের রূপ নেয়া শুরু করে। আমরা ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে মানুষকে আমাদের সাথে যুক্ত হবার আহ্বান জানাই। তাতে সাড়াও দেন অনেকে। শুরু হয় আমাদের মিটিং মিছিল।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি শুরু হয় সেটা হলো গঠনতন্ত্র তৈরির কাজ। নতুন রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আমরা যে কাজটি শুরুতেই করতে চেষ্টা করেছিলাম তা হলো বাংলাদেশের অন্য সকল দল যেভাবে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলে, সেখান থেকে বের হয়ে আসা। তাই আমরা গণপরিষদ বৈঠক নামে পরপর কিছু আলোচনার আয়োজন করি। সেখানে অনেকগুলো পরামর্শ নিয়েই আমাদের গঠনতন্ত্র রচিত হয়। আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা এমনভাবে গড়ে উঠবো যাতে আমাদের মধ্যে থেকে কোনভাবেই স্বৈরতন্ত্রের জন্ম নিতে না পারে। সেখান থেকেই আমরা ভাবি যে আমরা যখন পদবিন্যাস করবো, তখন সেখানে একজন মুখ্য সমালোচক থাকবেন, যার কাজই হবে দলের সমালোচনা করা, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়া।
দলের মাঝে আত্মসমালোচনা না থাকলে সেই দল স্বৈরতন্ত্রে পর্যবসিত হবার বিকট সম্ভাবনা রয়ে যায়। পরবর্তীতে (যদি ভুল করে না থাকি) রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনও তাদের দলে একজন সমালোচক রাখেন। এই দলটির ওপর এজন্যেই আস্থা রেখেছিলাম। তবে গণসংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠার পথে এখনও এই দলটির নানান অন্তরায় রয়েছে। এই রচনা তাদের লক্ষ্য করে না বলে সেই আলাপ আপাতত মুলতবি রাখছি।
এই রচনার লক্ষ্যবস্তু হলো জুলাই অভ্যুত্থানের থেকে গড়ে ওঠা তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি—এনসিপিকে। শুরু থেকেই এই দলের ওপর অনেকে অনেক আশা-ভরসা রেখেছেন। অনেকে এখনও রাখছেন। সত্যি বলতে যখন অনলাইনে আমরা এদের সমালোচনা করেছি, তাদের মাঝে একটা বড় অংশই করছি কারণ আমাদের এই দলের প্রতি দায় ও দরদ আছে। আমরা চাই সমালোচনা আমলে নিয়ে তারা নিজেদের উন্নত করুক। তবে তার এমন সব উত্তর এনসিপির মানুষেরা দিয়েছেন যে তাতে মনে হয় তাদের দলের পিঠ বাঁচানোর জন্য তারা যথেষ্ট আন্তরিক।
প্রতিটি দলেরই এপোলজিস্ট থাকে যারা সমালোচনাকে খন্ডন করবে। তবে এনসিপির কাঠামোর মধ্যে কি সমালোচনা আমলে নেবার মতন কোন ব্যবস্থা বা মেকানিজম আছে? সমালোচনা ছাড়া গঠন হয়না। আর গঠন ছাড়া সমৃদ্ধি হয়না। ইদানিং কালে এনসিপি যেভাবে রাজনীতি করছে, তার অনেক কিছুরই অনেক ধরণের সমালোচনা উঠে এসেছে, এবং আমিও করেছি। তবে এই সমালোচনা তারা আমলে নিয়ে নিজেদের শুধরানোর চেষ্টা করবেন নাকি বাকি সব দলের মতই সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে যাবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
অনেক দলের মতই এনসিপিতেও আমার যুক্ত হবার সুযোগ তৈরি হয়েছিলো। আমি এখনও যুক্ত হইনি তার কারণ এই যে আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে এই দলটি ঠিক কেমন দল হবে। এটিও কি গতানুগতিক ক্ষমতা চর্চার স্বৈরতান্ত্রিক দল হবে, নাকি আভ্যন্তরীন গণতান্ত্রিক চর্চা এই দলের ভেতরে থাকবে। সেই জন্যেই আমি আপাতত বাইরে থেকে সমালোচনা করছি। দেখতে চাইছি যে এমন সমালোচনা নিয়ে তারা ঠিক কি করেন। তাদের বিস্তারিত গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো দেখার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি। নিশ্চয়ই তারও গঠনমূলক সমালোচনা করবো। কারণ দলে সমালোচনার জায়গা না থাকলে এনসিপি যথারীতি অপরাপর রাজনৈতিক দলের মতই স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠবে। তাই গঠনের স্বার্থেই তাদের উচিত কিছু আভ্যন্তরীণ সমালোচক নিয়োগ দেয়া। তা যদি না করেন, তবে বর্তমান মডেলে যেমনটি এপোলজিস্ট পুষছেন, তেমনি পুষতে পারেন। তার থেকে আমরা আরেকজন আরাফাত পাবো, পলক পাবো, জব্বার পাবো, কাদের পাবো—জাতীয় রাজনীতির আমূল পরিবর্তনের যে সংকল্পের কথা এনসিপি বলে, সেটা পাবো না। হয়তো তারা কিছু আসন জিতবেন, হয়তো ক্ষমতায়ই যাবেন কখনও। তবে জনপন্থী বহুত্ববাদী দল হয়ে উঠতে পারবেন না।
বহুত্ববাদী হতে গেলে দলের মাঝে বহু মতের লোককে যেমন জায়গা দিতে হবে, তেমনি বহু মতের মানুষকে ধরে একমাত্রিক পার্টি লাইনে এনে ফেললে হবে না। বহু মতের সম্মিলনে একটা সিনথেসিস বা সংশ্লেষে পৌঁছাতে হবে। এইজন্য তাদের গঠনতন্ত্র হতে হবে স্বৈরতাবিমুখী বা ফ্যাসিজম-প্রুফ। সেইজন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে আভ্যন্তরীণ সমালোচকের নিয়োগ।বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দীর্ঘদিনের একটি ব্যাধি হলো ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা এবং সমালোচনাকে দমন করা। অধিকাংশ দলই সমালোচনাকে একটি বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে দেখে, অথচ সত্যিকার গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য সমালোচনা একান্ত অপরিহার্য। এনসিপি যদি সত্যিই একটি নতুন ধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে চায়, তবে তাদের প্রয়োজন নিজেদের মধ্যে আত্মসমালোচনার জায়গা তৈরি করা এবং বহুমতের সংলাপকে দলীয় কাঠামোর অংশ করা।
কেবলমাত্র জনতুষ্টির ওপর ভর করে রাজনীতি করা বা অন্ধ সমর্থকদের তৈরি করলেই একটি দল গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে না; বরং দলীয় কাঠামোর মধ্যেই গণতান্ত্রিক চর্চার নিশ্চয়তা থাকতে হয়।
এনসিপির বর্তমান অবস্থান ও কার্যক্রম অনেকের মধ্যে আশা জাগালেও, তাদের ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই নির্ভর করবে এই প্রশ্নের উত্তর কীভাবে তারা দেয়—তারা কি সত্যিই বহুত্ববাদী রাজনৈতিক চর্চাকে উৎসাহিত করবে, নাকি ধীরে ধীরে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল হয়ে উঠবে? শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবৃতি বা প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব নয়; বরং দলীয় কাঠামো ও নীতির মধ্য দিয়ে সেটি প্রতিফলিত হতে হবে। তাই এনসিপির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে তাদের নিজস্ব গঠনতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রবিমুখ করা এবং এর ভেতরে এমন ব্যবস্থাপনা রাখা, যেখানে দলের ভুলত্রুটি নিয়ে দলীয় কাঠামোর মধ্যেই আলোচনা হতে পারে।
এজন্যই তাদের উচিত দলীয় কাঠামোর মধ্যে নির্দিষ্ট সমালোচক বা অভ্যন্তরীণ সমালোচনার মেকানিজম রাখা, যারা দলীয় ভুলত্রুটি চিহ্নিত করবে এবং সেগুলো শুধরে নেওয়ার পথ সুগম করবে। যদি এনসিপি সত্যিই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার আদর্শে গড়ে উঠতে চায়, তবে তাদের স্লোগানের বাইরে গিয়ে বাস্তবিক অর্থেই গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুবা, তারা হয়তো ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হবে।
অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিপত্রের প্রধান সম্পাদক ও ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের পিএইচডি শিক্ষার্থী